music

সেই সুরের অপেক্ষায়

এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গানে পড়বেই। এ বারের পুজোয় এখনও পর্যন্ত মুখে মুখে ফেরা একক বা সমবেত কণ্ঠের মৌলিক গান পাওয়া গেল কি?

Advertisement

অলক রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ০৬:০০
Share:

—ফাইল চিত্র।

গান তৈরিতে সময় দিতে হয়, বলেছিলেন বিমান মুখোপাধ্যায়। নচিকেতা ঘোষ ‘আমার গানের স্বরলিপি’ হেমন্তবাবুর জন্য তৈরি করলেও সে গান সর্বাগ্রে দেখিয়ে নিয়েছিলেন রবীন মজুমদারকে। গানে অনেক ক্রোম্যাটিক নোট, তাই সে গান হেমন্তকণ্ঠে কেমন মানাবে তা বুঝতে নিত্যসহচর দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে তুলিয়ে দেওয়া হল গানটি। দ্বিজেনবাবুই বলেছিলেন এক আড্ডায়, “সুর শুনে আহ্লাদে গদগদ নচিকে রেকর্ডিংয়ের তারিখ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, “না, এটা হেমন্তদার, তোর গলায় শুনে একটা আন্দাজ নিলাম।’ তখন রাগ যে হয়নি এমন বলব না। কিন্তু আমাদের সময়ে গান এ ভাবেই তৈরি হত।”

Advertisement

এই যৌথ সম্ভাষণটাই বাংলা গানের দুনিয়া থেকে উবে গেছে। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য যখন আসরে যেতেন, দেখেছি দল বেঁধে শ্রোতারা তাঁর সঙ্গী। সেখানে তাঁর গানের আগে-পরে যাঁরা আছেন, সমাদর করে তাঁদের গানও শুনতে দেখেছি ওঁকে, সপারিষদ। কলেজ স্ট্রিটের সিসিল হোটেলে তাঁকে মধ্যমণি করে যে রবিবাসরীয় আড্ডা বসত, সেখানে পেশ হত শিল্পীদের পুজোর ও অন্যান্য নতুন গান, গুণাগুণ বিচার হত। রবীন্দ্রভারতীর টিচারস’ রুমে বসে প্রহ্লাদ ব্রহ্মচারী সাশ্রুনয়নে বলেছিলেন, “গ্রামোফোন কোম্পানি পুজোয় আমার গান রেকর্ড করবে না শুনে ধনঞ্জয়দা বলে পাঠালেন, তা হলে উনিও সে বছরে গাইছেন না।”

এই যে বহুর জন্য ভাবা, এ সংগঠন করে হয় না। লাগে সিংহহৃদয়। সে হৃদয় এখন ভয়ে সঙ্কুচিত, নইলে সুচিত্রা মিত্রের শতবার্ষিকী-সূচনার এক অনুষ্ঠানে এক ঝাঁক নামী শিল্পী কথা দিয়েও অনুপস্থিত থাকবেন কেন? কী হারানোর ভয়ে? মনে পড়ে তারাশঙ্করের কবি নৃত্যনাট্যের কথা। হেমন্তবাবুর ইচ্ছে ছিল নৃত্যশিল্পী অসিত চট্টোপাধ্যায়ের এই প্রযোজনায় গান গাওয়ার, কিন্তু কথা দেওয়া হয়ে গেছে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে। গানের রেকর্ডিংও শেষ। জটিলেশ্বরের কথায়, “হেমন্তদা প্রথম শো দেখতে এসে অনুষ্ঠানের পরে স্টেজে উঠে বললেন, আমি গাইলে হেমন্ত মুখুজ্জের গান হত। জটিল কবি চরিত্রের গান গেয়েছে।” আরও বিস্ময়: মুক্তাঙ্গনে এই প্রযোজনার শো-এ স্বয়ং দেবব্রত বিশ্বাস যেচে কাউন্টারে বসে টিকিট বিক্রি করেছেন। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান কলকাতায় এসে অর্থসঙ্কটে পড়লে ত্রাতার ভূমিকা নিয়েছেন উৎপলা সেন। এই অভিজ্ঞতাগুলি গানের তুলনায় কম সুরেলা?

Advertisement

নির্মলেন্দু চৌধুরীর প্রয়াণের পরে পুত্র উৎপলেন্দুকে আমেরিকায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন মোবাইল আসেনি। দায়িত্ব নিলেন উষা উথুপ, তাঁকে খুঁজে, সঙ্গে নিয়ে ফিরলেন কলকাতায়। একই দায়বদ্ধতা দেখিয়েছিলেন নির্মলা মিশ্রও, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্ধার করে জনসমক্ষে নিয়ে এসেছিলেন। রবীন্দ্রসদনের সেই অনুষ্ঠানে প্রতিমা যখন সাদামাঠা সাজপোশাকে, আটপৌরে হারমোনিয়ামে ধরলেন ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’, শ্রোতারা শুধু প্রতিমার জন্য নয়, চোখ ভিজিয়েছিলেন নির্মলা মিশ্রের জন্যও।

সঙ্গীত সুগম তখনই, শিল্পী যখন তাঁর গায়নের বৈভবকে ছাপিয়ে যান মানবিকতায়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিয়মিত অনুজ শিল্পীদের খবর রাখতেন ফোনে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজেকে যথাসম্ভব লুকিয়ে অকাতরে সাহায্য করেছেন দুঃস্থ শিল্পীর পরিবারকে। প্রচারমাধ্যম তার খোঁজ পায়নি। মৃণাল চক্রবর্তী বলেছিলেন, “হেমন্তদা পুজোর সময় কলকাতায় থাকলে আমার, সুবীরের সব অনুষ্ঠান কেঁচে গণ্ডূষ। এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ নিয়ে বেশ জোরালো প্রতিবাদ করলাম, হেমন্তদা না রেগে তখন প্রোডিউসারদের ফোন করছেন, ‘এঁদের একটু ছবিতে গাওয়ান, বেইজ্জত হয়ে যাচ্ছি যে।’”

অন্যের জন্য ভাবনার এই বিস্তার এখন কই! শুধু ‘আমি আমি’, কদাপি তা ‘আমরা’ হয় না। ব্যতিক্রম এক-আধটি: নৃত্যের কিংবদন্তি শম্ভু ভট্টাচার্য বা পিয়ানো-অ্যাকর্ডিয়নে সিদ্ধহস্ত প্রতাপ রায়ের জীবনধারণের যাবতীয় দায়িত্ব যেমন অক্লেশে নেন কল্যাণ সেন বরাট। বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরা মিলে সংগঠন করেছেন, বছরভর দেশ জুড়ে নবীন-প্রবীণ বরণ। আর এখানে অপেক্ষা, কবে অমুক জায়গা থেকে ডাক আসবে! সবাই মিলে যে কিছু করা যায়, সেই নিঃস্বার্থ আত্মবিশ্বাসের বড় অভাব। আত্মপরিচয়হারা দুরন্ত কিছু বালককে সুরের জ্ঞান দিয়ে বাবা আলাউদ্দিন খান গড়েছিলেন ‘মাইহার ব্যান্ড’। বন্দুকের পরিত্যক্ত নল সাজিয়ে জলতরঙ্গের আদলে সেখানে তৈরি হল নলতরঙ্গ, ভাঙা সেতার সরোদ ব্যাঞ্জো পেল নবরূপ। এই সংগঠিত, যৌথ সুরসাধনার মতো কোনও ছবি এখন সামনে নেই, বরং বাড়ছে নিষেধাজ্ঞার বহর। প্রতিষ্ঠানের ফতোয়া আসছে, অমুক অনুষ্ঠানে যোগ দিলে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ও শিক্ষকের চাকরি সঙ্কটে পড়বে!

এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গানে পড়বেই। এ বারের পুজোয় এখনও পর্যন্ত মুখে মুখে ফেরা একক বা সমবেত কণ্ঠের মৌলিক গান পাওয়া গেল কি? বৈদ্যুতিন মিডিয়ার প্রতিযোগিতাধন্য যে নবীন গাইয়েরা সাগরপারের পুজোয় গেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের মুখে পঞ্চাশ ষাট সত্তর দশকের গান। ইউটিউব-সহ অন্য মিডিয়াগুলিতে যে গানের নতুন নাম এখন ‘সিঙ্গলস’। তার বিজ্ঞাপন, লম্বা-চওড়া পূর্বঘোষণায় মুখ-কান ঢেকে যায়। সেই একক বা যৌথ সুরের অপেক্ষা, উৎসব-আবহ যা ভরিয়ে দেবে আগমনীর আলোর মতো, বিসর্জনের পরেও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন