BJP

ভুল প্রচারে কাজ হল না

বিজেপি সরকার কেন্দ্রীয় স্তরে বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পরিকাঠামো তৈরিতে জোর দিয়েছে।

Advertisement

সন্দীপ মিত্র

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২১ ০৪:৩৮
Share:

এত প্রচার ও আয়োজন সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এমন হার কেন, প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে। সারদা-নারদা, আমপান-দুর্নীতি, কাটমানি, রেশন কেলেঙ্কারি, গরু ও কয়লা পাচার, কিছুতেই কিছু হল না, জনগণের তৃণমূলমুখিতা কি তা হলে শুধু ভাঙা পায়ের নেত্রীর প্রতি সহমর্মিতা? না, একটা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণও জরুরি।

Advertisement

বিজেপি মূলত কেন্দ্রীভূত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তাদের মত, উপর থেকে ব্যাপক পরিবর্তন আনা গেলে তা চুইয়ে নীচের তলায় আসবে। বিজেপি সরকার কেন্দ্রীয় স্তরে বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পরিকাঠামো তৈরিতে জোর দিয়েছে। সবই এই আশায় যে, তা আমূল পরিবর্তন আনবে। তাদের মনে হয়েছে, নিচু তলায় জরাজীর্ণ, কেলেঙ্কারি দ্বারা কলুষিত কোনও সরকার ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে না। বিশ্বের উন্নত দেশগুলিও এই পথে, সামাজিক সুরক্ষা দৃঢ় করে অভূতপূর্ব ফল পেয়েছে।

চিন্তাবিদদের মতে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হিসেবে একেবারে অন্য রকম, ‘ইউনিক’। নবজাগরণ, স্বাধীনতা-পূর্ব ও উত্তরকাল, সব সময়েই বঙ্গবাসী রাজনৈতিক ভাবে অত্যন্ত সচেতন। দীর্ঘ বাম শাসনে গরিবদের উন্নতিরও চেষ্টা হয়েছে। শাসনক্ষমতা নীতিগত ভাবে বিকেন্দ্রীকরণের, খেটে-খাওয়া, সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার ডাক দেওয়া হয়েছে। তা সফল হয়েছে কি না সে অন্য তর্ক, তবে উৎপাদনশীলতা, বিনিয়োগ ব্যবস্থা, মেধাভিত্তিক যোগ্যতার বিচারের প্রশ্নগুলোর সদুত্তর মেলেনি। বাম শাসনের শেষ লগ্নে কিছু মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা, কিছু শ্রেণির সুরক্ষাহীনতা ও আঞ্চলিক দুর্নীতি এক পরিবর্তনের আবহাওয়া তৈরি করেছিল।

Advertisement

বামপন্থী বিকেন্দ্রীভূত সরকারের আদলেই সরকার গড়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। হোঁচট খেতে হয়েছিল। একটা সংগঠিত বাম দল যে অনুশাসনে চলে, তৃণমূল সরকারের তা না থাকায়, অনেকাংশে বাম আমলের নিষ্প্রভ আমলাতন্ত্রকে ক্ষমতাবান করে তুলতে হয়। বামফ্রন্টের পঞ্চায়েতভিত্তিক বিকেন্দ্রীভূত সরকার, যা নেতাদের কুক্ষিগত হয়ে ছিল, আমলাদের মাধ্যমে তা খানিক সংশোধন করা সম্ভব হয়। এক আপাত-বামপন্থী, জনগণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে মানুষের মনে তৃণমূল সরকার স্থান পায়। এই সরকার বুঝেছে, টিকে থাকতে হলে বাংলায় এত কাল ধরে চলে আসা রাজনীতিবিদ ও জনগণের দেনা-পাওনার সম্পর্ক দৃঢ়তর করতে হবে। সবার জন্য প্রকল্প তৈরি করা হয়, দলাদলি নয়, প্রকল্পের সুফল সবাইকে দিতে হবে— বক্তব্যটা এমন। প্রশ্ন ওঠে, এই চাহিদা মেটাতে সরকার অর্থের জোগান পেল কোথা থেকে। হয়তো কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প ও জিএসটি থেকে। যা-ই হোক, গুচ্ছ গুচ্ছ প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে কিছু না কিছু তো পেলাম, সরকারের প্রতি এই ছিল মোটের উপর জন-মনোভাব।

সাম্প্রতিক কালে বিজেপির ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির বিপরীতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ‘জয় মরাঠা’ বা ‘জয় অসম’-এর প্রতিধ্বনি শোনা গেল। রাজনীতিবিদদের কেলেঙ্কারি, তা সে বফর্স বা থ্রিজি-ই হোক কিংবা সারদা-নারদা বা গরু-কয়লা পাচার— নেতা ও দলের চাপানউতোর, সিবিআই-ইডি’র গোলকধাঁধায় সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয় না। সমাজমাধ্যমের প্রচার রসিকতা-মেশানো বিনোদনের মতো, গণমাধ্যমের প্রচারও গা-সওয়া।

তৃণমূল গত লোকসভা ভোটে যে জায়গাগুলোয় খারাপ ফল করেছিল, সেখানে বেশি সময় দিয়েছিল। বিজেপির জয়ী সাংসদরা কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেননি। উপরন্তু পঞ্চায়েত স্তরে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও বাঙালিয়ানার সঙ্গে তা সম্পৃক্ত করার অনভিজ্ঞতায় ভুগেছে বিজেপি।

ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে কোন দল কেমন লাভ পেল? হিন্দুদের মনে বিজেপির ছাপ ফেলার যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, রাজনীতিকদের দৈনন্দিন দেনা-পাওনার জালে তা জড়িয়ে গিয়েছে। অথচ তৃণমূল নেত্রী বিভিন্ন মন্ত্র উচ্চারণে, মন্দির-দর্শনে, পুরোহিত-ভাতায় মন জয় করেছেন। মুসলমানদের প্রতি তাঁর ভাবাবেগ বেশি, বিরোধীদের এই প্রচারে উচ্চবাচ্য করেননি, অন্তত প্রচারে তা বোঝা যায়নি। তৃণমূল নেত্রী হিন্দুবিরোধী, এই প্রচার তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর কাছে কার্যকর হয়নি। নির্বাচনের আগে, একেবারে শেষ লগ্নে দলত্যাগী তৃণমূল নেতাদের প্রায় বিজেপি-মুখপাত্র হয়ে ওঠা ও কারও কারও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে বিকল্প মুখ হিসেবে প্রচারিত হওয়াও কাজে লাগেনি, বরং ভুল বার্তা দিয়েছে। যে নেতানেত্রীরা অনেক আগে দল ছেড়ে চলে গিয়েছেন, মানুষ তাঁদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ মনে করেননি, মনে করেছেন, তাঁরা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় দলত্যাগী। কেউ কেউ ভোটে জয়ীও হয়েছেন। বিজেপি জাতীয় স্তরে বিরাট কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে, যার ফল আজ সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন— এমন ইতিবাচক প্রচারে মন দিলে তাও হয়তো মানুষ বিজেপির সাধের পরিবর্তন নিয়ে ভাবতেন।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন