Paddy

মাটির উপযোগী সারের ব্যবহার

রাসায়নিক ও জৈবিক সার যাতে চাষের সময়মতো পঞ্চায়েত স্তরে পেতে পারেন চাষিরা, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।

Advertisement

ধরণীধর পাত্র

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২২ ০৫:১৯
Share:

সারের জন্য হয়রান হয়েছেন বাংলার অনেক চাষি।

চাষির নানা সমস্যার মধ্যে একটা সার নিয়ে। এ বছর বর্ষার ধান লাগানোর সময়ে সারের জন্য হয়রান হয়েছেন বাংলার অনেক চাষি। সময়মতো সার পাওয়া যাচ্ছে না, তার দাম ক্রমশ চড়ছে, বাড়ছে কালোবাজারি, এমন নানা অভিযোগ দানা বাঁধছে ‘ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট’ বা ডিএপি সারকে কেন্দ্র করে। অধিকাংশ চাষি এই সার ব্যবহার করেন, যাতে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস, দু’টির পুষ্টি পাওয়া যায়। অ্যামোনিয়াম থেকে প্রাপ্ত নাইট্রোজেনকে ধান বিশেষ ভাবে গ্রহণ করে, তাই চাষিরা তার প্রয়োগে বেশি উৎসাহী। চাষি যাতে সুলভে ডিএপি পান, তার জন্য প্রচুর ভর্তুকি দেয় কেন্দ্র— গত বছর ডিএপি-র ৫০ কেজি ব্যাগে যেখানে ১৬৫০ টাকা ভর্তুকি ছিল, এ বছর সেখানে ভর্তুকি ২৫০১ টাকা। তার পরেও ডিএপি-র দাম বেড়েছে— এ বছর বস্তার দাম ১৩৫০ টাকার মতো, গত বছরের চেয়ে একশো টাকা বেশি। কিন্তু সারের দাম কমানোর চেয়ে বড় প্রশ্ন হল, সারের প্রয়োজন কতখানি?

Advertisement

ভারতের সবুজ বিপ্লবে নতুন প্রজাতির ফসলের উৎপাদন প্রচুর বাড়িয়েছিল রাসায়নিক সারের প্রয়োগ। কিন্তু তা-ই আবার বিপদ ডেকে এনেছে— বাড়তি ফসলের আশায় মাত্রাতিরিক্ত সার প্রয়োগ করেছেন চাষিরা। ফলে ক্রমশ মাটির ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈবিক ধর্ম ব্যাহত হয়েছে। মাটিতে জৈবপদার্থের মাত্রা, উপকারী জীবাণুর মাত্রা কমেছে, শস্যের ফলনও কম হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার ২০১৫ থেকে মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ‘সয়েল হেলথ কার্ড’ প্রকল্প শুরু করে। এর মূল ধারণা হল, চাষি যদি মাটির চরিত্র বুঝে সার দেন, তা হলে অপ্রয়োজনীয় সার দেওয়া কমবে। তাতে চাষের খরচ বাঁচবে, মাটির স্বাস্থ্য বাঁচবে, ফসল ভাল হবে, পরিবেশও বাঁচবে। ভর্তুকির প্রয়োজন কম হওয়ায় সরকারের টাকাও বাঁচবে। কাজের বেলায় দেখা গেল, মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা চাষিদের কাছে বৈজ্ঞানিক চাষের চাবিকাঠি হয়ে এল না। সরকারি তথ্য অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গের অন্তত বত্রিশ লক্ষ চাষি ‘সয়েল হেলথ কার্ড’ হাতে পেয়েছেন, কিন্তু তা বাস্তবিক কাজে লাগাচ্ছেন কত জন, তা বোঝার উপায় নেই।

গলদ আছে গোড়ায়। মাটির স্বাস্থ্য কার্ডের লক্ষ্যপূরণের তিনটি ধাপ আছে। এক, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাটির নমুনা সংগ্রহ; দুই, নির্ভরযোগ্য মাটি বিশ্লেষণ; এবং তিন, মাটির পরীক্ষা-ভিত্তিক সুপারিশ। কাজের বেলায় দেখা গেল, মাটির নমুনা সংগ্রহ যে পদ্ধতিতে হয়, তাতে কৃষকের কাছ থেকে জানার কোনও সুযোগ নেই যে, তাঁদের জমি কোন সমস্যায় আক্রান্ত, এবং তা নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থাতে কী ভাবে সাড়া দেয়। মাটি পরীক্ষার পরিকাঠামোর গুণমান, প্রশিক্ষিত পরীক্ষকের সংখ্যা, পরীক্ষাগারের স্বল্পতা নিয়েও উদ্বেগের কারণ আছে। প্রায়ই মাটির নমুনা অনেক জমা হয়ে যায়, ফলে চাষের আগে যথাযথ সুপারিশ পৌঁছয় না। রিপোর্টে মাটির ভৌত ধর্মের বর্ণনা থাকে না, কোনও বিশেষ পুষ্টির অভাব হলে ফসলের উপর তার কী প্রভাব পড়ে, তার কোনও বিবরণ থাকে না। চাষিরা মাটির স্বাস্থ্য কার্ডের উপযোগিতা বুঝলেও, সময়মতো রিপোর্ট কার্ড পান না। আবার পেলেও, সেখানে কী বলা হয়েছে, তা না-বোঝার জন্য তথ্য কাজে লাগাতে পারেন না।

Advertisement

অতএব মাটির পরীক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত এবং তৎপর করলেই হবে না, চাষি যাতে রিপোর্টের বিবরণ ঠিক মতো বুঝতে পারেন, এবং তার সুপারিশ অনুসারে সারের মাত্রা নির্ধারণ করতে পারেন, তার জন্য প্রশিক্ষণও দরকার। ব্যাপক হারে প্রশিক্ষণ দিতে হলে রাজ্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে আরও শক্তিশালী করা দরকার। কোন সার দিতে হবে, ফসল চক্র শুরু হওয়ার আগেই তা চাষিকে জানানো দরকার। প্রাথমিক ভাবে কিছু শিক্ষিত কৃষককে তৈরি করতে হবে, যাঁরা অন্যদের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন।

রাসায়নিক ও জৈবিক সার যাতে চাষের সময়মতো পঞ্চায়েত স্তরে পেতে পারেন চাষিরা, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। রাসায়নিক, জৈব এবং জীবাণু সারের সমন্বয়পূর্ণ ব্যবহার হলে জমির স্বাস্থ্যের পক্ষে সবচেয়ে ভাল। রাসায়নিক সার কেনার সময়ে সতর্ক হতে হবে চাষিকে। এই জন্য রেশন কার্ডের মতো, মাটির স্বাস্থ্য কার্ডের ভিত্তিতে কৃষককে সার দেওয়া দরকার, এবং তাতে ক্রেতা ও বিক্রেতার স্বাক্ষর থাকা চাই।

রাজ্যস্তরে কৃষি সম্প্রসারণ আধিকারিক ও কৃষকের সম্পর্ক আরও নিবিড় করতে হবে। প্রয়োজনে মাটি বিশ্লেষণের জন্য বেসরকারি সংস্থার সাহায্য নেওয়া যায়। মাটির স্বাস্থ্য কার্ড অনুসারে সার প্রয়োগ এবং সংশোধনী পরিমাপ দেওয়ার ফলে কৃষিতে যে লাভ হয়েছে, সমস্ত ব্লকে কৃষকদের তা দেখাতে হবে। কোনও স্থানীয় সংস্থা যদি শস্যের বর্জ্য পদার্থের ব্যবহার, কেঁচো সার, জীবাণু ও শৈবালজাতীয় সার তৈরি করে, তাদের উৎসাহ দেওয়া দরকার। এই জৈব সার রাসায়নিক সারের পরিপূরক হতে পারে। সার প্রয়োগের যথাযথ নীতি তৈরি না করলে ফসলের ক্রেতার স্বাস্থ্য, চাষির রোজগার, বা পরিবেশ, কিছুই বাঁচানো যাবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন