Society

জীবন বেছে নেওয়ার সক্ষমতা

একটি জ্বলন্ত প্রশ্ন হল মাতৃত্বের ছুটি। কেউ কি ভেবে দেখেছেন, কেন চার দিনের পিতৃত্বের ছুটি ‘যথেষ্ট’ বলে মনে করা হয়?

Advertisement

মহাশ্বেতা চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৩১
Share:

—প্রতীকী ছবি।

আমি পেশায় বিমানচালিকা। এটি এমন এক পেশা, যেখানে মেয়ে মাত্র বারো শতাংশ। বাণিজ্যিক বিমান পরিষেবায় মহিলা পাইলটদের সংখ্যা নারী-পুরুষ সাম্যের নিরিখে এতটাই পিছনে। আমার ছাব্বিশ বছরের জীবন, আর ছ’বছরের কর্মজীবনে বার বার মনে হয়েছে, মেয়েরা তো নিজেরাই সক্ষম। কেউ দিলে তবে সক্ষমতা পাবে তারা, এমন তো নয়। সাম্যের প্রশ্নেও তাই। পুরুষ আর মেয়ে যে সমান, সে বিষয়ে সংশয় নেই। তা হলে মেয়েরা কী চায়? কী তাদের দরকার?

Advertisement

মেয়েদের প্রয়োজন সাম্য প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত এক ন্যায্য ব্যবস্থা। আমি কাজ করি কর্পোরেট জগতে, আর কেবলই শুনি, এ নাকি পুরুষদের দুনিয়া (আ ম্যান’স ওয়ার্ল্ড)। কে যে কবে সেই দুনিয়াটাকে পুরুষের বলে ঘোষণা করল, জানতে ইচ্ছে করে। কিসের ভিত্তিতেই বা কর্পোরেট দুনিয়া কেবল পুরুষের বলে গণ্য হবে? নিশ্চয়ই পেশিশক্তির ভিত্তিতে নয়, কারণ কর্পোরেট ব্যবস্থায় গায়ের জোরের কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই।

যদি কাজের ক্ষমতাই একমাত্র বিচার্য হয়, তা হলে পুরুষ-মহিলাদের মধ্যে এত ভেদাভেদ কেন? কেন ভারতের কেবল আঠারো শতাংশ মেয়ে কাজ করে, যেখানে জনসংখ্যার ৪৯.৫ শতাংশ হল মেয়ে?

Advertisement

এর শিকড় অবশ্যই পরিবারে। একটি মেয়ে জন্মালেই পরিবার তার বিয়ের জন্য টাকা জমাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর কড়া নজর রাখে, যাতে মেয়ের জন্য পরিবারের ভাবমূর্তি নষ্ট না হয়। বিয়ের পরে মেয়েটিকে প্রশ্ন করা হয়, রোজগারের দরকার কী? তোমার সাজগোজের খরচ কি দেওয়া হচ্ছে না? মনে করানো হয়, তার একটাই কাজ— সন্তানের জন্ম দেওয়া। ক্লান্ত, বিপর্যস্ত মেয়েটি ভাবে, করার কিছুই যখন নেই, তখন আর লড়াই করে কী হবে?

ধরা যাক সে ভাবল, হেরে যাবে না, লড়াই করবে। অন্য মেয়েদের চেয়ে আরও জোরের সঙ্গে সে চেষ্টা করবে জীবনে কিছু করার। কাজের জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে তাকে শুনতে হবে, “তোমার বয়স কত? বিয়ে করে সংসার শুরু করতে চাও না? তা হলে কাজের দায়িত্ব সামলাবে কী করে?” ধরা যাক, মেয়েটি নাছোড়বান্দা, সে বিয়ে-সংসারের আশা ছেড়ে দিয়ে কেরিয়ারের দিকে মন দিল। তার লক্ষ্য সেই এক শতাংশ মেয়ের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া, যারা নিজের সংস্থার একেবারে শীর্ষে উঠতে পেরেছে। তার পুরস্কার সে কি পাবে? তার জুটবে কিছু তকমা। বলা হবে, “মেয়ে হওয়ার কত সুবিধাই না নিয়েছে এখানে আসার জন্য।” সে সাফল্যকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়, এই ভেবে লোকে তাকে ভয় পাবে, এড়িয়ে চলবে। আবার মেয়েটি যদি সংসারকে বেছে নেয়, তা হলে সমাজ তাকে দুর্বল বলে চিহ্নিত করে তার সক্ষমতা তৈরির নিদান দেবে।

একটি জ্বলন্ত প্রশ্ন হল মাতৃত্বের ছুটি। কেউ কি ভেবে দেখেছেন, কেন চার দিনের পিতৃত্বের ছুটি ‘যথেষ্ট’ বলে মনে করা হয়? কেন শিশুর দেখভাল মায়েরই কাজ হবে? দীর্ঘ ছুটির পর কাজে যোগ দিয়ে মেয়েটি দেখে, অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। কর্পোরেট ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, মাতৃত্বের ছুটিতে কেউ থাকলে সে বোনাস বা ইনক্রিমেন্ট পায় না, তার কাজের মূল্যায়নও হয় না। স্বভাবতই অনেক টাকা ক্ষতি হয় মেয়েটির, পিছিয়েও যায়। যদি সমাজ মেয়েদের সহায়তায় এতই আগ্রহী হয়, তা হলে বেতনে সমতার বিষয়ে উদাসীন কেন? কিছু আসন সংরক্ষিত করে, বা কোম্পানির বোর্ডে একটা চেয়ার মেয়েদের জন্য রেখে, “আমরা নারীশক্তিকে সমর্থন করি” দাবি করা অনর্থক। আরও আশ্চর্য লাগে চার পাশের নীরবতায়। পরিবার মনে করে, মেয়েটিকে কাজ করার ‘অনুমতি’ দিয়ে যথেষ্ট করেছে। আর কর্পোরেট জগৎ মেয়েদের সক্ষমতার ব্যানার টাঙিয়েই দায় সারে।

আজ যে প্রশ্নটা করা দরকার তা হল, যে সমাজ মেয়েদের অগ্রগতি চায় বলে দাবি করে, তা কবে মেয়েদের এগোনোর পথ না আটকে সরে দাঁড়াবে? আমরাই বলব, মা দুর্গা সব শক্তির উৎস, তার পর আমরাই প্রশ্ন করব, আমাদের আবাসনের নিরাপত্তারক্ষী কেন মহিলা? নারীশক্তির বন্দনা করব, কিন্তু নারী যে শক্তিময়ী হতে পারে তা বিশ্বাস করব না। এমন অন্ধ হয়ে দিন কাটানোর চেয়ে চশমার কাচটা মুছে নেওয়াই ভাল নয় কি?

বহু প্রজন্ম আগে রানি লক্ষ্মীবাই সক্ষমতা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেননি। তিনি নিজেই সাহস খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর কর্তব্য করার। কিন্তু এখন যে বিশ্বে আমাদের বাস, সেখানে মানসিক বাধা এমন প্রবল হয়ে উঠেছে যে, মেয়েরা নিজেরা এগিয়ে না গিয়ে অপেক্ষা করছে, কে এসে তাকে ঠেলে এগিয়ে দেবে। কেউ ফুলের শয্যা বিছিয়ে তার জন্য বসে আছে, এই মোহময় স্বপ্ন দেখতে গিয়ে মেয়েরা ভুলে যাচ্ছে, জীবন আসলে একটা সুযোগ, যা ছিনিয়ে নিতে হয়। আমি বিয়ে করব কি না, সন্তান হবে কি না, আমি ঠিক করব। ‘থিতু হওয়া’ বা ‘সেট‌্ল করা’ মানে সন্তান পালন হতে পারে, একটা দামি গাড়ি কিনে চালানোও হতে পারে। এগুলোর সবই সক্ষমতার পরিচয়, যদি সত্যিই মেয়েটি নিজে বেছে নিয়ে থাকে। সক্ষমতা আমাদের ভিতরেই রয়েছে, তা উপলব্ধি করে নতুন ভাবে বাঁচতে হবে, উঠতে হবে সব বাধা কাটিয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন