দেবভূমির তাবৎ গরিমাকে ধূলিসাৎ করে, তাকে ক্রমশ নরকভূমিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চলেছে কয়েক দশক ধরে। প্রবল ঔদ্ধত্যে হিমালয়ের দুর্গমতাকে উপেক্ষা করে, তার পাঁজর ফাটিয়ে চলেছে ‘উন্নয়ন’। তার অমূল্য প্রাকৃতিক আচ্ছাদন চরম নৃশংসতায় উপড়ে ফেলে রাস্তা চওড়া করা, বিশেষজ্ঞদের নিষেধ সত্ত্বেও অসংখ্য জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ, এবং ‘চারধাম যোজনা’ রূপায়ণে সেখানে যে দানবীয় ধ্বংসকার্য চলেছে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি চামোলীর তপোবন-রেনিতে ঋষিগঙ্গায় আকস্মিক তুষারধস আর হড়পা বানে মর্মান্তিক বিপর্যয় কি তারই অনিবার্য ফল ছিল না?
আসলে আমরা ভুলে যেতে চাইছি যে, হিমালয় পৃথিবীর কনিষ্ঠ পর্বতমালা। ভুলে যেতে চাইছি যে, তার ভাঙাগড়ার প্রক্রিয়াটি আজও অব্যাহত। ভঙ্গুর, ক্ষয়প্রবণ, ধসপ্রবণ এবং সে যে প্রবল ভূমিকম্পপ্রবণও, ভুলে যেতে চাইছি সেই সব কথাও। অথচ, গত কয়েক দশক ধরেই তো পরিবেশবিজ্ঞানী, ভূবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানীরা হিমালয়ের এই সমস্ত প্রবণতা সম্পর্কে সতর্ক করে আসছেন দেশের সরকারকে। কিন্তু জীববৈচিত্রের অনন্য আধার হিমালয়ের এই স্বাভাবিক প্রবণতাগুলিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সরকার তথাকথিত উন্নয়নের রথযাত্রা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। প্রাণের বিনিময়ে যার মূল্য বার বার চোকাতে হচ্ছে স্থানীয় পাহাড়বাসীদের, আর পেটের টানে সেখানে পৌঁছে যাওয়া দিনমজুরদের।
বছরখানেক আগে চামোলী যাওয়ার পথে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া পাথরের চাঁইয়ে পাথর-সরানো গাড়িচালকেরই মৃত্যুর ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম। হৃষীকেশ থেকে রেনি গ্রামে যাওয়ার পথে বহু জায়গায় দেখেছি, আকাশছোঁয়া বৃক্ষদের শিকড় উপড়ে বিশাল ক্রেন আর বুলডোজ়ার চালিয়ে পাহাড় ভাঙার দৃশ্য। বিপুল শব্দ ও বায়ুদূষণে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের ক্রমক্ষয়িষ্ণু বনভূমি, ছোট ছোট জনপদ। প্রসঙ্গত, বন দফতরের হিসেবই বলছে গত কুড়ি বছরে উত্তরাখণ্ডে পঞ্চাশ হাজার হেক্টর বনভূমি নির্মূল করা হয়েছে মূলত বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য। আর চামোলীর বিরোহি-তে তো পথের পাশে পাথরভাঙা মেশিন থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসা প্রবল দূষিত ধোঁয়ায় অসুস্থই হয়ে পড়েছিলাম। বাসিন্দাদের কাছে শুনেছিলাম, আশপাশের গ্রামে, বিশেষত শিশু ও প্রবীণরা ইদানীং ওই দূষণের জেরে শ্বাসকষ্টে ভুগছে। অথচ, দেশি-বিদেশি সভায় নেতা, মন্ত্রী, সরকারি কর্তাব্যক্তিরা প্রায়শই পরিবেশ রক্ষায় কী মনোমুগ্ধকর, গালভারী বচন ও প্রতিশ্রুতিই না আওড়ে চলেছেন!
এ সব যে কত অসার, মিথ্যে, তা ওই রেনি গ্রামে পৌঁছে আবারও ঝালিয়ে নিতে পেরেছিলাম। রেনি সত্তরের দশকের শেষ দিকে গর্জে উঠেছিল হিমালয়ের গাছপালা-সহ বিপুল অরণ্য সম্পদ, গ্রামবাসীদের বননির্ভর জীবন ও জীবিকা রক্ষা করতে। এইখানেই প্রথম গোবিন্দ সিংহ রাওয়াতের হাত ধরে গ্রামের বাসিন্দা গৌরা দেবীর নেতৃত্বে মহিলারা অরণ্যের গাছ জড়িয়ে ধরে ঠিকাদারদের বাধ্য করেছিলেন কুঠার হাতে ফিরে যেতে। জন্ম নিয়েছিল চিপকো আন্দোলন, যে আন্দোলনের মাহাত্ম্য পরে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। আশ্চর্য, সেই গ্রামেরই নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঋষিগঙ্গাতেই আছড়ে পড়ল ধ্বংস ও বিপর্যয়ের দণ্ড।
ওই ধ্বংস-কাহিনির কথাই শুনেছিলাম রেনি গ্রামে প্রয়াত গৌরা দেবীর পুত্র ৭৭ বছরের চন্দর সিংহ রানার মুখোমুখি হয়ে। তিনি সেই আন্দোলনের স্মৃতি সরিয়ে ক্ষোভ আর অপমানের কথা বলছিলেন। যে পাহাড় ও অরণ্য জল-খাদ্য-জ্বালানি ও রোগ নিরাময়ের ঔষধি, গবাদি পশুর খাদ্য, তথা তাঁদের প্রাত্যহিক চাহিদা মিটিয়েছে চিরকাল, আজ সরকার তাঁদের কাছ থেকে তা ছিনিয়ে নিচ্ছে।
গৌরা দেবীর সহযোদ্ধা কলাবতী, বচন সিংহরাও পাহাড় কেটে ফেলায় কী ভাবে চাষের জমি চলে যাচ্ছে, সেই ক্ষোভও উগরে দিলেন। বন ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় গত আট-দশ বছর ধরে বন ছেড়ে বেরিয়ে আসা পশুদের কারণে নামমাত্র খেতের ফসলও না পাওয়ার হতাশা তাঁদের গলাতে ঝরে পড়ছিল। স্বর ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছিল, গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক স্কুলটি বন্ধ হয়ে যাওয়া, কোনও হাইস্কুল না থাকা এবং কোনও কাজ না থাকার বেদনায়।
পাহাড় ধ্বংসের ধারাবাহিকতায় ২০১২-তে হিমাচলের লাহুলে প্রায় ১৫,০০০ ফুট উঁচুতে খার্দং গ্রামের তেনজিন নাহুলভির আশঙ্কার কথা মনে পড়ছে। ক্রমবর্ধমান গাড়ি, ট্রাক ইত্যাদির ধুলো, ধোঁয়ার কালো আস্তরণে কী ভাবে ঢাকা পড়ছে পাহাড়ে হিমবাহের দেহ। ধস নেমে সঙ্কীর্ণ হচ্ছে নদী গতিপথ। তাঁর আশঙ্কা ছিল, হিমবাহ সঙ্কুচিত হলে তার থেকে জোগানো জলের মাত্রা ঝোরা, নদীতে আরও কমে গেলে প্রবল জলকষ্টে পড়বেন তাঁরা।
আসলে সরকারি উদ্যোগই তো অসহায় পাহাড়বাসীদের অস্তিত্বের সঙ্কটকে ঘনিয়ে তুলছে। তাই নির্বিচারে পাহাড় ধ্বংসের অনিবার্য ভয়ঙ্কর এই পরিণতি প্রত্যক্ষ করলেও, প্রকৃতি ও মানব সম্পদের এমন বিপুল ক্ষয় হলেও তা অহঙ্কারী, উদাসীন সরকারকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করছে না।