Donald Trump

ট্রাম্পের হার মানেই স্বপ্নসুরক্ষা?

দুই শতক ধরে আমেরিকানদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে: ‘সরকার দূর হটো’— পুঁজিবাদী মুক্তবাণিজ্য ও তজ্জনিত সমাজই একমাত্র সফল করতে পারে তাঁদের স্বপ্ন।

Advertisement

নীলাঞ্জন হাজরা

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:৪৩
Share:

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল চিত্র।

পুঁজিবাদী মুক্তবাণিজ্য চালিত, মতপ্রকাশের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা সুনিশ্চিতকারী, ব্যক্তিগত মেধার পূর্ণ বিকাশের সুযোগে সমৃদ্ধ অঢেল দুধ-ও-মধুর দেশ হওয়ার ‘অামেরিকান ড্রিম’-এর সোনার পাথরবাটিতে কি ফাটল দেখা দিল শেষে? সে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিচিত্রতম চরিত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসীন হওয়া ইস্তক মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের মধ্যে ইত্যাকার কূটাভাসীয় আশঙ্কা জাঁকিয়ে বসেছে। সে আশঙ্কা যতই বেড়েছে সংবাদমাধ্যমের এই অংশের রাগ ঠিকরে পড়েছে ট্রাম্পের উপর।

Advertisement

এর অতি কৌতুকময় নমুনা ৮ নভেম্বরের হাউস অব রিপ্রেজ়েন্টেটিভস ও সেনেটের নির্বাচন সংক্রান্ত লেখালিখি। নির্বাচনের আগে সংবাদমাধ্যমগুলির সিংহভাগ কলমচির ঘুম হচ্ছিল না এই আশঙ্কায় যে, রিপাবলিকান পার্টি ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে এ লড়াইয়ে আসল জয় হবে ট্রাম্প সাহেবের। কারণ, মুদ্রাস্ফীতিতে আগুন আমেরিকান বাজারের আঁচে পোড়া মানুষ চুটিয়ে ভোট দেবেন রিপাবলিকানদের, আর সেই ঝাঁকে রয়েছেন বিপুল সংখ্যক প্রার্থী যাঁদের ‘এন্ডোর্স’ করছেন ট্রাম্প। ‘এন্ডোর্স’ করা মানে তাঁদের হয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন, নির্বাচনী জনসভায় গলা ফাটাচ্ছেন এবং নির্বাচনী বিজ্ঞাপনে তাঁর মুখও ঝলমল করছে। একটি হিসাবমতে এ সংখ্যাটা হল সেনেটের ১৭ জন প্রার্থী, হাউসের ১৩৫ জন। এই প্রার্থীদের জয় হলে, ভাবছিলেন কলমচিরা, ২০২৪-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের ট্রাম্প রিপাবলিকান প্রার্থী হবেনই। এটুকু ভেবেই তাঁদের ঘাম ছুটে যাচ্ছিল— তার পর কী হবে মা মিসিসিপিই জানেন!

আবার যখন নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি আশানুরূপ বাজিমাত করতে না পেরে, কোনও ক্রমে মাত্র ন’টি আসনে এগিয়ে (২২২/২১৩) হাউস জয় করল, এবং একটি আসনে পিছিয়ে সেনেটে হেরে গেল (৪৯/৫০), সকলে হইহই করে বলতে লাগলেন ট্রাম্প হেরেছেন, ট্রাম্প হেরেছেন। যাক বাবা, এ বার রিপাবলিকান পার্টির রাহুর দশা ঘুচল বোধ হয়। ‘অামেরিকান ড্রিম’ বেঁচে গেলেও যেতে পারে।

Advertisement

এই আশঙ্কা-উল্লাসের মৌলিক সমস্যা এই যে, এই সব লেখালিখি কিছুতেই মানুষকে গোড়ায় গিয়ে বুঝতে দিতে চায় না ট্রাম্প সহসা টপ করে চাঁদ থেকে আমেরিকান রাজনীতিতে খসে পড়েননি। ট্রাম্পীয় রাজনীতি এক উর্বর জমিতে গজিয়েছে ধীরে ধীরে, দশকের পর দশক ধরে। আর সে রাজনীতির কল্পনায় আমেরিকা যে দেশ তা এ লেখার গোড়ায় উল্লিখিত ‘অামেরিকান ড্রিম’-এর বিশেষণগুলি থেকে বহু অলোকবর্ষ দূর। (এবং এখানে বলে রাখতে চাই, আমেরিকান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিফলিত সে স্বপ্নের অনেক কিছুই যে কোনও সমাজব্যবস্থার কাছে শিক্ষণীয়, অনুকরণীয়।)

ট্রাম্পের ব্যক্তিত্বে প্রকাশিত রাজনীতির এমনই জোর যে, আমেরিকার অব্যবহিত পূর্ব উপকূল আর একেবারে পশ্চিম উপকূলের ক্যালিফর্নিয়ার মতো কিছু অঞ্চল বাদ দিলে সে দেশের উত্তর-মধ্য-দক্ষিণ-পশ্চিমে বিস্তৃত এক বিপুল অঞ্চলের একটি নয়া রাজনৈতিক-ভৌগোলিক পরিচয়ই সৃষ্টি হয়ে গেছে গত পাঁচ-সাত বছরে— ট্রাম্পল্যান্ড। ইন্টারনেট ঘাঁটলেই তার মানচিত্র দেখা যায়, যা দেখে আঁতকে উঠতে হয়। আমার আশঙ্কা এই যে, ৭৬-বর্ষীয় ট্রাম্প ইহজগৎ ছেড়ে চলে যাওয়ার অনেক অনেক কাল পরেও ‘ট্রাম্পল্যান্ড’ থেকে যাবে। কারণ, আসলে ট্রাম্প তো ট্রাম্পল্যান্ড তৈরি করেননি, তা তৈরি করেছে সেই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বৌদ্ধিক পরিবেশ যা ‘বামপন্থা’-র ছায়াকেও মহাত্রাস হিসেবে দেখতে শিখিয়েছে আমেরিকার আমজনতাকে।

দুই শতক ধরে আমেরিকানদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে: ‘সরকার দূর হটো’— পুঁজিবাদী মুক্তবাণিজ্য ও তজ্জনিত সমাজই একমাত্র সফল করতে পারে তাঁদের স্বপ্ন। তাতে অনেক ফাটাফুটি আছে বটে, অনেক অন্যায় ঘটে নিশ্চয়ই, কিন্তু দুরন্ত হলিউড ছবির গপ্পোর মতোই ‘সিস্টেম’-এর মধ্যে থেকেই অকুতোভয় নায়ক-নায়িকাদের ব্যক্তিগত নেতৃত্বেই সব সমস্যার সমাধান করে ফেলা সম্ভব। বামপন্থা এই ‘সিস্টেম’-টাকেই চ্যালেঞ্জ করে— তা আসলে আমেরিকার স্বপ্নেরই ধ্বংস চায়। ২০১৫-১৬ সালে যখন গোকুলে বাড়ছিলেন ট্রাম্প, তাঁর রাজনীতির বিপদের মোকাবিলার থেকে সেই বিশ্বাসেই ও দেশের কলমচিরা অনেক বেশি জরুরি মনে করেছিলেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে ঘোষিত বামপন্থী বার্নি স্যান্ডার্সের উত্থান আটকে প্রেসিডেন্ট ভোটে হিলারি ক্লিন্টনের মনোনয়ন সুনিশ্চিত করা।

কেন জানি না, এই বিজ্ঞ কলমচিদের ধারণাতেই আসেনি যে, দেশের বিরাট অঞ্চল জুড়ে যেখানে যেখানে মুক্তবাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবিকার সুযোগ ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে, যে শহরের পর শহরে পড়ে রয়েছে শুধু বিশাল বিশাল কারখানার কঙ্কাল— পরিভাষায় যা ‘রাস্ট বেল্ট’— সেখানেই একেবারে খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের মনে জমে উঠেছে আমেরিকার শাসনব্যবস্থার যা কিছু প্রাতিষ্ঠানিক প্রতীক তার প্রতিই এক ভয়ঙ্কর ক্রোধ। ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে ঠেলতে ঠেলতে প্রায় দক্ষিণপন্থার সীমায় হাজির-করা ক্লিন্টন দম্পতির মতো তেমন প্রতীক আর আছে না কি?

স্যান্ডার্স অস্তাচলে গেলেন, ট্রাম্পের উদয় হল। মানুষের অসন্তোষের উত্তরে স্যান্ডার্স এক সুনির্দিষ্ট বাম-ঘেঁষা কর্মসূচি হাজির করেছিলেন। ট্রাম্প খুঁচিয়ে তুললেন এক শ্বেতাঙ্গজনমোহিনী চরম দক্ষিণপন্থী আগুন। ট্রাম্পল্যান্ডের পাশাপাশি আমেরিকান রাজনৈতিক লব্জে ঢুকল ‘ট্রাম্প ফেনোমেনন’। তার ক্লাইম্যাক্স আমরা দেখলাম ২০২১-এর ৬ জানুয়ারি। ট্রাম্পকে পরাজিত ঘোষণাকারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলটাই চরম কারচুপি— এই দাবি করে ট্রাম্পের সমর্থকরা দলে দলে আমেরিকান গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শিখর— আমেরিকান আইনসভার সদর দফতর ক্যাপিটল বিল্ডিং-এ ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়ে দিল সশস্ত্র হামলায়। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গণতন্ত্রের উপর এমন প্রতীকী হামলা ওসামা বিন লাদেনও চালাতে পারেননি।

১৫ নভেম্বর ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন তিনি ২০২৪-এ ফের আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে চান। রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পাবেন কি? বলতে পারি না। কিন্তু বলাই যায়, প্রোপাগান্ডা-ময় ‘অামেরিকান ড্রিম’-এর সোনার পাথরবাটিটিকে পিছনে ফেলে অর্থনীতির গোড়ার গলদ না শুধরালে ট্রাম্পল্যান্ড বা ট্রাম্প ফেনোমেনন উবে যাবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন