‘সংখ্যালঘু তোষণ’-এর অভিযোগ আদৌ ধোপে টেকে কি
Religious Politics

বাস্তব পরিস্থিতি কী রকম

মুসলমানরা যেমন খারাপ আছে, হিন্দুরাও তেমন খুব ভাল নেই। বিদ্বেষের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার চেয়ে হিন্দুদের পক্ষেও উচিত কাজ হবে নিজেদের উন্নয়নের ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন করা।

Advertisement

শাশ্বত ঘোষ

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:৩৪
Share:

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

পশ্চিমবঙ্গে কি ‘মুসলমান-তোষণ’ হয়? ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, এ রাজ্যে জনসংখ্যার ২৭% মুসলমান। ২০২১-এ জনশুমারি হয়নি। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের অভিক্ষেপ অনুযায়ী, ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যার কম-বেশি ৩০% মুসলমান হতে পারে। যদি সত্যিই ‘তোষণ’ হয়ে থাকে, তা হলে এই ৩০ শতাংশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নাগরিক জীবনের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি মানব উন্নয়নের মাপকাঠি হয় বাকি ৭০ শতাংশের চেয়ে বেশি হবে, বা অন্তত সমান হবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতি কি তাই?

Advertisement

পঞ্চম জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষার (২০১৯-২১, পশ্চিমবঙ্গে সমীক্ষা হয়েছিল ২০১৯-এ) তথ্য অনুযায়ী, ৬-১৭ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের ৯০% স্কুলে যায়। হিন্দুদের মধ্যে সেই হার প্রায় ৯২%, আর মুসলিমদের মধ্যে প্রায় ৮৭%। কিন্তু, ১৬-১৭ বছর বয়সি হিন্দু ছেলেদের মধ্যে প্রায় ৭৩% স্কুলে যায়, মুসলমান ছেলেদের ক্ষেত্রে সেই হার মাত্র ৫৩.৩%। একই বয়সি হিন্দু ও মুসলমান মেয়েদের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ৭৮% ও ৭৬%। সামগ্রিক ভাবে ১৬-১৮ বয়সের ছেলেদের মধ্যে মাধ্যমিক পাশের হার ৫০ শতাংশের সামান্য বেশি; মেয়েদের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৬০%। ওই বয়সি হিন্দু ছেলেদের প্রায় ৬০% মাধ্যমিক পাশ করলেও মুসলমান ছেলেদের ক্ষেত্রে তা মাত্র ৩২%। ওই বয়সের হিন্দু ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে মাধ্যমিক পাশের অনুপাতে কার্যত কোনও ফারাক না থাকলেও মুসলমান ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ফারাক রয়েছে— ছেলেদের চেয়ে প্রায় ৮ শতাংশ-বিন্দু বেশি মেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে। ১৬ বছরের পরে স্কুলছুটের অনুপাত এত বেড়ে যাওয়া, বিশেষত মুসলমানদের মধ্যে— সে কারণেই কি এই রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিক এত বেশি?

শিশুমৃত্যুর হার মানব উন্নয়নের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূচক। উল্লিখিত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, এই সমীক্ষার আগের পাঁচ বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে বছরে ১০০০ শিশু জন্মালে ২২টি শিশু এক বছরের আগে মারা যায়। এই সংখ্যাটা হিন্দুদের মধ্যে প্রায় ২০ হলেও মুসলিমদের মধ্যে প্রায় ২৭। মহিলাপিছু জন্মহারে কিন্তু তেমন ফারাক নেই— হিন্দু মহিলাদের ক্ষেত্রে তা প্রায় ১.৫, আর মুসলমানদের ক্ষেত্রে ২.০। শিশুমৃত্যুর দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিবাহ, এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব কম হওয়া। নাবালিকা বিবাহে পশ্চিমবঙ্গ সারা ভারতে শীর্ষস্থানের অধিকারী— এখানে ৪১.৬% কিশোরীর ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। হিন্দু ও মুসলমান কিশোরীদের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ৪০ ও ৪৫ শতাংশের বেশি। ১৬ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায় ১৯% কিশোরীর। হিন্দুদের মধ্যে এই হার ১৮%, মুসলমানদের মধ্যে ২১ শতাংশের বেশি। উপরে শিক্ষার যে দুর্দশার কথা আলোচিত হয়েছে, বিশেষত ছেলেদের স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা, সেটি কিশোরী বিবাহের অন্যতম কারণ কি না, ভাবা প্রয়োজন।

Advertisement

প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার হিন্দুদের মধ্যে ৯৫% হলেও মুসলমানদের মধ্যে ৮৬%। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সি শিশুমৃত্যুর হার প্রতি ১০০০ শিশুতে হিন্দুদের মধ্যে ২২, আর মুসলমানদের মধ্যে ৩১। দীর্ঘকালীন অপুষ্ট শিশুর অনুপাত হিন্দুদের মধ্যে প্রায় ৩২%, মুসলমানদের মধ্যে ৩৭%।

২০২০ সালের ৭৮তম জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নলবাহিত জলের সুবিধা আছে ৩৭.৫% হিন্দু পরিবারে, মুসলমানদের ক্ষেত্রে অনুপাতটি মাত্র ১৯.৭%। উন্নত মানের শৌচাগারের সুবিধা ভোগ করে প্রায় ৬৬% হিন্দু পরিবার; মুসলমানদের ক্ষেত্রে অনুপাতটি ৬০%। ৪২.৩% হিন্দু পরিবারে এলপিজি সংযোগ আছে; মাত্র ২২.৪% মুসলমান পরিবার এই সুবিধা ভোগ করে। এই সমীক্ষারই ৭৬তম রাউন্ডের (২০১৮ সালের) তথ্য অনুযায়ী ৬৭.৬% মুসলমান পরিবারের কোনও নিকাশি ব্যবস্থা নেই, যেখানে হিন্দু পরিবারের প্রায় ৫০ শতাংশের এই সুবিধা আছে। আচ্ছাদিত পাকা নিষ্কাশন ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গে এমনিতেই খুব কম— হিন্দু পরিবারের মধ্যে মাত্র ১৭.৬ শতাংশের এই সুবিধা আছে, মুসলমান পরিবারের ক্ষেত্রে অনুপাতটি অর্ধেকেরও কম।

পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (পিএলএফএস)-র সাম্প্রতিকতম রাউন্ডের (২০২২-২৩) তথ্য বিশ্লেষণ করে কর্মসংস্থানের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গের ২৫ শতাংশেরও বেশি হিন্দু পরিবারের অন্তত এক জন সদস্য মাসমাইনের চাকরি করেন; মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ১৭ শতাংশেরও কম। দিনমজুরি করে সংসার চালান, এমন পরিবার হিন্দুদের মধ্যে ২২ শতাংশের কাছাকাছি হলেও, মুসলমানদের মধ্যে তা ৩০ শতাংশেরও বেশি। স্বনিযুক্ত পারিবারিক পেশাতে যুক্ত, এমন পরিবারের অনুপাত দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তুল্যমূল্য (৪৮-৪৯ শতাংশ)। পরিবারের মাথাপিছু গড় মাসিক ব্যয়— যা পরিবারের মাসিক আয়ের একটা সূচক— দেখলে স্পষ্ট হয় যে, দিনমজুরি ছাড়া অন্য দু’টি ক্ষেত্রেও মুসলমান পরিবারগুলি হিন্দুদের চেয়ে বেশ পিছিয়ে আছে। মাসমাইনের চাকরি করা একটি হিন্দু পরিবারে মাথাপিছু গড় মাসিক ব্যয় যেখানে ৩৯৪৬ টাকা, মুসলমান পরিবারে তা ২৭৬১ টাকা— মাথাপিছু প্রায় ১২০০ টাকার পার্থক্য। স্বনিযুক্ত পেশাতে এই পার্থক্য প্রায় ৪০০ টাকার মতো— হিন্দু পরিবারে মাথাপিছু ব্যয় ৩০৫৬ টাকা, মুসলমান পরিবারে ২৬৭৩ টাকা।

যদি ব্যক্তিগত প্রধান পেশার দিকে তাকাই, তা হলে দেখব যে, হিন্দুদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি কর্মী পরিষেবা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত, সেখানে মুসলমানদের ক্ষেত্রে অনুপাতটি ৪৬%। হিন্দুদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি কর্মী কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত, সেখানে মুসলমানদের ক্ষেত্রে অনুপাতটি প্রায় ২৮%। শিল্পক্ষেত্রে মুসলমান কর্মীদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি (২৫.৫%) হিন্দুদের চেয়ে (১৫.৬%)। কেবলমাত্র স্বনিযুক্ত পেশার দিকে তাকালে দেখব যে, ১০ জন হিন্দুর মধ্যে চার জন কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত, চার জন পরিষেবা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত, এবং বাকিরা শিল্পক্ষেত্রে কর্মরত। ১০ জন স্বনিযুক্ত শিল্পকর্মী মুসলমানের মধ্যে আট জনেরও বেশি বিড়ি বাঁধা এবং বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত, যেখানে আয় অনেকটাই কম। এক জন মুসলিম স্বনিযুক্ত শিল্পকর্মী মাসে যেখানে ৩৫৭৪ টাকা আয় করেন, সেখানে এক জন হিন্দু স্বনিযুক্ত শিল্পকর্মী মাসে ৪০০৯ টাকা আয় করেন। পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আয়ের এই বৈষম্য আরও বেশি— প্রায় ৯০০ টাকা। অন্যতম উল্লেখ্য বিষয় হল, হিন্দুদের মধ্যে ৭২.৩% কর্মীর কোনও সামাজিক নিরাপত্তা নেই; মুসলমানদের মধ্যে অনুপাতটি ৯২.৪%।

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নাগরিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা, কর্মসংস্থান ও কাজের পরিবেশের একটা সামগ্রিক ঘাটতি রয়েছে। উপরন্তু, উল্লিখিত কোনও মাপকাঠিতেই মুসলমানরা হিন্দুদের চেয়ে ভাল অবস্থায় নেই, বরং বেশ খানিকটা পিছিয়ে আছে। ২০০৬ সালে সাচার কমিটি রিপোর্ট চোখে আঙুল দিয়ে এ রাজ্যের মুসলমানদের পশ্চাৎপদতাকে দেখিয়ে দিয়েছিল। সেটা তৎকালীন রাজ্য সরকারের যথেষ্ট অস্বস্তির কারণ হয়েছিল। কিন্তু সেই সমস্যার সমাধানে বিগত বা বর্তমান, কোনও জমানাতেই তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। মুসলমানদের অবস্থা যে গত দেড়-দুই দশকে উন্নত হয়নি, তা উপরোক্ত পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট। হজ হাউস বানানো বা মুয়াজ্জিম ভাতা প্রদান মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক উন্নতির কোনও মাপকাঠি হতে পারে না। তাই ‘তোষণ’-এর অভিযোগ ধোপে টেকে না।

মুসলমানরা যেমন খারাপ আছে, হিন্দুরাও তেমন খুব ভাল নেই। বিদ্বেষের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার চেয়ে হিন্দুদের পক্ষেও উচিত কাজ হবে নিজেদের উন্নয়নের ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন করা।

গবেষণা সহায়তা: দিব্যেন্দু বিশ্বাস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন