রোমে ভারতীয় মশলার প্রাচীন গুদাম এখন উন্মুক্ত
Black Pepper

গোলমরিচের কালযাত্রা

গোলমরিচের এই গুদাম ৯২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ডমিশিয়ান (৫১-৯৬ খ্রিস্টাব্দ) নির্মাণ করেন, সম্রাট নিরোর (৩৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দ) তৈরি একটি বিশাল পোর্টিকোকে রদবদল করে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, তিনতলা এই গুদামে দু’টি উঠোনের চার পাশে কমপক্ষে ১৫০টি ঘর ছিল।

অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৪:১১
Share:

রোম সাম্রাজ্য যখন মধ্যগগনে, তখন বিশ্বের সব রাস্তাই নাকি যেত রোমে। এমনকি ভারত থেকেও রোম যাওয়া-আসা ছিল, তার প্রমাণ এখন দেখা যায় নিজের চোখে। ভ্রমণপিয়াসি মানুষমাত্রেই জানেন, রোমের প্রধান আকর্ষণ শহরের কেন্দ্রে ‘রোমান ফোরাম’— প্রায় হাজার বছর ধরে যা ছিল প্রাচীন রোমের প্রধান রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র। চৌকোনা চত্বরের চার পাশে ছিল বিশাল বিশাল নির্মাণ। প্রশাসনিক ভবন, মন্দির, বাজার, বিচারালয়, কী না ছিল! এখন পাঁচ একরের এই আয়তাকার জায়গাটি একটি উন্মুক্ত প্রত্নস্থল, যেখানে বারো মাস পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। ৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কনস্টানটাইনের রাজত্বকালে ফোরামের শেষ অট্টালিকা ‘ব্যাসিলিকা অব ম্যাক্সেন্টিয়াস’ নির্মাণ শেষ হয়। ‘ব্যাসিলিকা’ বলতে জনসুবিধার্থে নির্মিত ভবনকে বোঝায়— তা হতে পারে বিচারালয়, কিংবা বাণিজ্যকেন্দ্র। ফোরামের পূর্ব দিকে মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢোকার পর পাথর-বাঁধানো প্রাচীন রাজপথ ‘সাকরা ভিয়া’-র ডান দিকে পড়বে ৩৬০ ফুট লম্বা এই ব্যাসিলিকা। ১৯২৩ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময়ে এখানে খুঁজে পাওয়া যায় রোমের ‘হোরেয়া পিপেরাটারিয়া’। বাংলায় যার অর্থ, ‘গোলমরিচের গুদাম’। রোমান সাম্রাজ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ভারতীয় মশলা ছিল গোলমরিচ। তাই গোলমরিচের নামে গুদাম হলেও, আদতে এখানে ছিল এশিয়ার (প্রধানত ভারতের) মশলার ভান্ডার। দোকানও বটে— এখান থেকে সরকারি দরে বিক্রি হত ভারতের মশলা। উৎখননের ১০১ বছর পর রোমের হোরেয়া পিপেরাটারিয়া দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। এখন কেউ রোম গেলে দেখে আসতে পারেন, ইটালিতে এক টুকরো ভারতকে।

গোলমরিচের এই গুদাম ৯২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ডমিশিয়ান (৫১-৯৬ খ্রিস্টাব্দ) নির্মাণ করেন, সম্রাট নিরোর (৩৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দ) তৈরি একটি বিশাল পোর্টিকোকে রদবদল করে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, তিনতলা এই গুদামে দু’টি উঠোনের চার পাশে কমপক্ষে ১৫০টি ঘর ছিল। ছিল একাধিক চৌবাচ্চা, সম্ভবত মশলা ধোয়ার জন্য। নিরোর আদি নির্মাণে তৃতীয় তলে যথেষ্ট ফাঁক থাকার জন্য সহজেই সূর্যের আলো এক তলার উঠোন আর ঘরগুলিতে পৌঁছত। ডমিশিয়ান সেই নকশায় রদবদল করেননি। সে যুগে সোনার মতোই দামি ছিল ভারতীয় মশলা, তাই দিন-রাত ঘিরে রাখত সৈন্যরা। রোমে এমন ‘হোরেয়া’ বা গুদাম থাকত নানা ধরনের জিনিসের জন্য— শস্য, তেল, মদিরা, সুগন্ধি, সামরিক সরঞ্জাম, ইত্যাদি। গুদামের দেওয়াল হত খুব মোটা, যাতে তাপমাত্রা কম থাকে। অনেক সময়ে হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থাও রাখা থাকত এগুলির নির্মাণশৈলীতে।

ভারতের সঙ্গে পশ্চিমের দেশগুলির মশলার বাণিজ্য অবশ্য আরও প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে একটি জাহাজডুবি হয়েছিল। তা থেকে পাওয়া নানা সামগ্রী থেকে জানা যায়, সেই সময়ই ভারতীয় গোলমরিচ পৌঁছে গিয়েছিল ভূমধ্যসাগরের দেশগুলিতে। ক্রমে এশিয়ার মশলার চাহিদা বাড়তে থাকে ইউরোপে। কেবল স্বাদের জন্যই নয়, চিকিৎসার জন্যও। গ্রিস এবং রোমের চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ভারতের ভেষজ ব্যবহার করত বিষের প্রতিষেধক হিসাবে, চোখের সমস্যায়, অস্ত্রোপচারের সময়ে অজ্ঞান করার উপকরণ (অ্যানেস্থেশিয়া) হিসেবে, বেদনা উপশমে, মেয়েদের নানা অসুখের চিকিৎসায়। গ্রিক চিকিৎসক ডিয়োস্করিডিস তাঁর মেটেরিয়া মেডিকা (৬৫ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থের প্রথম আটাশটি অধ্যায়ে নানা ভারতীয় ভেষজের উল্লেখ করেছেন। এই কারণেই ‘হোরেয়া পিপেরাটারিয়া’-র কাছাকাছি সে যুগের রোমান ডাক্তাররা ডেরা বাঁধেন। জানা যায়, সে সময়ের এক বিখ্যাত ডাক্তার— অ্যাসক্লেপিয়াডস অব প্রুসা (খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক) এখান থেকেই ওষুধের জন্য ভেষজ সংগ্রহ করতেন। প্রসাধনী এবং সুগন্ধিতেও ব্যবহৃত হত গোলমরিচ।

খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রোমানরা ভারত মহাসাগরে মৌসুমি বায়ুর গতিপথ সম্পর্কে সম্যক ভাবে অবহিত হয়। ভারত ও মিশরের মধ্যে জলপথে বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই সময় রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা অগাস্টাস বিশালাকৃতির নতুন নতুন নৌযান তৈরি করান। গ্রিক ভূগোলবিদ স্ট্রাবো তাঁর বইতে লিখেছেন, মিশরের মায়স হরমোস বন্দরে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করার জন্য এক-এক সময় ১২০টি বাণিজ্যপোতও অপেক্ষা করত। প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি এক অজানা গ্রিক পোতাধ্যক্ষের লেখা এক রোজনামচায় (পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সি) ভারতের ২৬টি বন্দরের উল্লেখ রয়েছে। ভারতীয় মশলা রফতানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল ‘মুজিরিস’, যা ছিল বর্তমান কেরলে। তামিল সঙ্গম সাহিত্যেও রয়েছে, এই বন্দরে যবন বা বিদেশি জাহাজগুলি স্বর্ণমুদ্রা ভরে নিয়ে আসত, পরিবর্তে নিয়ে যেত গোলমরিচ।

তবে রোমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ গ্রিসের সঙ্গে বাণিজ্যকে অনেকগুণ ছাড়িয়ে যায়। অগাস্টাস-এর শাসনকাল ছিল ভারত-রোমান বাণিজ্যের স্বর্ণযুগ। বাণিজ্যপোতগুলি এই সময় ভারত থেকে মশলা, সুতির কাপড় এবং নানা বিলাসদ্রব্য বোঝাই করে ভারত মহাসাগর ধরে লোহিত সাগরের তীরে বেরেনিকে বা মায়স হরমোস-এর মতো মিশরীয় বন্দরে পৌঁছত। সেখান থেকে উটের পিঠে মাল পৌঁছত নীল নদে। এর পর নৌকা করে আলেকজ়ান্দ্রিয়া বন্দর, অতঃপর নৌযানে ভূমধ্যসাগর ধরে রোমের টিবের নদী-বন্দর ‘ওস্টিয়া আন্টিকা’-তে পৌঁছে যেত। এই ছিল মশলার গতিপথ। হোরেয়া পিপেরাটারিয়ার ঘরগুলিতে আমদানি করা মশলাগুলি (যার মধ্যে প্রধান ছিল কালো গোলমরিচ) মজুত করে রাখা হত, যাতে রোমের প্রশাসন তার দাম ঠিক করতে পারে, বাজারগুলিতে এবং প্রভাবশালীদের বাড়িতে মশলা পৌঁছনোর উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে।

প্রাচীন রোমানদের কাছে ভারতীয় মশলা ছিল বিলাসদ্রব্য। কালো মরিচ, সাদা মরিচ, পিপুল, হলুদ, লবঙ্গ, এলাচ, তেজপাতা ছাড়াও বহু ভেষজ ভারত থেকে আমদানি হত। লাতিন বিশ্বকোষ লেখক প্লিনি উল্লেখ করেছেন, ভারতীয় মশলার চাহিদা মেটাতে ভেজাল মশলাও বিক্রি হত। তাঁর বইয়ের দু’টি অধ্যায়ে প্লিনি উল্লেখ করেছেন নানা ভারতীয় মশলার কথা। অগাস্টাসের সমকালীন রন্ধন-বিশেষজ্ঞ এপিকিউস তাঁর বইতে ৪৭৮টি পাকপ্রণালীর উল্লেখ করেছেন, যেগুলিতে নয় ধরনের ভারতীয় মশলার ব্যবহার পাওয়া যায়। কিছু রোমান মিষ্টিতেও গোলমরিচ ছড়ানো হত। গোলমরিচ শুধু ধনীরাই নয়, মোটামুটি সম্পন্ন শহরবাসী, সৈন্যরাও সাধ্যমতো কিনতেন। হয়তো তা সম্ভব হত এই কারণে যে, দীর্ঘ সময় ধরে রোমে বিদেশি পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক থাকলেও ভারতীয় গোলমরিচের উপর কোনও শুল্ক ছিল না। এর থেকে বোঝা যায়, রোমান সমাজে এই মশলা হয়ে উঠেছিল এক অপরিহার্য সামগ্রী। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত ভারতীয় গোলমরিচ রাজত্ব করেছে রোমের হৃদয়ে।

সেই অতীতের গন্ধ পেতে হলে রোমান ফোরামের ‘সাকরা ভিয়া’ দিয়ে হাঁটতে হবে। ব্যাসিলিকা অব ম্যাক্সেন্টিয়াস-এর পশ্চিম দিকে, রামুলাসের মন্দিরের পূর্ব প্রান্তের মাঝ-বরাবর উত্তর দিকে একটি গলি চলে গিয়েছে। যার নাম ভিকাস অ্যাড ক্যারিনাস। এই গলির এক পাশ দিয়েই ব্যাসিলিকার নীচে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সুড়ঙ্গ খুঁড়েছেন, অতীতের হোরেয়াতে ঢোকার জন্য। বিশাল বিশাল আধুনিক লোহার বিম লাগানো হয়েছে ব্যাসিলিকার ছাদকে ধরে রাখার জন্য। সুড়ঙ্গে ঢোকার পর পাওয়া যায় পায়ের নীচে স্বচ্ছ কাচের হাঁটার পথ। যার নীচ দিয়ে দেখা যায় পোড়া ইটের প্রাচীন মেঝে— দু’হাজার বছরের ঠাসবুননের শীতলপাটির মতো তার নকশা। তার চার পাশে কোথাও বা মশলা ধোয়ার চৌবাচ্চা, কোথাও বা মাটির নীচের পয়ঃপ্রণালীর ভগ্নাংশ। কোথাও বক্রাকৃতি খিলানের এক কোণে সে যুগের এক টুকরো নকশা আজও কী ভাবে যেন টিকে গেছে। এখানে দেখানো হয় হোরেয়া পিপেরাটারিয়া-র ইতিহাস নিয়ে দু’টি তথ্যচিত্র। অসাধারণ সেই অভিজ্ঞতা।

বাঙালি তথা ভারতীয় পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় গন্তব্য ইটালি, আর ইটালি গেলে রোম না দেখে তো ভ্রমণ শুরুই হয় না। রোমের পরিচিত আকর্ষণগুলির পাশাপাশি, হোরেয়ার ভিতরে ভাঙা ইটের খাঁজে আজও লেগে থাকা ভারতীয় গোলমরিচের ঝাঁঝ এক বার অনুভব না করলে কি ভ্রমণ সম্পূর্ণ হবে? হয়তো দু’হাজার বছরের ও-পার থেকে ভারতের গোলমরিচের এক ক্ষুদ্র খণ্ড রোমের মাটিতে অপেক্ষা করছে, আজকের ভারতীয়ের জন্যে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন