Sound

কোলাহলে বারণ নেই

শব্দ ব্রহ্ম বটে, কিন্তু তা যে গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে কাঁপিয়ে দিতে পারে, কলকাতা তার প্রমাণ। পুর-প্রশাসকদের উদাসীনতা আর বাঙালির সশব্দ শব্দ-ভজনাই তার কারণ, বললে অত্যুক্তি হবে কি?

Advertisement

অরবিন্দ সামন্ত

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৩ ০৫:০৫
Share:

—প্রতীকী ছবি।

দেশে এমন অনেক শহর আছে যেখানে যানজট কলকাতার চেয়েও ঢের বেশি। দিনের ব্যস্ত সময়ে অজস্র অটো, ক্যাব, প্রাইভেট কার, বাস শোঁ-শাঁ দৌড়য়, মাঝেমধ্যেই আটকায় যানজটে বা সিগন্যালে। কিন্তু কলকাতার পথের পাঁচালির সঙ্গে এ সব শহরের যান চলাচলের একটা বড় তফাত আছে, এই শহরগুলিতে যানজটও সুস্থির, নীরব। কারও মুখে কথা নেই, নেই চোখেমুখে অকারণ উদ্বেগ, অভিযোগের তাপ-উত্তাপ, বিকট হর্নের জগঝম্প।

Advertisement

শব্দ ব্রহ্ম বটে, কিন্তু তা যে গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে কাঁপিয়ে দিতে পারে, কলকাতা তার প্রমাণ। পুর-প্রশাসকদের উদাসীনতা আর বাঙালির সশব্দ শব্দ-ভজনাই তার কারণ, বললে অত্যুক্তি হবে কি? হাতে একটা মোবাইল পেলে এ শহর আশেপাশে যে মানুষ আছে তা ভুলে যায়, প্রবল চিৎকারে চলে কথোপকথন। পাবলিক স্পেস-এর ধারণা বা কাণ্ডজ্ঞান তার নেই, যেন গল্প করছে বৈঠকখানায় বসে। ইদানীং অনেক কলকাতাবাসী বেছে নেন নগরের উপান্তে বহুতল আবাসনের ঠিকানা, সেখানেও কি মেলে নৈঃশব্দ্য, মনোরম অবসর, সারিবদ্ধ সবুজের সুখসংলাপ? বরং উল্টোটা— বাসের হর্ন, বাইকের অন্তর-কাঁপানো আওয়াজ, ট্রাকের দাবড়ানি, পথচারী আড্ডাবাজ-দলের সরব জটলায় নরক গুলজার।

বাঙালি কি অকারণ শব্দের সাধক? শব্দ না করে, না শুনে তার সময় কাটে না? শোকসভায় এক মিনিটের নীরবতা পালনের মধ্যেও শোনা যায় চেয়ার টানার ঘড়ঘড়, খুকখুক গলাখাঁকারি। একদা দু’টি মানুষের প্রেমেরও ভাষা ছিল সলাজ নীরবতা, আজ তারও জায়গা নিয়েছে প্রদর্শনমূলক কথামালা, উচ্চকিত ভাষণ। মানুষের শ্রুতিসীমা অতিক্রম করে বিবিধ শব্দ আমাদের চার পাশে গমগম করছে। শব্দদূষণ মূলত দু’ধরনের, মানবসৃষ্ট আর প্রকৃতির সৃষ্টি। প্রবল ঝড়বৃষ্টি বা বজ্রপাত রোজ ঘটে না, অন্য দিকে মানুষের তৈরি শব্দদূষণ ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। যেমন, শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত বড় বড় মেশিন, কমপ্রেসর, জেনারেটর, এগজ়স্ট ফ্যান, গ্রাইন্ডিং মিল। বিয়েবাড়ি, পার্টির নাচ-গান-বাজনা, পাব-ডিস্কোর কর্ণবিদারী ডিজে বক্স, হাট-বাজারের হাঁকডাক, এমনকি ধর্মনির্বিশেষে উৎসব-অনুষ্ঠানে শব্দের অত্যাচারও কম কোথায়! রাস্তায় যানবাহনের আওয়াজ, বাড়ির উপর দিয়ে উড়োজাহাজ, পাশে রেলগাড়ির ঝমঝম চলে যাওয়া দিনভর। সেতু, বাঁধ, বহুতল, স্টেশন, রাস্তা, ফ্লাইওভার তৈরির শব্দসর্বস্ব প্রকল্প। ঘরে থাকলে টিভি, মোবাইল, মিক্সার-গ্রাইন্ডার, প্রেশার কুকার, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ওয়াশিং মেশিন, এসি... শব্দের উৎসমুখ গুনে শেষ করা যাবে না। কলকাতার গাড়িচালকদের বদভ্যাস সিগন্যালে বা ট্র্যাফিক জটে আটকে থাকার সময় এগোনো যাবে না জেনেও তাঁরা প্রাণপণে হর্ন বাজান। আর কালীপুজো-দেওয়ালিতে শব্দবাজির কথা যত কম বলা যায়, মঙ্গল।

Advertisement

গবেষকরা বলেন, ফিসফিস করে কথা বললে ৩০ ডেসিবেল, সাধারণ কথোপকথন প্রায় ৬০ ডেসিবেল আর একটা মোটর সাইকেলের ইঞ্জিন প্রায় ৯৫ ডেসিবেল শব্দ সৃষ্টি করে। কেউ যদি দীর্ঘ সময় ধরে ৭০ ডেসিবেল শব্দ শুনতেই থাকেন, তবে তাঁর কানের দফারফা অবশ্যম্ভাবী। ৫৫ ডেসিবেল শব্দকে স্বাভাবিক বলে মান্যতা দেওয়া হয়েছে, বাড়ির সাধারণ শান্ত পরিবেশ, আবাসিক রাস্তা বা দু’টি মানুষের স্বাভাবিক কথোপকথনের সময় এই মাত্রা বজায় থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেল শব্দও একটি মানুষকে সাময়িক ভাবে, আর ১০০ ডেসিবেল শব্দ মানুষকে পুরোপুরি বধির করে দিতে পারে। তাদের নির্দেশিকায় আবাসিক এলাকার জন্য ৫৫ এবং ট্র্যাফিক-সঙ্কুল এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের জন্য ৭০ ডেসিবেল শব্দসীমা নির্ধারিত। এ দেশের কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের নির্দেশ অনুসারে নির্ধারিত শব্দমাত্রা আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ও রাতে ৪৫ ডেসিবেল, হাসপাতালের মতো ‘সাইলেন্স জ়োন’-এ দিনে ৫০ ও রাতে ৪০ ডেসিবেল। কিন্তু জাতীয় গ্রিন ট্রাইবুনাল-এর রিপোর্ট বলছে, কলকাতার বেশ কিছু অঞ্চলে দিনের তুলনায় রাতে শব্দদূষণ বেশি। রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্য দূষণ পর্ষদের অফিস এলাকায় দিনের বেলা শব্দের মাত্রা ৭৩ ও রাতে ৯৪ ডেসিবেল। হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকাতেও শব্দদূষণের মাত্রা বেশ চড়া, এমনকি রাতেও। বছর কুড়ি আগে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল, সাউন্ড লিমিটর ছাড়া মাইক বা বক্স বাজানো যাবে না। সে নিয়ম মানা হয়নি।

এর ফল হতে পারে মারাত্মক। গবেষকদের মতে শব্দ ও স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্কটি নেতিবাচক, শব্দদূষণের কারণে উচ্চ রক্তচাপ, শ্রবণ ও স্মরণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত, মানসিক অবসাদ হতে পারে। শিশু লাগাতার শব্দদূষণের মধ্যে বড় হলে তার স্মৃতিশক্তি হ্রাস, অমনোযোগের আশঙ্কা থাকে। ক্রমাগত চড়া শব্দের মধ্যে সময় কাটালে তা বাড়িয়ে তোলে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার হার, আগ্রাসী মনোভাব, অসামাজিক আচরণ। শব্দের ক্রমবর্ধমান প্রভাব দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশের শ্রবণশক্তি সারা জীবনের জন্য নষ্ট করে দিতে পারে।

বিশ্বের সবচেয়ে শব্দ-দূষিত শহর ঢাকা, তার পরেই ভারতের মোরাদাবাদ। রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ কর্মসূচির এক প্রতিবেদনে ৬১টি শব্দমুখর শহরের কথা বলা হয়েছে, সেই তালিকায় কলকাতা চোদ্দো নম্বরে। ভোট এলে শহর আরও শব্দসঙ্কুল হয়ে ওঠে। মিটিং-মিছিল, লাউডস্পিকার, বাজি বোমা আর বাইক বাহিনীর দৌলতে শব্দদানবের প্রতাপ যে ভাবে বাড়ছে, তাতে শব্দদূষণে বিশ্বে প্রথম হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন