যা নিয়ে গর্ব করা যেত, তাকেই লজ্জার বিষয় করে তোলা হল
Education

ঐতিহ্যের নামে কুসংস্কার

সমস্যা শুরু ২০১৪ সালেই, তবে ২০২০ সালে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর ব্যাপারটার গুরুত্ব অনেকটাই বেড়ে গেছে।

Advertisement

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:১৩
Share:

ছবি: সংগৃহীত।

যে বিষয় নিয়ে গর্বিত হওয়া যায়, পাকেচক্রে তাও যে কতখানি বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠতে পারে, (প্রাচীন) ভারতীয় জ্ঞানধারা (ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম বা আইকেএস) নিয়ে সাম্প্রতিক সরকারি আস্ফালন দেখলে সেটা টের পাওয়া যায়। প্লাস্টিক সার্জারির নিদর্শন হিসাবে গণেশের মাথা, স্টেম সেল পদ্ধতির প্রমাণ গান্ধারীর শতপুত্র, টেস্ট-টিউব বেবির জন্ম (কর্ণ), পুষ্পক রথকে বিমান চলাচলের প্রযুক্তি হিসাবে দেখা, সঞ্জয়ের দেওয়া কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ধারাবিবরণীকে আন্তর্জালের ব্যবহারের নিদর্শন বলে দাবি করা— সবই যে ‘ব্যাদে আছে’, কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী-সেনাপতিদের উৎসাহে সে কথা যত বার ঘোষণা করা হয়, তত বারই বিজ্ঞানসচেতন মানুষের মাথা নিচু হয়ে যায়। ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যটিই বারংবার লজ্জিত হয়, যেন আধুনিক প্রজন্মকে গর্বিত করার মতো কিছু তার আসলেই ছিল না।

Advertisement

সমস্যা শুরু ২০১৪ সালেই, তবে ২০২০ সালে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর ব্যাপারটার গুরুত্ব অনেকটাই বেড়ে গেছে। প্রণেতাদের ভাষায়, এই শিক্ষানীতি হল ‘প্রাচীন ও সনাতন ভারতের সমৃদ্ধ জ্ঞান ও পরম্পরার আলোয় আলোকিত’ এবং এই জ্ঞানকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে নতুন ভাবে আবিষ্কার করা হল এই শিক্ষানীতির একটা উদ্দেশ্য। অবিলম্বেই এই উদ্দেশ্য নিয়ে দেশের কারিগরি শিক্ষার ভারপ্রাপ্ত সংস্থা এআইসিটিই-র তত্ত্বাবধানে ভারতীয় জ্ঞানধারার চর্চার উপরে একটি বিশেষ সেল চালু হয়, বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার শাখা খোলা হয় এবং আইকেএস-এর উপর গবেষণা বাধ্যতামূলক করে তোলা হয়। অতঃপর মহাসমারোহে ভারতের কাল্পনিক গৌরবময় অতীতকে তুলে ধরতে অতিসক্রিয়তা শুরু হয়ে যায়, প্রায় রোজই যার নতুন নতুন নমুনা পেশ হচ্ছে। যেমন, আগামী মাসে আইআইটি গুয়াহাটিতে ‘গো-বিজ্ঞান’ নিয়ে আলোচনাচক্র আহ্বান করা হচ্ছে; এমস-এর ডাক্তার ‘গর্ভসংস্কার’-এর সপক্ষে জোরালো সওয়াল করছেন ইত্যাদি। ২০১৪ সালে যে সাংসদ জ্যোতিষ-শাস্ত্রের বৈজ্ঞানিক যথার্থতা দাবি করেছিলেন, তিনিই পরে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হন এবং জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেন। তাই ২০১৪ থেকে ২০১৯ অবধি ক্রমাগত ছড়িয়ে যাওয়া মণিমুক্তোগুলো, যেমন পঞ্চগব্যের উপকারিতা (২০১৬, আইআইটি দিল্লি), বৈদিক যুগের বিমান যা গ্রহান্তরে পাড়ি দিতে পারে (জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস, ২০১৫) ইত্যাদিকে এ বার যে পাকাপোক্ত ভাবে গেঁথে ফেলা হবে, সেটা প্রত্যাশিত।

আইকেএস বিষয়ে কী ভাবে শিক্ষা দেওয়া হবে, তা নিয়ে সম্প্রতি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার চূড়ান্ত নির্দেশিকাও প্রকাশ করেছে ইউজিসি। নির্দেশিকা অনুযায়ী ছাত্রদের গণিতের সঙ্গে বেদাঙ্গ জ্যোতিষ, জীবপদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে আয়ুর্বেদ, চিকিৎসা-শাস্ত্রের সঙ্গেও আয়ুর্বেদ, যোগ, ইউনানি ইত্যাদি পড়াতে হবে, এই সব বিষয় সংক্রান্ত ঐচ্ছিক পাঠ্যক্রম নিতে উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষকদের এর উপরে ‘রিফ্রেশার্স কোর্স’ করতে হবে, যাতে তাঁরা আইকেএস বিষয়ে জ্ঞানী হয়ে ওঠেন।

Advertisement

এক-একটা মিথ্যা কথা শুনতে শুনতে সত্যি হয়ে ওঠে। এখানে তো মিথ্যা কথা অনেক। প্রথমত, ভারতীয় জ্ঞানধারার নাম করে যে সব কথা ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলির কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা বা প্রমাণ তো নেই-ই, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও নেই। রামায়ণ-মহাভারতকে প্রামাণ্য বলে ধরলে তো টাইম ট্র্যাভল আর স্টার-ওয়র’কেও সত্য বলে ধরে নিতে হয়।

দ্বিতীয়ত, প্রাচীন ভারত বলতে শুধুমাত্র বৈদিক যুগকেই প্রচার করা হচ্ছে। যাবতীয় বৈজ্ঞানিক প্রমাণকে (যেমন রেডিয়ো-কার্বন ডেটিং) গোল্লায় পাঠিয়ে সভ্যতার যাবতীয় নিদর্শনকে ইচ্ছেমতো গিলে ফেলা অথবা অস্বীকার করা হচ্ছে। প্রয়োজনে বৈদিক যুগের সময়কাল দশ হাজার বছর পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া (আসলে মাত্রই খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ পর্যন্ত) হচ্ছে, যাতে উন্নতির যাবতীয় চিহ্নগুলোকে বৈদিক যুগের বলে দাবি করা যায়। পাশাপাশি, বদলে ফেলা হচ্ছে ইতিহাস। ইস্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে মোগল অধ্যায় বাদ গিয়েছে, গিয়েছে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বও।

সুতরাং, ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নামে এই মুহূর্তে যা যা চলছে, এক কথায় তা অর্থহীন, মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এক দিকে যেমন কাল্পনিক বিষয় এবং প্রাচীন সাহিত্যে উল্লিখিত বিষয়কে ‘সত্য’ বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে, অন্য দিকে বিজ্ঞান ও ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা হচ্ছে। এই সব কিছুর মূলে আছে হিন্দুত্ববাদ; ‘হিন্দু সভ্যতা’ হিসাবেই যে ভারত এক সময় বিশ্বে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, সে কথা প্রমাণ করার মরিয়া প্রয়াস।

এ সব কথা নতুন নয়। লেজওয়ালা বানরকে কেউ মানুষ হয়ে উঠতে দেখেনি তাই বিবর্তন তত্ত্ব ভুল, এ কথা আমরা বহু বার শুনেছি। গরুর নিঃশ্বাসে অক্সিজেন বা দুধে সোনা পাওয়ার কথাও শুনেছি। কিন্তু এখন এ সব কথা সরকারের ঘোষিত শিক্ষানীতির অংশ। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রকল্পটি ভারতীয় জ্ঞানধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাই আমাদেরও দু’টি কথা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। প্রথমত, বৈদিক বা প্রাক্-বৈদিক যুগে ভারত নামক দেশটির স্পষ্ট রাজনৈতিক সীমারেখা ছিল না। দ্বিতীয়ত, সর্বকালেই কিছু কিছু আবিষ্কার কিছু বিজ্ঞানীর নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও তার পিছনে জ্ঞানচর্চার দীর্ঘ ইতিহাস থাকে। অর্থাৎ, জ্ঞানধারা একটি সর্বব্যাপী দেশ-নিরপেক্ষ বিষয়, স্থানভেদে যার কিছু ঘরানা স্বীকৃত হলেও তার গায়ে কোনও দেশীয় ছাপ মারা যায় না।

প্রাচীন ভারতের নামে শুধু বৈদিক যুগ ও আর্য সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা এবং বহু প্রকার কুসংস্কারের চর্চাকে উৎসাহিত করাই হল ভারতীয় জ্ঞানধারার প্রবক্তাদের নিজস্ব ধারা। কিন্তু এই ভাবে ভ্রান্ত তথ্য ও ধারণার আমদানি করে ওঁরা আসলে ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারাটিকে কলঙ্কিত করছেন। কারণ, অপ্রয়োজনীয় সরকারি উদ্যোগ ছাড়াই প্রাচীন ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে এবং বৈজ্ঞানিক জার্নালে তা প্রকাশিত হয়েছে। ইন্টারনেটে খোঁজ করলেই সে সবের সন্ধান পাওয়া যাবে। যেমন, শুধু ‘শূন্য’-র ধারণা আর ‘বৈদিক গণিত’ই নয়, বরং জ্যামিতি ও বীজগণিতের অনেক জটিল তত্ত্ব ও ধারণাই যে নিহিত আছে বেদের নানা রকম সূত্রের গভীরে, সে কথা প্রকাশিত হয়েছে গবেষণায়। অতি সম্প্রতি (২০১৭-১৮) একটি বাখশালি পাণ্ডুলিপির সূত্র ধরে কিছু অত্যাশ্চর্য প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা থেকে বোঝা যায় প্রাচীন ভারতের গণিতচর্চা কতটা এগিয়ে ছিল। পাণিনির ব্যাকরণ, চরক ও সুশ্রুতের চিকিৎসা ও ভেষজবিজ্ঞান, নাগার্জুনের রসায়ন ইত্যাদি নিয়েও অনেক গবেষণা হয়েছে, যার সব কিছুই আসলে ভারতীয় জ্ঞানধারা চর্চার অংশ।

কিন্তু যা ছিল তা যত গর্বেরই হোক, তাই নিয়ে পড়ে থাকার কোনও যুক্তি নেই। কারণ, জ্ঞানধারা একটি বহতা বিষয়; প্রাচীন কালের এই জ্ঞানভান্ডার যত উন্নতই হোক, তাকে শেষ কথা বলে ধরা যায় না, কারণ জ্ঞান সেখানেই দাঁড়িয়ে নেই। মানুষ তাকে উত্তরোত্তর এগিয়ে নিয়ে চলেছে এবং আধুনিক যুগে তা বিশ্বব্যাপী জ্ঞানধারার সঙ্গে মিশে গেছে। তাই আজকের যুগে দাঁড়িয়ে আমরা প্রাচীন যুগের পদ্ধতিতে গণিত, রসায়ন বা পদার্থবিজ্ঞান পড়ি না, কারণ তাতে বিজ্ঞানের আধুনিকতর কাজগুলিকে অস্বীকার করা হয়, যা আসলে প্রগতির উল্টো দিকে হাঁটা। তাই কল্পনার উপরে ভিত্তি করে প্রাচীন জ্ঞানকেই শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার আসলে কোনও মূল্য নেই। আর তা যদি দেশের বর্তমান বিজ্ঞানচর্চাকে বিঘ্নিত করে (অনুদানে ভাগ বসিয়ে), এবং অপবিজ্ঞানের চর্চায় উৎসাহ জোগায়, তখন তা রীতিমতো অন্যায়।

চাপের মুখে সরকারকে ঘোষিত নীতিও প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে, সে উদাহরণ খুব অতীতকালের নয়। সে নীতি তো সমাজের একটামাত্র অংশকে ঘা দিয়েছিল; এই শিক্ষানীতি কিন্তু গোটা সমাজকেই আঘাত করতে চলেছে। এই আকালেও আমরা হয়তো বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারি, যদি ক্ষতিটা ঠিকঠাক বুঝতে পারি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন