দেওয়ার হাত প্রসারিত হবে, না কি চাওয়ার হাত গুটোবে
Opposition Alliance

এ বার তবে কী...

রাজনীতি তো সম্ভাবনার শিল্পও। ফলে কেউ যদি ছবিটিকে এই রাজ্যে বিরোধীদের জোট-উদ্যোগের একটি খণ্ড-প্রয়াস বলে ধরে নেন, সেই ভাবনার স্বাধীনতা তাঁর অবশ্যই থাকা উচিত।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৩২
Share:

আলাপ: দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের বৈঠকে নেতারা। ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৩। ছবি: পিটিআই।

একটি ছবি অনেক সময় হাজার শব্দের চেয়েও বেশি বাঙ্ময় হয়ে উঠতে পারে। যেমন, ছবিতে কাহিনি। দিল্লির বিরোধী বৈঠকের তেমনই একটি আলোকচিত্র ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে নিশ্চয়ই সেটি নজরও করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, বৈঠকের নির্ধারিত আসন-বিন্যাস অনুযায়ী দু’পাশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সীতারাম ইয়েচুরিকে নিয়ে রাহুল গান্ধী বসেছেন একেবারে মধ্যমণি হয়ে!

Advertisement

রাজনীতি তো সম্ভাবনার শিল্পও। ফলে কেউ যদি ছবিটিকে এই রাজ্যে বিরোধীদের জোট-উদ্যোগের একটি খণ্ড-প্রয়াস বলে ধরে নেন, সেই ভাবনার স্বাধীনতা তাঁর অবশ্যই থাকা উচিত। আবার বৈঠকের ভিতরের যেটুকু সংবাদ বাইরে বেরিয়ে এসেছে, তাতে জানা গিয়েছে, রাহুল সেখানে সর্বদাই ছিলেন ‘বামপন্থী’! অর্থাৎ, তিনি নাকি কার্যত বামে হেলে সীতারামের সঙ্গেই কথাবার্তা বলে গিয়েছেন। তাতে ‘শুষ্ক’ রাজনীতির প্রসঙ্গ তেমন ছিল না বলেও কানে এসেছে। সত্যাসত্য জানা নেই।

রাহুলের সঙ্গে মমতার সম্পর্কের অবস্থানকে এক দিক থেকে ‘ভাইপো-তুল্য’ বলা বোধ হয় খুব ভুল হবে না। অবশ্যই তা কিছুটা প্রজন্মের নিরিখে। মমতার প্রতি রাজীব গান্ধী কতটা স্নেহপ্রবণ ছিলেন, তার বিস্তর উদাহরণ রয়েছে। তাঁর চোখে মমতা যেন ছোট বোন। পরবর্তী কালে সনিয়ার কাছেও মমতা অনেকটা পরিসর পেয়েছেন। হয়তো আজও তার রেশ পুরোপুরি কাটেনি। তবে রাজীবের আমলে রাহুল ছিলেন কৈশোর-তারুণ্যের মাঝামাঝি। তখনও তাঁর ছাত্রাবস্থা চলছে। রাজনীতিতে আসার ভাবনা দূরস্থান। তাই মমতার কাছে তিনি তখন ছিলেন শুধুই ‘রাজীবজির পুত্র’।

Advertisement

কিন্তু রাহুলের রাজনৈতিক উত্থান ও কংগ্রেসের নেতৃত্বে অভিষেকের পর থেকে বার বার তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্কের ভাঙাগড়া মমতা-রাহুলের ‘ব্যক্তিগত’ রসায়নে গভীর ছায়া ফেলেছে— যা বেশ অম্লমধুর। কখনও অম্ল বেশি, কখনও মধু! সেই জন্যই মমতার দিকে রাহুল বাদামের প্লেট এগিয়ে দিলে আজ সেটা ‘খবর’ হয়। রাহুলের পিঠে মমতা স্নেহের হাত রাখলে তা নিয়ে রাজনীতির পাড়ায় গুঞ্জন তৈরি হয়। আবার কেউ কারও প্রতি ‘উপযুক্ত’ ভব্যতা না দেখালে সেই বিষয়টিও আলোচনার বাইরে থাকে না।

মুখে উচ্চারিত হোক বা না হোক, উভয়ের মনের ভিতরের এমন চাপা শীতলতার কারণেই মমতার কাছে রাহুল কখনও একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ কংগ্রেস নেতা হয়ে উঠতে পারেননি। অপর পক্ষে রাহুলের দিক থেকেও মমতাকে ‘অভিভাবক’ হিসাবে মেনে নেওয়ার মানসিকতা প্রকাশ পায়নি। এ সব সকলের জানা। এ বার জোটের বৈঠকে মল্লিকার্জুন খড়্গের নাম মমতা সামনে এনে দেওয়ায় শুধু ভিতরের ভাবটি বাইরে খানিক স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, এই যা।

সমসময়ের রাজনীতিতে মমতা নিঃসন্দেহে বড় মাপের এক জন কুশলী। তাঁর সম্পর্কে অনেক পর্যবেক্ষকের অভিমত হল, আজকের দিনে রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তায় তৃণমূল নেত্রীর স্থান প্রথম সারিতে। দেশের অনেক তাবড় নেতার থেকে তিনি এ ক্ষেত্রে অন্তত দশ কদম এগিয়ে। কেউ তাঁর এই ‘দক্ষতা’র প্রশংসা করতে পারেন। কারও কাছে বিষয়টি সমালোচনার উপাদান হতে পারে। তবে যে দৃষ্টিতেই দেখা হোক না কেন, কৌশলে দড় হওয়া এবং নিজের অঙ্ক অনুযায়ী ‘সময়’ বুঝে কোনও কৌশল কাজে লাগানো এক জন নেতার পক্ষে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ‘লম্বা দৌড়’-এর জন্য তো বটেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাতে পটু।

যেমন, চার রাজ্যের ভোটে কংগ্রেস দাগ কাটতে পারলে এবং তখন রাহুলের নামে জয়ধ্বনি উঠতে শুরু করলে আজ নিশ্চিত ভাবেই মমতা খড়্গের নাম করতেন না। বরং জোটের ‘মুখ’ ভোটের পরে স্থির করার ব্যাপারে আগের বক্তব্যেই অটল থাকতেন। সেটা হয়নি বলে তিনি দ্রুত পরিস্থিতির ‘সদ্ব্যবহার’ করে জোটের ঘরেও আলোড়ন তুলে দিলেন।

এ বার প্রশ্ন, মমতা হঠাৎ খড়্গের নাম করলেন কেন? অশীতিপর এই নেতার সঙ্গে তৃণমূল নেত্রীর দীর্ঘ রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, তা নয়। উল্টে খড়্গের ব্যবহার বা কথাবার্তার ভঙ্গিতে মমতা অনেক সময় ‘সৌজন্যের অভাব’ অনুভব করেছেন বলে অনুযোগও শোনা গিয়েছে। সর্বোপরি, কাগজে-কলমে কংগ্রেসের সভাপতি হলেও গুরুত্বের সারণিতে দলে খড়্গের স্থান রাহুলের উপরে নয়, এটা শিশুও বোঝে।

তবু মমতা যে খড়্গেরই নাম বললেন, তা কি শুধু তিনি ‘দলিত’ বলে? মনে হয় না। বরং বলব, আর পাঁচটি কারণের নিরিখে ওইটি হয়তো সবচেয়ে লঘু যুক্তি। এক এক করে দেখা যাক।

প্রথমত, কংগ্রেস সভাপতি খড়্গের নাম সামনে আনার ফলে রাহুলের নামে প্রশ্নচিহ্ন তুলে দেওয়া গেল। আবার ‘ব্যাকরণ’ মেনে জোটের বৃহত্তম দল কংগ্রেসকে নেতৃত্বের স্বীকৃতিও দেওয়া হল! দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক বিধানসভা ভোটগুলিতে কংগ্রেস ধাক্কা খাওয়ার পরে নীতীশ কুমার বা আরও যে দু’-এক জন জোটের ‘মুখ’ হওয়ার প্রত্যাশা পোষণ করছেন, মমতার চালে আপাতত তাঁদের দমিয়ে দেওয়ার অবকাশ মিলল। তৃতীয়ত, কংগ্রেসের মধ্যেও কিছুটা সংশয়, কিছুটা বিভ্রান্তি ছড়াল। আর এই সবের পাশাপাশিই এক জন প্রবীণ নেতার উপর ‘আস্থা’ পোষণ করে মমতা অন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তাও দিতে চাইলেন, যা সুদূরপ্রসারী।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘খড়্গে-গুগলি’র ফলে কি জোটের মূল কাঠামোয় কোনও ধাক্কা আসবে? সন্দেহ নেই, সহসা একটি ‘বজ্রপাত’ হলে তার কিছু অভিঘাত থাকবেই। বস্তুত জোটের গতিপ্রকৃতিতে অসন্তোষের আভাস ইতিমধ্যে নীতীশের মতো কয়েক জন নেতার কথাতেও মিলেছে।

কোনও রফার তালিই এক হাতে বাজে না। তবু জোট বজায় রেখে ভোট করার চাপ সবচেয়ে বেশি কংগ্রেসের ঘাড়ে। কারণ তারা প্রধান দল। ফলে দায় ও প্রাপ্তি দুটোই তাদের বেশি। সাধারণ বুদ্ধি বলে, কংগ্রেস তাই নিজের স্বার্থেই এখন বেশি করে জোট ধরে রাখতে চাইবে। কতটা পারবে, বলবে ভবিষ্যৎ। তবে কোথাও কোথাও জট যদিও থাকে, আসন-রফার বিবাদ খুব ব্যাপক আকার না নিলে অন্তত ভোট পর্যন্ত জোট টিকিয়ে রাখতে সব দলই চাইবে।

তৃণমূল নেত্রীর খড়্গে-প্রস্তাবে প্রথমেই সায় দিয়েছেন আপ-নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়াল। মমতার পাশে আছেন উত্তরপ্রদেশের প্রধান বিরোধী দল সমাজবাদীর নেতা অখিলেশ যাদবও। ঘটনা হল, মমতার পশ্চিমবঙ্গ, আপ-এর দিল্লি, পঞ্জাব ও অখিলেশের উত্তরপ্রদেশে আসন রফা করতে হবে মূলত কংগ্রেসের সঙ্গে। নিজ নিজ ক্ষমতার কেন্দ্রে কংগ্রেসের চাহিদা মানতে ওই নেতারা কে কত দূর রাজি হবেন, কংগ্রেসই বা কোথায় কতটা ‘মানিয়ে’ নিতে পারবে, এখনই বলা কঠিন। তার পরেও থাকছে স্ট্যালিনের তামিলনাড়ু, উদ্ধব ঠাকরে শরদ পওয়ারের মহারাষ্ট্র, নীতীশ-তেজস্বীর বিহার।

আসন বণ্টনের একটি ভাবনা হাওয়ায় ঘুরছে। যাতে লোকসভার ৫৪৩ কেন্দ্রের মধ্যে কমবেশি ৩০০টিতে নাকি কংগ্রেস লড়বে। বাকি ২৪৩টিতে ভাগাভাগি হবে। অন্য রাজ্য বাদ দিয়ে শুধু উত্তরপ্রদেশ, বাংলা, দিল্লি ও পঞ্জাব ধরলে মোট আসন ১৪২। উত্তরপ্রদেশে ৮০টির মধ্যে ক’টি আসনে রফা হয়, তার উপর জোটের সামগ্রিক ভবিতব্য অনেকাংশে নির্ভরশীল।

তৃণমূলের সঙ্গে জোটে এই রাজ্যের কংগ্রেস নারাজ থাকলেও ৪২ আসনের মধ্যে কংগ্রেসের জেতা দু’টি আসন ‘ছেড়ে’ দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন মমতা। হাইকম্যান্ডের কাছে প্রদেশ কংগ্রেসের সর্বশেষ বক্তব্য, তারা আট-নয়টি আসনে ‘লড়ার জায়গায়’ আছে। এই অবস্থায় হাইকম্যান্ড রাজ্যের দলকে তৃণমূলের সঙ্গে আসন-রফার নির্দেশ দেবে কি না, দিলে তাদের এখনকার ‘বন্ধু’ সিপিএমের ভূমিকা কী হবে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।

এটাই দেখার— মমতা দেওয়ার হাত প্রসারিত করবেন, না কি কংগ্রেস চাওয়ার হাতটি গুটিয়ে নেবে? লক্ষণীয়, রাজ্যনেতাদের সঙ্গে আলোচনা কিন্তু রাহুল করছেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন