Sri Ramakrishna

চিনিয়ে দেন সত্যের পথ

সারা জীবন অকৃত্রিম অকপট জীবনযাপন করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। মনের ভিতরে এক আর বাইরে আর এক হলে পছন্দ করতেন না তিনি। কারও সেই রূপ দেখলে রীতিমতো শাসন করতেন, সে যদি তিনি ‘ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট’ হন তবুও।

Advertisement

নীলোৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৪ ০৭:৫১
Share:

শ্রীরামকৃষ্ণ। —ফাইল চিত্র।

সত্য কথা কলির তপস্যা’। আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে, যা দেখছি তা-ও যখন সত্য নয় বলে জানতে পারছি, তখন অনুধাবন করা যায় শ্রীরামকৃষ্ণের এই ছোট্ট কথাটির সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য। হুগলি জেলার অখ্যাত দেরে গ্রামে যখন এক ব্রাহ্মণ স্রেফ মিথ্যা সাক্ষী দেবেন না বলে গ্রামচ্যুত হন, তাঁর পুত্র যে সত্যের সাধনে জীবন যাপনের উদাহরণ রেখে যাবেন, এতে আশ্চর্য হই না আমরা। বরং বেশ বুঝতে পারি, আজকের জীবনে মিথ্যার খোসা ছাড়িয়ে সত্যকে চিনে নেওয়াই তপস্যা, বা তার মতো কঠিন।

Advertisement

সারা জীবন অকৃত্রিম অকপট জীবনযাপন করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। মনের ভিতরে এক আর বাইরে আর এক হলে পছন্দ করতেন না তিনি। কারও সেই রূপ দেখলে রীতিমতো শাসন করতেন, সে যদি তিনি ‘ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট’ হন তবুও। যখন তিনি গদাধর চট্টোপাধ্যায় মাত্র, শ্রীরামকৃষ্ণ হননি, তখন অগ্রজ পণ্ডিত দাদার কথাতেও রানি রাসমণির অমন রাজকীয় মন্দির প্রতিষ্ঠার আয়োজনে অন্নগ্রহণ করেননি। নিজে দু’পয়সার মুড়ি-মুড়কি কিনে খেয়েছেন। এ কথা স্বীকারও করছেন নিজের মুখে। কখন? যখন সাধনা সম্পূর্ণ করে, সেই সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বাস করেছেন রানির সত্ত্বগুণময় অন্তঃ-ভাবকে, তখন।

উনিশ শতকের নবজাগরণ-স্নাত বাংলার নক্ষত্রেরা তখন তাঁর কাছে আসছেন। তাঁদের কাছে তিনি না-ই বলতে পারতেন, কমবয়সে স্মার্ত ব্রাহ্মণের সংস্কারবশে ‘কৈবর্তের মন্দির’-এ অন্নগ্রহণ করেননি। কিন্তু তিনি যে অ-কপট। ভক্ত অধরের বাড়িতে বলছেন ব্যভিচারিণী ভক্তি আর অব্যভিচারিণী ভক্তির কথা। প্রেমাভক্তি হল অব্যভিচারিণী ভক্তি, জ্ঞানমিশ্রা ভক্তিকে বলছেন ব্যভিচারিণী ভক্তি। উদাহরণও দিয়েছেন— দুঃখ করে ভক্তদের কাছে বলছেন, দ্বারকায় রাধাকে মানে না, শুধু কৃষ্ণকে মানে। জ্ঞানমিশ্রা এই ভক্তিকে তিনি ‘হীন’ বলছেন, উপরে রাখছেন বৃন্দাবনের গোপিনীদের রাগানুগা প্রেমাভক্তিকে। মথুরায় গিয়ে পাগড়ি পরা কৃষ্ণকে দেখে যে গোপিনীরা বলেন, ইনি কে, ইনি তো আমাদের অচেনা! এঁর সঙ্গে কথা বলে কি ব্যভিচারিণী হব? আমাদের সেই বৃন্দাবনের গোপবালক কৃষ্ণ কই?

Advertisement

নিজের ইষ্ট, নিজের মত-পথই শ্রেষ্ঠ, এমন বুদ্ধিকে ‘পাটোয়ারি বুদ্ধি’ বলছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। পাট বিক্রেতা নিজের গাঁটের পাটকে শ্রেষ্ঠ বলবে, এ-ই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর উপদেশ, নিজের ইষ্টের প্রতি অব্যভিচারিণী ভক্তি থাকবে, কিন্তু অন্য ধর্মমতের ভক্তদের সঙ্গে মিষ্টকথা কইবে, মধুর ভাবে কথা কইবে। কলকাতা থেকে ছ্যাকরাগাড়িতে দক্ষিণেশ্বরে ফেরার সময় তাই চিৎপুরের পুরনো মসজিদের সামনে সন্ধ্যায় ইমামসাহেব পশ্চিমাকাশের দিকে চেয়ে ইবাদত করছেন দেখে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে তাঁকে আলিঙ্গন করেন তিনি।

সত্য হিসাবে সাধনলব্ধ যা-ই পেয়েছেন, তাকে জানিয়েছেন সহজ স্পষ্ট ভাষায়। সব মত ও পথ নিজে পেরিয়ে এসে তবেই নিন্দা করেছেন বামাচারী ও কর্তাভজাদের, আবার বৈষ্ণব মতের জীবে ‘দয়া’কে মোড় ফিরিয়ে দিয়েছেন ‘সেবা’য়। ব্রাহ্ম প্রার্থনায় সগুণ ব্রহ্মের ঐশ্বর্য বর্ণনা শুনে বলছেন, এ যেন বাবু আর বাবুর বাগান। সকলে বাবুর বাগান দেখতে চায়, ক’জন আর বাবুকে চায়! নিরাকারবাদী ভক্তকে শুরুতেই বলে দিচ্ছেন যে নিরাকার ভাল, তবে এটি ভেবে বোসো না যে কেবল এটিই সত্য, এর বিপরীতে সাকার সাধনাও একই রকম সত্য।

ভোগবাদী মানসিকতাকে কশাঘাত করেছেন বার বার। কিন্তু সংসারীকে বলছেন সঞ্চয় করতে— লক্ষ্মীছাড়া হওয়ার থেকে কৃপণ হওয়া ভাল। আবার কৃপণ ভক্ত ছোট ছোট বাটিতে খাবার দিচ্ছে দেখে বলছেন, আমি কি কাকাতুয়া পাখি যে ঠুকরে ঠুকরে খাব? ভোক্তা সামান্য ভোজ্য গ্রহণ করলেও তাঁকে সম্মাননীয় আহার্য পরিবেশন কর্তব্য। রাখালকে (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) বলছেন কখনও পরের চাকরি, গোলামি না করতে; আবার প্রতাপের ভাই স্ত্রী-পুত্র ফেলে দক্ষিণেশ্বরে এলে তাঁকে তীব্র ভর্ৎসনায় ফেরত পাঠাচ্ছেন সংসারধর্ম পালন করতে।

শ্রীরামকৃষ্ণের যে কোনও কথাকে তাই প্রবাদ-গল্পের ‘অন্ধের হাতি দেখা’র মতো করে দেখলে চলে না। তাঁর সমস্তটা জানলে তবেই তাঁকে বোঝা সহজ হয়। তিনি নিজেও ভক্তদের বলেছেন তাঁকে যাচাই করে নিতে; বলছেন, “সাধুকে দিনে দেখবি, রাতে দেখবি, তার পরে বিশ্বাস করবি।” তাঁর প্রিয় নরেন্দ্র হোটেলে অখাদ্য-কুখাদ্য খায়, আচারসর্বস্ব এক শিষ্যের এ-হেন অনুযোগে বলেছেন ‘আধার’-এর কথা: তুই যদি হবিষ্যি খাস আর নরেন্দ্র যদি হোটেলেও খায়, তাও নরেন্দ্রর সমকক্ষ তুই হবি না। কখনও সংসারীর মুশকিল আসান গুরুবাবা সাজার চেষ্টা করেননি, বরং সংসারীদের বার বার বলেছেন— এক হাতে ঈশ্বরকে ধরে থেকে আর এক হাতে সংসার করতে। মাঝে মাঝে নির্জনবাস, আর সংসারের কাজ শেষ হলে দু’হাতে ঈশ্বরকে ধরা, এ-ই হল পন্থা। মানুষের ভিতরের শক্তি-সামর্থ্য বুঝে সেই মতো তাকে জীবনের পথে, বৈরাগ্য বা কর্তব্যের পথে এগিয়ে দেওয়া— এই ‘প্র্যাগম্যাটিজ়ম’-এর প্রতিমূর্তি তিনি। একুশ শতকের এই উত্তর-সত্যপীড়িত সময়েও অমোঘ গন্তব্য, সারা জীবন চিনিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সত্যের পথটি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন