দেড়শো বছর পরে
Theatre Group

সাধারণ রঙ্গালয় কেন লুপ্ত হয়ে গেল, তার কারণ খুঁজতে হবে

সরকারি বেসরকারি আর কোনও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এল না বাংলা নাট্যের পূর্বজদের সম্মান জানাতে, বরঞ্চ একাধিক সরকার অসম্মানই করেছে আমাদের নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি এবং শম্ভু মিত্রকে।

Advertisement

বিভাস চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:৫০
Share:

অতীত: বিশ্বরূপা থিয়েটারের বাইরে দর্শকের ভিড়। ১৯৯১ সালের ছবি

খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার...’ প্রবচনটি অসম্পূর্ণ রাখলাম, পাছে কেউ বলেন, এ তাঁতিদের অপমান। ‘গো-জাতির অসম্মান হয়েছে’ বলে কেউ দায়রায় সোপর্দ করতেও পারেন। আসলে বলতে চাইছি, আমাদের কাজ হল কোনও ক্রমে চেয়েচিন্তে নাট্যকর্ম চালিয়ে যাওয়া। এমন বহু নাট্যকর্মী বা কলাকুশলী আছেন, অসুস্থ হলে যাঁদের চিকিৎসার সামর্থ্যটুকুও থাকে না। তাঁদের পাশে দাঁড়াতেই থিয়েটারের কিছু মানুষের একত্র হয়ে ১৯৯১ সালে ‘বঙ্গ নাট্য-সংহতি’ নামে একটি কল্যাণমূলক সংগঠন স্থাপনা; যথাপ্রয়োজনে দুঃস্থ নাট্যকর্মী-কলাকুশলীকে যথাসাধ্য আর্থিক সাহায্য করা সম্ভব হয়েছে, এতাবৎ প্রায় ৪০০ জনকে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাট্যসংস্থা নাট্যাভিনয় বা নাট্যোৎসবের আয়োজন করে, টিকিট বিক্রির টাকা থেকে সেই তহবিল গঠন করেছেন। এখন প্রশ্ন, তাঁরাই কেন হঠাৎ এই ৬ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩-এর ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় বৎসরাধিক কালব্যাপী কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলা (পেশাদার) সাধারণ রঙ্গালয়ের সার্ধশতবর্ষ উদ্‌যাপন করতে চলেছেন!

Advertisement

বঙ্গনাট্যের যে ধারাগুলি এখনও টিমটিম করে অস্তিত্ব রক্ষা করে আছে, তাদের মধ্যে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ ধারাটি সংখ্যা ও বিস্তারের জোরে খানিক সবল বলেই হয়তো তার উপর দায়িত্ব বর্তায় উৎস-ধারাটিকে স্মরণের, যদিও আজ থেকে প্রায় সিকি শতাব্দী আগেই বাংলার পেশাদার সাধারণ রঙ্গালয়ের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছে। দ্বিতীয়ত, সরকারি বেসরকারি আর কোনও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এল না বাংলা নাট্যের পূর্বজদের সম্মান জানাতে, বরঞ্চ একাধিক সরকার অসম্মানই করেছে আমাদের নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি এবং শম্ভু মিত্রকে। আর একটি প্রশ্নও কেউ করতে পারেন, সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতিস্পর্ধী হিসাবেই গ্রুপ থিয়েটার যাত্রা শুরু করেছিল, আজ হঠাৎ কেন এই ভূমিকা বদল? সত্য বটে, এক সময় গ্রুপ থিয়েটারকে বলা হত ‘প্যারালাল’ বা সমান্তরাল থিয়েটার, আর ঠিক সে কারণেই হয়তো সে চাইছে না পেশাদার বা ব্যবসায়িক সাধারণ রঙ্গালয় লুপ্ত হয়ে যাক, এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের সমান্তরাল চরিত্রটিও যাক ঘুচে। ভিন্ন চরিত্র ও ধারার একাধিক থিয়েটারের বেঁচে থাকাটাই স্বাস্থ্যের লক্ষণ— পেশাদার রঙ্গালয়, গণনাট্য, গ্রুপ থিয়েটার, থার্ড থিয়েটার।

কলকাতায় এ দেশের বা এই বঙ্গের মানুষের জন্য প্রথম পেশাদার রঙ্গালয় গড়ে তোলার কৃতিত্ব প্রাপ্য গেরাসিম লেবেদেভ নামক এক রুশ অভিবাসীর। ১৭৯৫-এর জুনে ২৫ নম্বর ডোমটোলায় (পরে এজ়রা স্ট্রিট) জগন্নাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’। তিন শতাধিক দর্শকাসনের এই রঙ্গালয়ে স্থানীয় দর্শকরা টিকিট কেটে একটি অনুবাদ-নাটক দেখেছিলেন হিন্দুস্থানি ও বাংলা ভাষায়, কিন্তু মাত্র দু’দিন অভিনয়ের পর এক ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডে (অন্তর্ঘাত?) রঙ্গালয়টি বন্ধ হয়ে যায়, ইংরেজ শাসকের লাগাতার বৈরিতা তাঁকে বাধ্য করে স্বদেশে ফিরতে। দুই বাংলার নাট্যকর্মী ও গবেষকদের চর্চায় তিনি আজও; বাংলাদেশের হায়াৎ মামুদের গবেষণার মুখ্য বিষয় লেবেদেভ, ঢাকার বরিষ্ঠ পরিচালক মামুনুর রশীদ তাঁর জীবন-আধারিত নাটক রচনা করেছেন, কলকাতায় তার অভিনয়ও হয়েছে।

Advertisement

তবে কেন আমরা উদ্‌যাপন করছি ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বরের সেই ঘটনাটি, যখন সেই সময়ের কতিপয় বাঙালি নাট্যোৎসাহী মিলে শুরু করেছিলেন টিকিট বিক্রি করে নিয়মিত নাট্যাভিনয়ের আয়োজন? জোড়াসাঁকোর চিৎপুর রোডে মধুসূদন সান্যালের ‘ঘড়িওয়ালা বাড়ি’র উঠোন ভাড়া নিয়েছিলেন তাঁরা, মাসিক ৪০ টাকায়। সেখানে মঞ্চ নির্মিত হয়েছিল। নির্মাণে প্রধান শিল্পী ধর্মদাস সুর, সহায়তায় ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, ব্যবস্থাদির দায়িত্বে নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। দর্শকাসনের তিনটি শ্রেণি— দু’টাকা, এক টাকা, আট আনা। প্রথম শ্রেণির জন্য ভাড়া করা চেয়ার, দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য বাঁশের কাঠামোর উপর পাটাতন বসিয়ে বেঞ্চি, তৃতীয় শ্রেণির জন্য দালানের সিঁড়ি ও রোয়াক। প্রথম রজনী ছিল ‘হাউসফুল’, টিকিট বিক্রি বাবদ আয় মোট দু’শো টাকা।

এখানে একটা কথা বুঝতে হবে যে, লেবেদেভ ইউরোপের একটি দেশ থেকে কলকাতায় এসে একটি রঙ্গালয় খুলে দর্শনীর বিনিময়ে স্থানীয়দের জন্য নাট্য প্রযোজনা শুরু করেছিলেন মাত্র। আর অন্য দিকে দু’-এক জন ব্যতিক্রম ছাড়া যাঁদের পূর্বজদের জন্ম-কর্মই বঙ্গদেশে— সেই বাঙালি যাঁরা এত কাল যাত্রা, হাফ-আখড়াই, কবিগান, পাঁচালি প্রভৃতি দেশি নাট্যরসে মজে ছিলেন— তাঁদের শিক্ষিত অংশটি ইংরেজি নাটক, বিশেষত শেক্সপিয়র পড়া ও জানার সুযোগ পাচ্ছেন, কলকাতার সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ইংরেজি রঙ্গালয়গুলিতে মঞ্চস্থ প্রযোজনাগুলির খবর রাখছেন, এবং বিশেষত ওই আঙ্গিকে নাটক লেখা, তার অনুবাদ বা অভিনয় করার দিকে ঝুঁকছেন। প্রথম দিকে ধনাঢ্য শিক্ষিত হিন্দু বাবুরা ‘হিন্দু থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করে স্থির করেছিলেন অভিনয় হবে ইংরেজি রীতিতে, নাটকের ভাষাও হবে ইংরেজি। অনতিকাল পরেই দেখি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালিও পশ্চিমি ধারার থিয়েটার-চর্চায় যোগ দিচ্ছেন। এখান থেকেই গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফী, অমৃতলাল বসুরা উঠে এসেছেন, তাঁদের নাটক ও অভিনয় দেখে সাধারণ বাঙালি দর্শক আমোদিত হচ্ছেন। স্বাভাবিক কারণেই তাঁদের মধ্যে একটি আকাঙ্ক্ষাও জন্ম নিল: থিয়েটার নিয়ে ‘অ্যামেচার’ কর্মকাণ্ড অনেক হয়েছে, এত দিন আমরা চেনাজানা আমন্ত্রিত দর্শকের সামনে নাটক করেছি, বাহবাও পেয়েছি, এ বার দেখা যাক নিজেদের মঞ্চে, দর্শনীর বিনিময়ে অভিনয় করে আমরা সাধারণ দর্শকদের আকৃষ্ট ও সন্তুষ্ট করতে পারি কি না। এই সঙ্কল্প ও চ্যালেঞ্জ নিয়েই তাঁরা এমন এক পেশাদারি উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন (তবে প্রথম অভিনয়ে গিরিশচন্দ্র ছিলেন না, বলেছিলেন: “ন্যাসানাল থিয়েটারের নাম দিয়া, ন্যাসানাল থিয়েটারের উপযুক্ত সাজ-সরঞ্জাম ব্যতীত, সাধারণের সম্মুখে টিকিট বিক্রয় করিয়া অভিনয় করায় আমার অমত ছিল।”) ‘বঙ্গ নাট্য-সংহতি’ সেই বিশেষ দিনের বিশেষ উদ্যোগটিকেই স্মরণ করছে।

আমাদের সাধের সাধারণ রঙ্গালয় আজ সম্পূর্ণ লুপ্ত। আমরা জানি বহু দেশ ও জাতিরই সাধারণ রঙ্গালয় ছিল বা আছে, কিন্তু মাত্র ১২৫ বছরের মাথায় কোনও দেশের সাধারণ রঙ্গালয় লুপ্ত হয়ে গেছে কি না, সে তথ্যটি জানা নেই। শুধু আমাদের ক্ষেত্রেই এ রকম ঘটল কি? যদি তা-ই হয়, তা হলে প্রশ্ন, কেন? সমগ্র কারণ কারও জানা নেই বোধ হয়। শুধু আনন্দ-উৎসবে মেতে না থেকে, উদ্‌যাপন বা স্মরণানুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এই ‘কেন’র উত্তর খুঁজতে হবে। দর্শকরা টিকিট কেটে নাটক দেখলেই ব্যবস্থাটি পেশাদারিত্ব দাবি করতে পারে না। শুধু দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখানো ছাড়া এই যৌথতার শিল্পমন্দিরকে সুষ্ঠু ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, বাঁচিয়ে রাখার জন্য আরও অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। শিশির ভাদুড়িও যেমন একটা মঞ্চ বাঁচাতে পারবেন না বা পারেননি, একা গণেশ মুখোপাধ্যায় বা জহর রায়ও পারবেন না। আর মালিক নামক ব্যক্তিটি যদি ভাবেন ‘নাটক লেখা বা পরিচালনা অতি সহজ একটি কাজ, আমি তো মালিক, আমিও কেন এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হব না?’ তা হলে সর্বনাশ আটকায় কে?

এমন বহু সর্বনাশ আমরা দেখেছি। চোখের সামনে শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্তের থিয়েটার দেখে, সত্যজিৎ-ঋত্বিকের চলচ্চিত্র দেখে কি হাতিবাগানের মনে হত না, আমরাও আধুনিক হওয়ার পাঠ নিই না কেন এঁদের কাছ থেকে? একটা সময় স্টারে শ্যামলী-র মতো সু-অভিনীত প্রযোজনা, বা রঙমহলে নরেন্দ্র মিত্রের দূরভাষিণী দেখে মনে হয়েছিল, সাধারণ রঙ্গালয় কি তবে ঘুরে দাঁড়াল! বিশ্বরূপার নতুন ব্যবস্থাদি দেখে, সেখানে গিরিশ গ্রন্থাগার ও গিরিশ নাট্য প্রতিযোগিতার প্রবর্তন হওয়ায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকের উপন্যাসভিত্তিক নাটক বা বিধায়ক ভট্টাচার্য রচিত নাটক নরেশ মিত্রের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হওয়াতে ভ্রম হয়েছিল, বাংলা থিয়েটার বুঝি আধুনিক হওয়ার পথে পা বাড়াচ্ছে। অনতিকাল পরে যেখানে ছিলাম সেখানেই ফিরে যেতে হল, কারণ রাসবিহারী সরকারের সাধ হয়েছিল তিনি নাটক লিখবেন ও পরিচালনা করবেন— নইলে খরচ বাড়ে। অথচ বিদেশের সাধারণ রঙ্গালয়েই আমরা দেখি শেক্সপিয়র থেকে ব্রেশট, চেকভ, আর্থার মিলার, ইয়োনেস্কো, বেকেট, ওয়েস্কার— সর্বাধুনিক নাটককারদের। স্টারের শেষ ‘এনলাইটনড প্রোপ্রাইটর’ সলিল মিত্রের মতো আর ক’জন ছিলেন এ বাংলায়!

কোনও বড় পুঁজি আমাদের থিয়েটার-ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। উন্নত দেশে প্রয়োজনে সরকার পাশে দাঁড়ায়, আমাদের কোনও সরকারই তেমন ভাবে পেশাদার নাট্যশিল্পের উন্নতি দূরে থাক, তাকে বাঁচানোর কথাও ভাবেনি। শিশিরকথা গ্রন্থে এক প্রবন্ধে স্বপনকুমার চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, বেশ কয়েক বার আর্জি জানানোর পরও যখন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে টলানো গেল না, নাট্যাচার্য এক বার দিঘা পর্যন্ত গিয়ে তাঁর কাছে সেই স্বপ্নের জাতীয় নাট্যশালার জন্য আর্জি জানিয়েছিলেন। বিধানবাবু এক বাক্যে তাঁকে খেদিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “লোকে খেতে পাচ্ছে না, তুমি এখন বলছ থিয়েটারের কথা!” ১৯৫৬ সালে শিশির ভাদুড়ি মশাই শ্রীরঙ্গম ছেড়ে, এবং চিরকালের জন্য থিয়েটার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। তার এক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রযোজনায় পথের পাঁচালী মুক্তি পেয়েছিল। এই বঙ্গে থিয়েটার চিরকাল সিনেমার কাছে হেরেই গিয়েছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন