সাবরমতী আশ্রমকে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র বানানো হচ্ছে
Mahatma Gandh

গাঁধী যেখানে আজও জীবিত

আজ বিশ্বের এক বড় অংশ— গাঁধীজির নাম নিয়ে, বা না নিয়েও— তাকেই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটকে অন্তত রুখে দেওয়ার অন্যতম সুস্থায়ী উপায় বলে মনে করেন।

Advertisement

জয়া মিত্র

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২১ ০৫:৪৪
Share:

নেতা: সাবরমতী আশ্রমে লবণ সত্যাগ্রহের মূর্তি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

সবার প্রয়োজন পূরণ হওয়ার মতো সম্পদ আছে প্রকৃতির ভান্ডারে, কিন্তু তা কারও লোভ পূরণ করার উপযুক্ত নয়”— এই কথাটির মধ্যে আজকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সঙ্কট, পরিবেশ সঙ্কট বা অধুনা যাকে জলবায়ু সঙ্কট বলা হচ্ছে, তার নিরসনের চূড়ান্ত কথাটি আছে। এ কথা গাঁধীজি বলে থাকুন বা অন্য কেউ, এর একটি প্রতিফলন আছে গাঁধীর আচরিত জীবনযাপনে। অনাড়ম্বর সহজ পরিশ্রমী যে জীবনের কথা আমরা তাঁর যাপনে প্রতিফলিত দেখি, আজ বিশ্বের এক বড় অংশ— গাঁধীজির নাম নিয়ে, বা না নিয়েও— তাকেই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটকে অন্তত রুখে দেওয়ার অন্যতম সুস্থায়ী উপায় বলে মনে করেন।

Advertisement

সেই ব্যক্তিগত আদর্শের একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন গাঁধী, ১৯১৭ সালে তৈরি তাঁর সাবরমতী আশ্রমে। তার দু’বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তাঁর ভারতে ফিরে আসা আত্মমর্যাদাপূর্ণ এক নতুন স্বদেশ, স্বাধীনতার চিন্তা নিয়ে। গুজরাতের সাবরমতী নদীর তীরের এই আশ্রম গড়ার পিছনে তাঁর ইচ্ছা ছিল কথিত সেই পরিশ্রমী সহজ জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে একদল নতুন চেতনার মানুষ গড়ে তোলা, যারা প্রকৃত স্বয়ম্ভর এক স্বাধীন ভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখবে। শুধু ইংরেজের অধীনতা থেকে স্বাধীন হওয়া নয়, নিজের অন্তর্জীবনেরও স্বাধীন সত্তার বিকাশ অভ্যাস করবে। তাকেই ‘স্ব-অধীনতা’র একমাত্র পথ বলে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন।

প্রায় চল্লিশ একর জায়গা নিয়ে তৈরি এই সাবরমতী আশ্রমে কৃষি, গোপালন, কাঠের ও চামড়ার কাজ, সুতোকাটা, তাঁত বোনা-সহ নানা রকম কাজ চলত, যে সব কাজ মানুষের প্রতি দিনের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি। পরিচ্ছন্নতা, কঠোর শৃঙ্খলাপালন থেকে প্রতি দিন আশ্রমে সমাগত অতিথিদের দেখাশোনা, সারা দেশ থেকে আসা অসংখ্য চিঠির বিষয়বস্তু জানা, তা নিয়ে আলোচনা— সব কিছুই আশ্রমিকদের দৈনিক কাজের মধ্যে থাকত, যাতে কায়িক ও বৌদ্ধিক পরিশ্রমের মধ্যকার প্রাচীন প্রাচীরটিতে কোথাও চিড় ধরানো যায়। অন্যান্য শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি ছিল স্কুলও। সে এক অন্য স্কুল, ফুলে ভরা বৃক্ষের মতো। দেশের দুই প্রান্তে দু’জন মানুষ দুই স্বপ্নের স্কুল গড়েছিলেন— মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য গাছের আদলে যেন দু’টি শিক্ষাকেন্দ্র। দেশের নানা জায়গা থেকে শুধু নয়, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে এমনকি খাস ইংল্যান্ড থেকেও লুই ফিশার, সি কে অ্যান্ড্রুজ়, লোরি বেকার, মার্জরি সাইকস, প্রবাসী অর্থনীতিবিদ জে সি কুমারাপ্পার মতো আরও অনেকে বারে বারে এসে তাঁর কাজে যুক্ত হতে চান। গাঁধী সকলকেই জিজ্ঞাসা করতেন, তিনি কোন কাজ করেন। কাউকেই কোনও দীক্ষা না দিয়ে তিনি সকলকেই বলতেন যে কাজটা পারেন, সেটাই আরও ভাল করে করতে। সেই ‘আরও ভাল করে করা কাজ’-এর শিক্ষার মধ্যে দিয়ে সাবরমতী আশ্রম ভারতের এক নতুন চেতনার জেগে ওঠার ধারাবাহিক সাক্ষী থেকেছে।

Advertisement

এই আশ্রমের সেই নতুন চেতনার সবচেয়ে বড় দিক ছিল ভারতের লক্ষ লক্ষ দুঃখী মানুষের সাহসের আশ্রয় হিসাবে। নিচু বলে, দরিদ্র বলে এখানে কারও মূল্য কম হয়নি। যেমন কিনা চম্পারণের পিষে যেতে থাকা নীলচাষিরা বলেছিলেন, “ওয়হ হমারে বিচ সে ডর উঠা লিয়ে থে”— আমাদের ভয়কে তিনি সরিয়ে নিয়েছিলেন— সাবরমতী আশ্রম সেই ‘অভী’র কেন্দ্র হয়ে গড়ে উঠেছিল ন্যায়ের সাহসের চর্চায়।

১৯৩১ সালে গাঁধী যখন ভারতের মানুষদের উপর লবণের কর বাড়ানোর বিরোধিতা করে আন্দোলনের ডাক দেন, তাঁর নিকটজনেরাও কেউ বলেছিলেন, “লবণের মতো সস্তা জিনিসের এক পয়সা কর বাড়ানো নিয়ে এত বড় আন্দোলন করার বদলে তো অন্য বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও হতে পারত দেশজোড়া আন্দোলন?” গাঁধীর মত ছিল, সরকার যদি দেশের দরিদ্রতম মানুষটিকেও শোষণের আওতায় আনতে চায়, সেটা কেবল খাওয়ার লবণটুকুর উপর কর বাড়িয়েই করা সম্ভব। এই আন্দোলন তাই দেশের সমস্ত মানুষের সপক্ষে আন্দোলন। তাই সেই ১২ মার্চে ডান্ডিযাত্রায় বেরোনোর নারা ছিল ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’— ফিরব না আর ফিরব না রে! ২৪১ মাইল পদব্রজে যাত্রার মুহূর্তে নিজের হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা আশ্রমের কাছে তাঁর মরণপণ শপথ ছিল, দেশ পরাধীন থাকতে এখানে আর ফিরব না। ফিরে আসব স্বাধীন দেশে।

আধুনিক ভারতের ভাল-মন্দ, সবলতা আর দুর্বলতা নিয়ে নিজের মতো করে গভীর ভাবে ভেবেছিলেন এমন এক জন মানুষ, যাঁর ভাবনা নিয়ে পৃথিবীর অনেক জায়গায় অনেক ন্যায়-সন্ধানী মানুষ আবার নতুন করে ভাবছেন, তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই জীবিত অর্থাৎ চলমান আশ্রমটি সম্প্রতি দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের ‘নয়া উন্নয়ন’-এর তালিকায় যুক্ত হয়েছে। দিল্লির অবিশ্বাস্য ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’ কিংবা দেশের অন্য এক জন ন্যায় ও সৌন্দর্যসাধক মানুষের আজীবনের স্বপ্নভূমি ‘বিশ্বভারতী’র পর সাবরমতী আশ্রম এখন বারো হাজার কোটি টাকার প্রসাধনে ভূষিত হওয়ার অপেক্ষায়। বছরে সাত লক্ষাধিক মানুষ এখনও এখানে আসেন সত্তর বছর আগে নিহত এক বৃদ্ধের স্বপ্নকে বোঝার জন্য। কেন্দ্রীয় সরকারে উৎসাহে গুজরাত রাজ্য সরকার বর্তমান আশ্রমের অধিকাংশ জমি দখল করে সেখানে আমেরিকার মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নামাঙ্কিত মিউজ়িয়ামের আদলে প্রকাণ্ড সৌধ নির্মাণ করতে মনস্থ করেছে। আপাদমস্তক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল অতিথিশালা-সহ বহুমনোরঞ্জক ‘টুরিস্ট কেন্দ্র’ হয়ে উঠবে সাবরমতী।

দেশের নানা অঞ্চল থেকে প্রবল আপত্তি উঠেছে এই প্রস্তাবে। অনেকেই মনে করছেন যে, গাঁধীজির ভাবনাকে মুছে ফেলে তাঁকে কেবল নোটে ছাপা, ‘ঝাড়ুপোঁছা’ পরিচ্ছন্নতার প্রতীক একজোড়া চশমা বানিয়ে ফেলার যে প্রবণতা এই সরকার প্রথমাবধি দেখাচ্ছে, ‘অন্য ভাবনা’র প্রতি যে চূড়ান্ত অসহনশীলতা এই প্রধান শাসক দলের সবচেয়ে স্পষ্ট স্বভাব, সাবরমতী আশ্রমের ‘আধুনিকীকরণ’ও তারই অংশ।

এ দেশে গাঁধীভাবনার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান ‘গাঁধী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর নেতৃত্বে অক্টোবর মাসের ১৭ তারিখ থেকে গাঁধীভাবনায় বিশ্বাসী বেশ কিছু মানুষ গুজরাতের ওয়ার্ধা থেকে ‘সেবাগ্রাম থেকে সাবরমতী’ পদযাত্রা শুরু করেছেন। ২৩ তারিখ তাঁরা পৌঁছেছেন সাবরমতী। যাত্রাশুরুর আগে এবং শেষেও ‘সর্বধর্ম’সঙ্গীতে উপাসনা করেন তাঁরা। এঁদের মধ্যে আছেন দেশের সর্বমান্য গাঁধীবাদী অন্তত পঞ্চাশ জন প্রবীণ। এই যাত্রাপথে আকোলা, খামগাঁও, বরদৌলির মতো যে সব জনপদ তাঁরা পার করেছেন, সর্বত্র স্থানীয় মানুষ তাঁদের সমাদর জানিয়েছেন। কিছু দূর পর্যন্ত সঙ্গে হেঁটেছেন। ঘটনা এই যে, সাবরমতী আশ্রমের এই সম্মানহানিতে ভাষা-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ দুঃখিত এবং ক্ষুব্ধ, কিন্তু তাঁদের মুখের ভাষাকে জোরে শোনাবার মতো লাউডস্পিকার আমাদের অনায়ত্ত। যে শিক্ষিত মানুষরা সেই জায়গায় পৌঁছনোর সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা সম্ভবত এ সবে মনোযোগ দেওয়ার পক্ষে বড্ড বেশি ব্যস্ত।

তাই, কী শান্তিনিকেতন আর কী সাবরমতী আশ্রম, অন্য রকম মানুষদের স্বপ্নের স্মৃতি হয়ে প্রবলের শক্তিমত্তার কাছে মূক থাকবে— এটাই হয়তো আধুনিক ইতিহাসের নীচে প্রচ্ছন্ন ধারা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement