Beauty

আমি রূপে তোমায় ভোলাব

রূপের অধিকারী হওয়া বা রূপে বিভোর হওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ না হলেও, রূপের সঙ্গে গুণের অঘোষিত দ্বন্দ্ব চিরকালীন।

Advertisement

শ্রীদীপ

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২২ ০৪:৫৭
Share:

শরীরের রূপে, বিভঙ্গে মজে আছে মানুষের মন, সম্ভবত সৃষ্টির আদিপর্ব থেকেই। শরীর প্রবল উত্তেজক, সে আমাদের প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে ডাকে; আমাদের ইশারায়, ইঙ্গিতে জাগায়। আমরা সাড়া দিই। তবু, এ সমাজ ও সভ্যতা কিছুতেই অকপটে স্বীকার করবে না শারীরিক সৌন্দর্যের প্রভাব ও প্রতাপ। শারীরিক সৌন্দর্যের যথেচ্ছ স্বীকৃতি ও মর্যাদা সর্বকালে সর্বত্র থাকলেও, ‘তাকে’ আমরা যথেষ্ট সন্দেহের চোখেই দেখতে পছন্দ করি। রূপের সাধনায় প্রসাধন, পথ্য, ওষুধ ও অস্ত্রোপচারের অংশীদার ও খরিদ্দার হয়েও ‘রূপে ভোলা’-কে দুর্বলতা বা অসংযমের পরিচয় গণ্য করি। অথচ, নগ্নতার সৌন্দর্য এবং বিস্তারিত আবরণের সৌন্দর্য— মানবসভ্যতা দুইয়েরই তারিফ করে, আর যেমনটা কেউ পারে না।

Advertisement

রূপের অধিকারী হওয়া বা রূপে বিভোর হওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ না হলেও, রূপের সঙ্গে গুণের অঘোষিত দ্বন্দ্ব চিরকালীন। রূপবান মানুষ বা জীব, স্থান বা সামগ্রী কম গুণবান হয়েও অধিক আনুকূল্য পেয়ে থাকে, এমন ধারণা বিশ্বব্যাপী। কর্মক্ষেত্রে, গৃহে, বিবাদে রূপজনিত পক্ষপাতিত্বের নজির নাকি অগণন। তাই নান্দনিক, আনন্দদায়ক ও মনোরম হওয়া সত্ত্বেও, নৈতিকতার নিরিখে বাহ্যিক সৌন্দর্য অভ্যন্তরীণ ঐশ্বর্যের সামনে মাথা নত করে, বিশেষত প্রাচ্যের বহু মহৎজনের মতে তো বটেই।

অথচ, এই পার্থিব বহির্ভাগে শাণ দিতে গোটা দুনিয়া ব্যস্ত— লিঙ্গ শ্রেণি জাতি বর্ণ নির্বিশেষে। শারীরিক সৌন্দর্য কেবল কাম্য বা বাঞ্ছনীয় নয়, তা নিঃসন্দেহে ভোগ্য, ঈর্ষণীয়। অনেক ক্ষেত্রেই তা রূপচর্চার ব্যয়বহুল উপায়ে অর্জিত। তার পিছনে রয়েছে অঢেল সময়, অনুশীলন, নিয়ম, পরিচর্যা, কষ্টও। রয়েছে অসীম সংযম। অন্য দিকে রয়েছে প্রশস্ত অহং, নিত্য উন্মোচন, বলিষ্ঠ পেশি বা নমনীয় বাঁকের কাম-উত্তেজনা ও আস্ফালন, যৌবন ধরে রাখার আয়োজন। সবই ইন্দ্রিয়সুখ ও আকর্ষণ বৃদ্ধির বিপুল জোগাড় ও তার পণ্যায়ন। এ এক সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা— বহু কোটি টাকার নন্দন-প্রকল্প।

Advertisement

রূপে ভোলাটা কেবল নারী বা পুরুষের ক্ষেত্রেই সত্যি এমনটা নয়— তা স্থান ও পণ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সুন্দরের জয়। মানুষ বিপুল ব্যয় করে দামি অর্কিড কেনে ঘরের শোভা বাড়াতে, ফুলদানিতে ঘাসফুল শোভা পায় না। অনেকটা পথ পেরিয়ে লোকে লাদাখ বা নরওয়ে যায় আলো-ছায়ার অভাবনীয় খেলা দেখবে বলে। স্কুলজীবনের কাঙ্ক্ষিত কিশোর-কিশোরীই হোক বা রুপোলি পর্দার পছন্দের নায়ক-নায়িকা, বা প্রেমিক-প্রেমিকা, বা লালসা-কামনার কল্পিত নারী-পুরুষ— কেউই কুৎসিত নয়। বরং তাঁদের বাহ্যিক আকর্ষণই অনেক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত। এ-ও সত্যি যে, ‘সুন্দর’ কম-সুন্দরের প্রতি প্রভেদ আরোপ করে— সে যতই অন্যায় বা অন্যায্য হোক, তবু। আমরা যদিও ঠিক উল্টো কথাটাই বলতে অভ্যস্ত: গুণ, মেধা, আবেগই প্রকৃত উৎকর্ষ— রূপ নগণ্য ও নিমিত্তমাত্র।

সৌন্দর্যের এক অলীক আদর্শের স্বপ্ন দেখায় যে প্রসাধন-আবরণ-ভূষণ বাণিজ্য, সেই ইন্ডাস্ট্রির নিন্দা এক জিনিস, আর বাহ্যিক সৌন্দর্যের অধঃখাত আর এক। শ্বেত-প্রীতি ও পাশ্চাত্যের আরোপিত সৌন্দর্যের আদলে সব কিছুকে গড়ে তোলার প্রবণতার মধ্যে রয়েছে মজ্জাগত বর্ণবিভেদ ও যথেচ্ছ অনৈক্য ও ক্ষমতার প্রয়োগ, তা-ও চরম নিন্দনীয়। আর এটাও সত্যি যে, শারীরিক সৌন্দর্যের সেই চলতি আদল লালন-পালনের দায়ভার বহন করেছে নারী— পুরুষের দাবি মেনে, তাকে তৃপ্ত করতে। পুরুষ নির্দ্বিধায় সেই সুসজ্জিত শরীর ভোগ করে তার উপর মালিকানা জাহির করেছে সমাজে। এ সবই সমালোচনাযোগ্য। কিন্তু শিশু, পশুপাখি, প্রজাপতি, রামধনু, ফুল, পর্বতমালা— সুন্দর কিছু বা সুন্দর কাউকে দেখলে শরীরে মনে শিহরন জাগে ও আমরা যে উৎফুল্ল বোধ করি, তা অনস্বীকার্য। শুধু আমরা কেন, ময়ূরের পেখম বা বাবুই পাখির বাসা তো কেবল বাহুল্য নয়, তার মধ্যেও আছে নিজ প্রজাতির কাউকে আকর্ষণ করার প্রবণতা— সেও বাহ্যিক সৌন্দর্যের উপর নির্ভরশীলতার প্রমাণ।

তবু আমাদের এটা মেনে নিতে বাধে যে ‘সুন্দর’, সে যতই আত্মবাদী হোক— আমাদের সম্মোহন করে। দেখতে ভাল বিড়ালটার প্রতি আমাদের হৃদয় অধিক বিগলিত হয়, তাকে একটু বেশিই খেতে দিই, আদর করি। সুন্দরের প্রতি আমরা সদা দুর্বল। সৌন্দর্যের আলোয় আমাদের দুর্বলতাগুলো আত্মপ্রকাশ করে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা সৌন্দর্যের সেই অসীম ক্ষমতাকে অস্বীকার করি। শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে গিয়ে নিজেদের বোঝাই রূপে ভুলব না, মননে মুগ্ধ হব। অথচ, কেউ বা কিছু ভাল দেখতে হলে আমাদের বড়ই ভাল লাগে। অতটা ভাল দেখতে না হলে আমাদের যাত্রা ও গন্তব্য শুরু হয় সুন্দরের উদ্দেশে— নিজেকে ঘষেমেজে সুন্দরতর করে তোলার কাজে।

বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি পক্ষপাত কি শুধু বিয়ের বিজ্ঞাপনে, পত্রিকার প্রচ্ছদে, চলচ্চিত্রের পোস্টারে, না কি তার ঢালাও বিস্তার মনের গহনে ও গোপনে? সমাজ ও বাজার আমাদের শিখিয়েছে: সৌন্দর্যের সিংহাসন, তার কদর ও দীপ্তি— এই সবেরই আলাদা মর্যাদা। এ জগতে থেকেও, সুন্দর যেন এক অন্য জগতের বাসিন্দা। সৌন্দর্য এক চক্র, না কি এক সামাজিক, অর্থনৈতিক, নান্দনিক চক্রান্ত? না কি আমরা বিশ্বাস করি বাহ্যিক সৌন্দর্য আসলে আমাদের অন্তরাত্মারই ধারক বাহক ও প্রতীক? সুন্দর আমাদের সুরক্ষা ও শুভাকাঙ্ক্ষার আভাস দেয়, আর কুৎসিত বয়ে আনে বিপদ বা আতঙ্কের পূর্বাভাস। তাই বোধ হয় আমাদের মঙ্গলময় হিতৈষী দেবগণ সুশ্রী, রাক্ষসকুল কুশ্রী।

সমাজতত্ত্ব বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন