ব্যর্থ?: ভোটার অধিকার যাত্রায় তেজস্বী যাদব ও রাহুল গান্ধী। ২১ অগস্ট ২০২৫, বিহার। ছবি: পিটিআই।
তেজস্বী যাদব-রাহুল গান্ধীর ভোটার অধিকার যাত্রায় যে পরিমাণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ঢল নেমেছিল, তার পর মহাগঠবন্ধন মাত্র ৩৫টি আসনে আটকে গেল— এই দু’টি ঘটনার মধ্যে কোনও অনতিক্রম্য অসঙ্গতি নেই। কারণ, বিহারে মহাগঠবন্ধনের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দিয়েছেন এক কোটি পঁচাশি লক্ষেরও বেশি মানুষ। মোট যত ভোট পড়েছে, তার প্রায় ৩৮%। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ রকম একটা হিসাব ঘুরছে যে, ২০.০৮% ভোট পেয়ে বিজেপির আসনসংখ্যা ৮৯, ১৯.২৫% পেয়ে জেডি(ইউ)-এর আসনসংখ্যা ৮৫; আর এই দুই দলের চেয়েই বেশি, ২৩% ভোট পেয়েও আরজেডি-র আসনসংখ্যা মাত্র ২৫। আপাতদৃষ্টিতে বিস্মিত করার মতোই তথ্য। কিন্তু, এতে একাধিক স্তরে গোলমাল আছে। প্রথম দুটো কথা সহজ— এক, কোনও দলই একা ভোটে লড়েনি, জোটে লড়েছে, ফলে একার ভোট-অনুপাত দেখা অর্থহীন। মহাগঠবন্ধনের মোট প্রাপ্ত ভোটের হার যেখানে ৩৭.৯৪%, এনডিএ-র সেখানে ৪৬.৫৬%। এবং দুই, বিজেপি এবং জেডি(ইউ)-এর তুলনায় আরজেডি ৪০% বেশি আসনে লড়েছে— ফলে, তাদের মোট ভোটপ্রাপ্তিও বেশি।
বিহারের এ বারের ভোটের ২৪৩টি আসনের ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, জয়ী প্রার্থীরা গড়ে ৪৭.৬৬% ভোট পেয়েছেন, এবং জয়ী প্রার্থীদের অর্ধেক পেয়েছেন ৪৭.৭৭ শতাংশের বেশি ভোট। বিহারের ফলাফল থেকে জেতার সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে, কোনও প্রার্থীর ভোট শেয়ার যদি ৩৫-৩৮ শতাংশের মধ্যে আটকে যায়, তবে তাঁর জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ভোট শেয়ার বেড়ে ৪০-৪৩ শতাংশে পৌঁছলে জেতার সম্ভাবনা দাঁড়ায় প্রায় ২৭%; ৪৩-৪৬ শতাংশের মধ্যে থাকলে সম্ভাবনা ৫৪% আর, ভোট শেয়ার ৪৬ শতাংশ বা তার বেশি হলে জেতা কার্যত নিশ্চিত। মহাগঠবন্ধনের ৯৩ জন প্রার্থী ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে জিতেছেন মাত্র ২৯ জন। অন্য দিকে, এনডিএ-র ৫০% প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের হার ৪৭ শতাংশের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ, বেশির ভাগ আসনেই মহাগঠবন্ধনের সমর্থন-ভিত্তি তাদের জয় নিশ্চিত করার মতো নয়।
জোটের মেজো শরিক কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক মাত্র কয়েকটি পকেটে সীমাবদ্ধ। তার বাইরে অন্যত্র কংগ্রেস ধরাশায়ী হয়েছে, ফলে বেকায়দায় পড়েছে মহাগঠবন্ধনও। কোনও প্রার্থী তাঁর আসনের মোট ভোটের ২৫ শতাংশেরও কম পেলে বলা চলে যে, তিনি আদৌ প্রতিযোগিতাতেই আসেননি। মহাগঠবন্ধনে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ১৫, এনডিএ-র মাত্র এক। মহাগঠবন্ধনের ধরাশায়ী ১৫ প্রার্থীর মধ্যে সাত জন কংগ্রেসের, সাত জন আরজেডি-র। তবে, আরজেডি-র প্রার্থী-সংখ্যা যে হেতু কংগ্রেসের দ্বিগুণ ছিল, কাজেই কংগ্রেসের ব্যর্থতা প্রবলতর।
কোনও দলের সব প্রার্থীকে যদি ভোটপ্রাপ্তির হিসাবে সবচেয়ে বেশি থেকে সবচেয়ে কম, এ ভাবে সাজানো হয়, তা হলে প্রথম ও শেষ ২৫ শতাংশ প্রার্থী বাদ দিলে মাঝের যে ৫০ শতাংশ প্রার্থী অবশিষ্ট থাকেন, পরিভাষায় তাঁরা হলেন মিডব্যান্ড বা মধ্যম বর্গ। এই অংশটির প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ কত, তা দলের ফলাফলের একটা বড় নির্ধারক। স্বাভাবিক ভাবেই এনডিএ-র তুলনায় মহাগঠবন্ধনের মধ্যম বর্গের নিম্ন ও ঊর্ধ্বসীমা উভয়ই কম। কিন্তু, তার মধ্যেও কংগ্রেসের মধ্যম বর্গ আরজেডি-র তুলনায় তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কম। অর্থাৎ, জোটসঙ্গী হিসাবে কংগ্রেস আদৌ লাভজনক নয়। জাত ও ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি ভারতের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপটিকে যে ভাবে দখল করেছে, তাতে কংগ্রেসের মতো মূলগত সেকুলার দলের এ ভাবে সমর্থন-ভিত্তি খোয়ানো অস্বাভাবিক নয়।
নির্বাচনের ফলাফলের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত ভোটের হারের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, সেই ভোট কী ভাবে আসনে পরিণত হচ্ছে। এই নির্বাচনে এখানে এনডিএ বহু এগিয়ে। সে জোটের পক্ষে প্রতি এক শতাংশ ভোট পরিণত হয়েছে প্রায় ১.৮টি আসনে; সেখানে মহাগঠবন্ধনের পক্ষে প্রতি এক শতাংশ ভোট দিয়েছে ০.৪টি আসন। কেন দুই জোটের প্রাপ্ত ভোটসংখ্যার মধ্যে ফারাক সাড়ে আট শতাংশ-বিন্দু, আর আসনসংখ্যায় ফারাক ১৬৭— এখানেই নিহিত তার সবচেয়ে বড় কারণটি। বস্তুত, এনডিএ-র ছোট শরিক চিরাগ পাসোয়ানের এলজেপি (আরভি) দেখিয়েছে, মূলত দুসাধ জাতের অপেক্ষাকৃত ছোট সমর্থনভিত্তি নিয়ে, তুলনায় কম কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়ে কী ভাবে ভাল ফল করতে হয়। তাদের ক্ষেত্রে প্রতি এক শতাংশ ভোট প্রায় পৌনে চারটি আসন এনে দিয়েছে। জিতনরাম মাঝির নেতৃত্বাধীন হিন্দুস্থানি আওয়াম মোর্চা (সেকুলার) বা হাম(স) আর একটি উদাহরণ— মুশহর জাতির ছোট সমর্থনভিত্তি নিয়ে, মাত্র ছ’টি আসনে লড়ে পাঁচটিতে জিতেছে তারা; ১% ভোট তাদের এনে দিয়েছে প্রায় ৪.৩টি আসন।
এনডিএ-র দলগুলির ভোট গোটা রাজ্য জুড়ে অনেক সমান ভাবে বণ্টিত— জোটের বড় শরিক বিজেপি ও জেডি(ইউ)-এর সমর্থনভিত্তি বিস্তৃত, আর এলজেপি (আরভি) বা হাম(স)-এর মতো দল তাদের ছোট পকেটে দারুণ ফল পেয়েছে। মহাগঠবন্ধনের ভোট বণ্টিত অসম ভাবে— সমর্থক-পকেটে অনেক ভোট, আর অন্যত্র তাদের ভোট খুব কম। মহাগঠবন্ধনের সবচেয়ে বেশি ব্যবধানে জয়ী দশ প্রার্থীর ভোট ব্যবধানের সঙ্গে এনডিএ-র সবচেয়ে বেশি ব্যবধানে জয়ী দশ প্রার্থীর ভোট ব্যবধানের তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, মহাগঠবন্ধনের তেমন দশ জন প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবধানে জিতেছেন যিনি, তাঁর জয়ের মার্জিন ১৪.২২ শতাংশ-বিন্দু; এবং এঁদের মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যবধানে জিতেছেন যিনি, তাঁর মার্জিন ৫.২৪ শতাংশ-বিন্দু। এনডিএ-র ক্ষেত্রে এই দু’টি মার্জিন হল যথাক্রমে ৩৩.১১ ও ২৪.৪ শতাংশ-বিন্দু। অর্থাৎ, প্রতিপক্ষের শক্ততম ঘাঁটিতেও এনডিএ যথেষ্ট ভোট পাচ্ছে, কিন্তু মহাগঠবন্ধন ধরাশায়ী হচ্ছে। এনডিএ-র ৫০ শতাংশ জয়ী প্রার্থীর জয়ের মার্জিন যেখানে সাড়ে দশ শতাংশ-বিন্দুর বেশি, সেখানে মহাগঠবন্ধনের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি চার শতাংশেরও কম।
দিল্লি বিস্ফোরণ কি বিহারের ভোটে প্রভাব ফেলেছে? বিস্ফোরণটি ঘটে প্রথম ও দ্বিতীয় দফার মধ্যে। দেখা যাচ্ছে, বিস্ফোরণের তেমন কোনও প্রভাব ভোটের ফলে নেই— দু’দফাতেই ভোটবণ্টনের প্রবণতাগুলি মোটামুটি অভিন্ন। অন্তত, বিজেপির পক্ষে কোনও বড় ভোটবৃদ্ধি ঘটেনি। মাত্র একটা উদাহরণ থেকে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো বিপজ্জনক, তবে এই বিশ্লেষণ বলছে যে, ভোটের আগে আগে কোনও বড় ঘটনা ঘটলেই বিজেপির পক্ষে ভোটের হার বাড়ে, এমন বিশ্বাসে অবিচল থাকারও কারণ নেই।
এসআইআর-এর প্রভাব কতখানি পড়ল? প্রথম খসড়ায় নাম ছিল, অথচ চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন মোট ৩.৬৬ লক্ষ ভোটার। যে হেতু এই ভোটারের কোনও তালিকা নির্বাচন কমিশন দেয়নি, ফলে আসন অনুসারে তাঁদের বণ্টন দেখা যাচ্ছে না। তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি, এই বাদ পড়া ভোটাররা সবাই মহাগঠবন্ধনের প্রার্থীকে ভোট দিতেন, এবং তাঁরা এমন কেন্দ্রের ভোটার, যেখানে এনডিএ-র জয়ের ব্যবধান সামান্যই। তাতে মোটামুটি ২০টি আসনের ভাগ্য পাল্টাত, এনডিএ-র বদলে মহাগঠবন্ধন ক্ষমতায় আসত না। তবে, যে সব আসনে অল্প ভোটের ব্যবধানে ফয়সালা হয়, সেখানে ভোটার লিস্ট থেকে নির্দিষ্ট কিছু নাম বাদ পড়লে খেলা ঘুরে যেতে পারে, সে সম্ভাবনা আছেই। ভোটার লিস্টের সংশোধনের প্রক্রিয়ায় বিরোধীদের নজর রাখতেই হবে। কিন্তু পুরো খেলাটা সেখানেই লুকিয়ে আছে, এটা ধরে নিলে ভুল হবে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ভোট দিতে ঘরে ফেরানোর মতো কৌশলের দিকেও নজর রাখা জরুরি।
আসল কথা হল, বিজেপি-বিরোধী রাজনীতিকে অজুহাত খোঁজা বন্ধ করতে হবে; তাকাতে হবে বাস্তবের দিকে। এই কথাটি শুধু বিহারের জন্য নয়, সব রাজ্যের জন্যই সমান ভাবে প্রযোজ্য। পরের কথাগুলোও। যেমন, রাজ্যের ভোট-ম্যাপ দেখে যুদ্ধক্ষেত্র বাছতে হবে। বিহারে ৩৯টি আসনে ফয়সালা হয়েছে ৩ শতাংশ-বিন্দুর কম ব্যবধানে— এবং, তার বেশির ভাগই মহাগঠবন্ধন হেরেছে। এমন আসন চিহ্নিত করে সেখানে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। নিজেদের সমর্থক-পকেটে সীমাবদ্ধ না থেকে গোটা রাজ্যকে, অন্তত যে আসনগুলিতে চেষ্টা করলে জেতা যায়, সেগুলিকে লক্ষ্য হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে। একেবারে বুথ-স্তর অবধি ভোটের তথ্য পাওয়া যায়— তা বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য ভোটার চিহ্নিত করতে হবে। এবং, ভোটারের চাহিদা বুঝে যেমন প্রার্থী বাছতে হবে, তেমনই সেই অনুসারে আঞ্চলিক স্তরে রাজনৈতিক বয়ান স্থির করা জরুরি।
এর কোনও কাজই ভোটের দু’মাস আগে শুরু করলে চলে না। এই নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগের দিন থেকে পরের নির্বাচনের কাজ শুরু করতে হয়। সে কাজ পরিশ্রমের। বিজেপি-বিরোধীরা সেই রাস্তায় হাঁটতে রাজি কি না, সেটাই প্রশ্ন।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে