এই জমানায় ‘জনমোহিনী বাজেট’-এর অর্থ উল্টে গিয়েছে
Unorganised Sector

উন্নয়নের বাইরে যাঁরা

কাজে বড় না হয়ে কথায় বড় হওয়ার পাঠ দিতে পারে এই বাজেট। ভূমিকাতেই বলা হয়েছে, দেশের সমস্ত অঞ্চলে, সমাজের সমস্ত স্তরে পৌঁছে দেওয়া হবে উন্নয়নের ফল।

Advertisement

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:৪১
Share:

আর্থিক বৃদ্ধির সম্পূর্ণটাই হয়েছে সংগঠিত ক্ষেত্রে। ফাইল চিত্র।

“মনে আছে সেই পুরনো খেলাটা? আমি যেটা দেখি তুমি কি দেখো তা?”

Advertisement

শঙ্খ ঘোষ, ‘গাজর’, শুনি শুধু নীরব চিৎকার

মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, অসাম্য, ক্ষুধা— কাগজ যাঁরা পড়েন, তাঁরাই জানেন যে, দেশের অর্থনীতির মূল সমস্যা এখন এগুলোই। তবু, এ বছরের বাজেট-ভাষণ বা আর্থিক সমীক্ষার রিপোর্ট যেন বলছে, এ সব সঙ্কটের কল্পনায় যাঁরা ম্রিয়মাণ, তাঁরা নেহাতই নিন্দুক। ‘অমৃত কাল’ সমাগত, অচিরেই উন্নত দেশ হয়ে উঠবে ভারত। বস্তুত, বাজেট-ভাষণের আগেই প্রধানমন্ত্রী সে অঙ্গীকার করেছেন দেশবাসীর কাছে।

Advertisement

অথচ একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে, আর্থিক বৃদ্ধির সম্পূর্ণটাই হয়েছে সংগঠিত ক্ষেত্রে। আর, বিপুলসংখ্যক মানুষ যে-হেতু অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গেই যুক্ত, ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ বা সর্বজনীন বৃদ্ধির যে কুমিরছানাটি নির্মলা তাঁর ভাষণে বার বার দেখালেন, তা প্রকৃতপক্ষে অধরাই থেকে গিয়েছে।

কাজে বড় না হয়ে কথায় বড় হওয়ার পাঠ দিতে পারে এই বাজেট। ভূমিকাতেই বলা হয়েছে, দেশের সমস্ত অঞ্চলে, সমাজের সমস্ত স্তরে পৌঁছে দেওয়া হবে উন্নয়নের ফল। বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া হবে দলিত, জনজাতি, মহিলা এবং কৃষকদের উপরে। এত কিছু সত্যি সত্যি করতে হলে সরকারের খরচ যে হারে বাড়াতে হত, বাস্তবে তার তিলার্ধই বেড়েছে। বিগত অর্থবছরের সংশোধিত হিসাব অনুযায়ী যা খরচ হয়েছে, এই অর্থবছরে তার উপরে মাত্র ৭ শতাংশ বাড়তে চলেছে সরকারের মোট খরচ। টাকার অঙ্কে জাতীয় আয়ের (নমিনাল জিডিপি) বৃদ্ধির হার এর চেয়ে অনেকটাই বেশি হবে বলে দাবি করা হয়েছে। আবার সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয় আটকে রয়েছে মোট ব্যয়ের ২৫ শতাংশের আশপাশে। কাজেই, এক পয়সার তৈলের বাড়তি বরাদ্দ কারও দাড়িতে ঢালাও দেওয়ার পরে অন্যের গায়ে মাখাতে গেলে প্রকৃতির নিয়মেই টানাটানি হবে।

বরাদ্দ কমেছে একশো দিনের কাজে। চলতি অর্থবছরের ৮৯,৪০০ কোটি থেকে কমে তা হয়েছে ৬০,০০০ কোটি টাকা। অথচ সাম্প্রতিক কালে বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে একশো দিনের কাজের চাহিদা প্রবল ভাবে বেড়েছে গ্রামাঞ্চলে। চেয়েও কাজ পাননি বহু মানুষ— একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি দশ জনে চার জন— এঁদের বিপুল অংশ মহিলা। কাগজে যাকে ‘ওয়াকিবহাল মহল’ বলা হয়, তার দাবি ছিল, এই খাতে বরাদ্দ অনেকখানি বাড়ানো হোক। তাতে কর্ণপাত না করে এই বাজেটে উল্টো রাস্তাতেই হাঁটল মোদী সরকার।

অতিমারির আগে জাতীয় আয়ের ২ শতাংশেরও কম খরচ করা হত স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। ২০২১-২২’এ তা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ২.২ শতাংশ, এ বারের বাজেটে তা ২.১ শতাংশ। সরকারপক্ষের তরফে অতিমারি-উত্তর এই বৃদ্ধি নিয়ে প্রচুর ঢক্কানিনাদ শোনা গেলেও এখনও পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের তুলনায় ভারতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয়ের এই হার লজ্জাজনক। শিক্ষাক্ষেত্রেও খরচ হয় জাতীয় আয়ের ৩ শতাংশের কম। অনেক কাল যাবৎ হিসাবটি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ বছরের আর্থিক সমীক্ষা শিক্ষায় প্রভূত উন্নতির কথা বললেও প্রথম নামক অসরকারি সংস্থার সাম্প্রতিক অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট (রুরাল) দেখিয়েছে যে, পঞ্চম শ্রেণিতে দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্য পড়তে পারছে না অর্ধেকের বেশি শিশু।

বিজেপির মহিলা নেতারা ‘অমৃত কাল’-এর বাজেট অধিবেশনে মহিলা রাষ্ট্রপতি এবং মহিলা অর্থমন্ত্রীর ছবি টুইট করেছেন। লিখেছেন, নারী-ক্ষমতায়নের এক নতুন স্বর্ণযুগের সূচনা হল। নির্মলার ভাষ্যেও বারে বারে এসেছে মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথা। আর্থিক সমীক্ষা দাবি করেছে যে, লিঙ্গসাম্য সূচকের নিরিখে পৃথিবীর গড়ের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে দেশ। মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, ‘মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা এবং পরিসংখ্যান’। এই বাক্যাংশ বর্তমান পৃথিবীর গণবিতর্কে বার বার ফিরে আসে গানের ধুয়োর মতো। তথ্যকে বিকৃত করে বা আংশিক ভাবে উপস্থাপিত করে মিথ্যাচার করার তেমনই নজির শেষ কয়েক বছরের আর্থিক সমীক্ষা। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, লিঙ্গসাম্য সূচকের নিরিখে ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৩৫তম।

কেন্দ্রীয় সরকারের বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং-এ এগিয়ে থাকার নেশা সুবিদিত। হরেক রকম সূচক ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশকে বছর বছর লিগ-সারণিতে সাজায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। তেমনই এক সূচক বিশ্ব ক্ষুধা সূচক বা গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্স। সেই সূচকে ডাহা ফেল করে, এমনকি পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে ভারী গোসা হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের। সূচকটি নিয়ে বিতর্কের যথেষ্ট অবকাশ থাকলেও এর মধ্যে রয়েছে শিশুদের অপুষ্টির তথ্য, যা পাওয়া গিয়েছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় করা সমীক্ষাতেই। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার বিভিন্ন রাউন্ড দেখিয়েছে যে, আফ্রিকার বহু দরিদ্র দেশের তুলনায় ভারতে শিশু-অপুষ্টি বেশি। ২০০৫-০৬’এর সমীক্ষার পরে প্রবল চাপের মুখে পড়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সংসদকক্ষে দাঁড়িয়ে স্বীকার করেন, শিশুদের অপুষ্টি জাতীয় লজ্জা। ফি-বছর বিশ্ব ক্ষুধা সূচক প্রকাশিত হওয়ার পর এই সরকার তা উড়িয়ে দেয়। সূচকের নানা গোলমাল তুলে ধরে আসল বিষয়টিকে গুলিয়ে দেয়। সরকারপক্ষের বয়ান শুনলে মনে হয়— ক্ষুধা, অপুষ্টি সবই এই ‘অমৃতকাল’-এ কষ্টকল্পনামাত্র।

একই সুরে আর্থিক সমীক্ষা সগৌরবে খাদ্য সুরক্ষার পাশাপাশি পুষ্টি সুরক্ষার কথা বলে, লজ্জিত হয় না। এখনও ভারতে পাঁচ জনে এক জন শিশু ‘ওয়েস্টেড’— উচ্চতার নিরিখে তাদের ওজন কম। বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম ৩৫ শতাংশ শিশুর, তারা ‘স্টান্টেড’। শেষ কয়েক বছরে ওয়েস্টিং বা স্টান্টিং, কোনওটিই আশানুরূপ ভাবে কমেনি। অপুষ্টি কমানোর লক্ষ্যে মূল সরকারি প্রকল্প আইসিডিএস। দেশ জুড়ে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের আশাকর্মীদের কাঁধেই ন্যস্ত হয়েছে এই গুরুদায়িত্ব। তাঁরা ‘স্বেচ্ছাসেবী’— বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকারটুকুও তাঁদের নেই। ‘সক্ষম অঙ্গনওয়াড়ি’ ও ‘পোষণ টু পয়েন্ট ও’-র মতো গেরামভারী শব্দে ঠাসা হলেও এই বাজেট মহিলা ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের জন্য বরাদ্দ সামান্যই বাড়িয়েছে। বরাদ্দ কমেছে মিড-ডে মিলের খাতেও।

করের হারে পরিবর্তন হওয়ায় মধ্যবিত্তর খানিক স্বস্তি মিলেছে নির্বাচনের আগে। অন্য দিকে, বেনজির ভাবে করের হার কমেছে ধনীতম অংশের। নির্বাচনের মুখে জনমোহিনী বাজেটের চেহারা কেমন হতে পারে, সেই ধারণাটাই আসলে উল্টে গিয়েছে আস্তে আস্তে। দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ অনেকটা বাড়ানো, পেট্রল-ডিজ়েলে করছাড়, সাধারণের ভোগ্য বস্তুর উপরে শুল্কে ছাড়, এবং বণ্টন-কাঠামোয় বড়সড় পরিবর্তন— এমন বাজেট হয়তো দেশের বর্তমান রাজনীতি-অর্থনীতিতে আশাই করা যায় না। দিনকয়েক আগেই অক্সফ্যাম-এর সারভাইভাল অব দ্য রিচেস্ট নামক রিপোর্ট দেখিয়েছে যে, ধনী-দরিদ্রের ফারাক এ দেশে আকাশচুম্বী। উন্নয়নচর্চার দিকপালেরা বার বার মনে করিয়ে দেন, অসাম্য আসলে একটি রাজনৈতিক চয়ন। বাজেট-ভাষ্য তারই স্বাক্ষর বয়ে চলে।

এই জমানার চারিত্রিক বিশেষত্ব তার বাগাড়ম্বর— ঠাহর করে দেখতে হয় সরকারি নথি, না মাধ্যমিকের রচনা বই। নির্মলার ভাষণে ‘ইনক্লুসিভ ডেভলপমেন্ট’ সপ্তর্ষিমণ্ডলের এক ঋষি, মিলেট ‘শ্রী অন্ন’, অর্গ্যানিক শস্য উৎপাদনের সরকারি স্কিম ‘গোবর্ধন’, দূষণ কমানোর প্রকল্প ‘পঞ্চামৃত’। খাতায় কলমে যে দেশ এখনও হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে যায়নি, যার সংবিধান এখনও ধর্মনিরপেক্ষ, তার বাজেটে এত হিন্দুগন্ধী শব্দ কেন, সে প্রশ্ন নাহয় না-ই বা করলাম। সরকারি নীতি-ভাষ্য বাদ দেয়নি অমর্ত্য সেন এবং তাঁর সহলেখক, প্রখ্যাত দার্শনিক মার্থা নুসবমকেও। ২০২২-২৩’এর আর্থিক সমীক্ষা বলেছে শুধু টাকা-পয়সা নয়, মানুষের জীবনের মান নির্ধারিত হয় আরও অনেক কিছু দিয়ে— ফুটনোটে নুসবম-সেন’এর বই কোয়ালিটি অব লাইফ। বিভিন্ন সমীক্ষা দেখিয়েছে, অতিমারির ফলে কতখানি অবনমন ঘটেছে এই ‘কোয়ালিটি অব লাইফ’-এর। আর্থিক সমীক্ষা মনে করিয়ে দেয়, এ সরকারের লক্ষ্য ‘সবকা সাথ’, ‘সবকা বিকাশ’ এবং ‘সবকা বিশ্বাস’— বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর। ধর্ম থেকে জিরাফ, সমস্ত কিছু গুলিয়ে দিতে রাষ্ট্রের এমন সুচিন্তিত প্রয়াস দেখে ভয় হয়, এই বুঝি বাড়ির নাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেওয়ায় ছাদসুদ্ধু সমস্ত ইমারতখানাই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে।

ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement