Juvenile Justice Board

সহমর্মিতার পথে বিচার

আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের যাঁরাই কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরাই জানেন, পুলিশ-বিচারব্যবস্থা-হোম, এই চক্র চলতে থাকে বছরের পর বছর।

Advertisement

রঞ্জিত শূর

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০২৩ ০৬:৩৭
Share:

নাবালকরা অপরাধ ঘটিয়ে ফেললে, অথবা অপরাধের শিকার হলে, তাদের কী করে অন্য পথে ফেরানো যায় স্বাভাবিক জীবনে, তা খোঁজা হবে। প্রতীকী ছবি।

জলপাইগুড়ি, মুর্শিদাবাদ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালু করেছে রাজ্য সরকার। নাবালকরা অপরাধ ঘটিয়ে ফেললে, অথবা অপরাধের শিকার হলে, তাদের ‘জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড’-এর অধীনে বিচার প্রক্রিয়ায় না এনে, কী করে অন্য পথে ফেরানো যায় স্বাভাবিক জীবনে, তা খোঁজা হবে। যেমন, কাউন্সেলিং করা হবে শিশুর, বা পরিবারের, বা দু’তরফেরই। নানা ইতিবাচক সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হবে শিশুকে। পুলিশ এবং জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সদস্যরাই এই বিকল্প পথ খুঁজবেন।

Advertisement

যখন অভিযুক্ত নাবালকদের সামনে কঠিনতম সাজার দাবি তুলে হইচই ফেলার ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, সেখানে এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের যাঁরাই কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরাই জানেন যে, পুলিশ-বিচারব্যবস্থা-হোম— এই চক্র চলতে থাকে বছরের পর বছর। এক বার হোমে পাঠালে বেরোনোর প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল। শুধু অভিযুক্ত নয়, নির্যাতিত নাবালক বা নাবালিকাকেও সেই জটিলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।বার বার পুলিশের কাছে বয়ান দেওয়া, জুভেনাইল বোর্ড বা আদালতের বিচারপতির কাছে সাক্ষ্য বা বয়ান দেওয়া, বাড়ি ছেড়ে হোমে থাকা— সারা জীবনের জন্য এক আতঙ্কময় অধ্যায় হয়ে রয়ে যায় শিশুর কাছে। হোম থেকে বার বার পালানোর চেষ্টা করে শিশুরা। সমাজ বা পরিবারের মধ্যেও নানা হেনস্থা, টিটকারি বা অসহিষ্ণু আচরণের শিকার হতে হয় শিশু ও তার পরিবারকে। এক বার ‘দাগ’ পড়লে এ দেশে তা সহজে মোছা যায় না। সব মিলিয়ে নির্যাতনের ঘটনার চাইতে ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া যেন আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে শিশুর কাছে।

সম্প্রতি এ বিষয়ে এক আলোচনা সভায় কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “এক জন প্রাপ্তবয়স্কের থেকে কিশোর অভিযুক্তকে আলাদা চোখে দেখুন। কারণ ওদের সহানুভূতি নয়, সহমর্মিতা প্রয়োজন। ওরা কেন, কোন পরিস্থিতিতে অপরাধ করেছে, সেটা আমাদের বুঝতে হবে।” তাঁর এই কথাটাই ‘বিকল্প’ বা ডাইভার্সন পদ্ধতির চালিকা শক্তি। শিশুর মন বুঝতে আবেগ ও যুক্তি, দুটোই কাজে লাগানো দরকার। বিজ্ঞান বলে, আঠারো বছরের আগে মানবসন্তানের মস্তিষ্ক পূর্ণতা পায় না। বাবা-মা, শিক্ষক, পুলিশ বা বিচারক, কেউ যেন সে কথা না ভোলেন।

Advertisement

শিশু-অধিকার সম্পর্কিত রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘোষিত অবস্থানে (কনভেনশন) নাবালকের বিচারের এই বিকল্প পদ্ধতি স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বিশেষ ভাবে অস্ট্রেলিয়ার দৃষ্টান্ত দেন। সে দেশে ‘অভিযুক্ত’ নাবালক-নাবালিকাদের প্রথমে মৌখিক ভাবে, পরে লিখিত ভাবে, সাবধান করা হয়। অভিযুক্ত ও অভিযোগকারীর মধ্যে সরাসরি কথোপকথনের ব্যবস্থা করা হয়, বা দু’পক্ষের পরিবারের পরস্পরের কথা বলার ব্যবস্থা করা হয়। অভিযুক্ত নাবালককে নানা সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত করা হয়। কী হবে উত্তরণের পথ, তা নিয়ে কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই। অভিযুক্ত শিশুর পরিস্থিতি, এবং অভিযোগের ধরন দেখে-বুঝে, সংশোধনের পথ স্থির করার ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবনের সুযোগ আছে এই পদ্ধতিতে।

ভারতের আইনেও (জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট ২০১৫) বলা হয়েছে যে, নাবালকের পক্ষে যা সবচেয়ে ভাল, তাকেই নাবালক অপরাধী বিচারের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। শিশুকে কোনও ভাবে ‘দাগি’ করে না দেওয়া, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা, সর্বোপরি শিশুর আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে শিশুসুরক্ষার নীতিমালার মধ্যে। যদিও প্রচলিত পদ্ধতিতে শিশুর এই অধিকারগুলি রক্ষা করা খুবই কঠিন। বিকল্প পদ্ধতিতে পুলিশ-বিচারালয়-হোম প্রণালীকে এড়ানোর সুযোগ রয়েছে বলে শিশুসুরক্ষার নীতিমালা রূপায়ণে কার্যকর হয়ে উঠতে পারে। অতএব ‘বিকল্প পথ’-এর সন্ধানকে স্বাগত জানাতে হয়। অতি জঘন্য অপরাধ ছাড়া, অপর সব ধরনের অপরাধে জড়িত শিশুকে এ ভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার সুযোগ খুলে দিল রাজ্যের এই ‘পাইলট প্রোজেক্ট।’

রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা ঘোষণা করেছেন, ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই প্রথম চালু হল এই পদ্ধতির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ। ভাল কথা। তবে মনে রাখতে হবে, মানবাধিকার কমিশনও এ রাজ্যে প্রথম চালু হয়েছিল। পরিণতি কী? গত অন্তত এক দশকে দেখা গিয়েছে, নাগরিকের মানবাধিকার রক্ষার জন্য পুলিশ-প্রশাসনকে সংযত বা প্রতিহত করায় রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা অতি সামান্য। যে কাজ পুলিশ, আইন-আদালতের উপর নির্ভরশীল, সে কাজে মানবিকতার স্পর্শ রক্ষার মানসিকতা ধারাবাহিক ভাবে ধরে রাখা কঠিন। শিশুদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগকে সহমর্মিতার সঙ্গে দেখার প্রশিক্ষণ কোথায় পুলিশের? এ ব্যাপারে সচেতন না হলে এমন ভাল উদ্যোগও মাঠে মারা যাবে। জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডে প্রায়ই বিচারক থাকেন না। রাজ্যে প্রয়োজনের তুলনায় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যাও অনেক কম। যাঁরা আছেন, তাঁদেরও কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই? তাই সতর্ক থাকা প্রয়োজন, নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যমের নজরদারি প্রয়োজন। শিশু-অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে যে সব স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক সংস্থার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের সাহায্য নিতে হবে সরকারকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন