সংবাদ স্বাধীনতার বধ্যভূমি
kashmir

কাশ্মীরে সাংবাদিকতার সীমা স্থির করে দিতে সক্রিয় পুলিশ-প্রশাসন

কাশ্মীরের প্রখ্যাত লেখক-সাংবাদিক গওহর গিলানিকে দিল্লির ইন্দিরা গাঁধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। তিনি জার্মানি যাচ্ছিলেন।

Advertisement

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৪:৪৪
Share:

কণ্ঠরোধ: শ্রীনগরের এক রাস্তায় টহলরত সশস্ত্র সিআরপিএফ। ১২ অক্টোবর, ২০২১। ছবি রয়টার্স।

যুবকের বয়স মেরেকেটে ২৩। সাংবাদিকতা করেন। সাংবাদিকতার ছাত্রও বটে। একটি পোর্টাল ম্যাগাজ়িনের শিক্ষানবিশ সাংবাদিক। এ রকম অনেকেই করেন— পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতেকলমে সাংবাদিকতার কাজও শেখা। মুশকিলটা হল, সাজাদ গুল নামে ওই সাংবাদিক কাশ্মীরের বাসিন্দা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, কাশ্মীরের বান্দিপোরা জেলার। মুশকিল কেন? কারণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বিক্ষোভের একটি ভিডিয়ো তিনি পোস্ট করেছিলেন। লস্কর-ই-তৈবার এক কমান্ডারকে গত ৩ জানুয়ারি শ্রীনগরে নিরাপত্তা বাহিনী সংঘর্ষে নিকেশ করে দিয়েছিল। সেই ঘটনার প্রতিবাদ বিক্ষোভে স্থানীয়দের সঙ্গে শামিল হন সেলিম প্যারে নামে ওই নিহতের আত্মীয়েরা। সাজাদ ওই ঘটনা রিপোর্ট করছিলেন। ওই দিন রাতেই এক সেনা অফিসারের ফোন আসে তাঁর কাছে। সাজাদ গুলকে বাড়ি থেকে বেরোতে বলা হয়। জানানো হয়, তিনি শীঘ্রই বাড়ি ফিরবেন। ভাইকেও সে কথা বলে যান গুল। কিন্তু তিনি সে রাতে ফেরেননি।

Advertisement

বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে সাজাদের বাড়ির লোক জানতে পারেন, তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, জনমানসে আতঙ্ক সৃষ্টি, জাতীয় সংহতি-বিরোধী বক্তব্য
পেশ, এমনকি হত্যার চেষ্টার মতো একাধিক মারাত্মক অভিযোগ আনা হয়েছে। কাশ্মীর পুলিশ বলেছে, তিনি জনসাধারণের শান্তি বিঘ্নিত করছিলেন এবং হিংসাত্মক ঘটনা ঘটাতে প্ররোচনা দিচ্ছিলেন। রীতিমতো বিবৃতি জারি করে পুলিশ বলে, সাংবাদিকতার ভেক ধরে গুল নাকি
সব সময়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকার-বিরোধী প্রচার চালান।

বান্দিপোরার জেলা আদালত গত ১৫ জানুয়ারি তাঁকে জামিন দেয়। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর জামিন হয়। কিন্তু তাতেও মুক্তি মিলল কোথায়! পুলিশ তাঁকে আর একটি মামলায় অভিযুক্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে জম্মু-কাশ্মীর জনসুরক্ষা আইন (পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট) প্রয়োগ করেছে। এটি এমন দমনমূলক আইন যার সাহায্যে যে কাউকে তিন থেকে ছ’মাস পর্যন্ত বিনা বিচারে জেলে আটকে রাখা যায়। এই আইনেই উপত্যকার হাজার হাজার যুবক-যুবতী, রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মী আটক রয়েছেন। গুলকে তাঁর বাড়ি থেকে দূরে জম্মুর কোট ভালওয়াল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণটা বোঝা খুব সহজ। তাঁর বাড়ির লোকজন, সহকর্মী-বন্ধুরা যাতে সহজে তাঁর কাছে পৌঁছতে না পারেন— তার ব্যবস্থা।

Advertisement

অর্থাৎ, এই দেশে এখন সাংবাদিকতা করতে হবে রাষ্ট্র বা শাসকদের দাবি মেনে। সাংবাদিকতার নীতি ঠিক করে দেবে পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনী। অবশ্য উপত্যকায় সাংবাদিকতা করা কি আগেও সহজ ছিল? ছিল না। বিশেষ করে ২০১৯-এর ৫ অগস্ট জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের সিদ্ধান্ত নিয়ে
কাশ্মীর রাজ্যকে রাতারাতি ভেঙে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে দেওয়ার পর থেকে প্রশাসনের হাতে প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ২০২০-র জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরের জন্য নতুন ‘মিডিয়া পলিসি’ তৈরি করে। সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের কাজটা প্রশাসনের পক্ষে আরও সহজ হয়ে যায়। এর পর থেকে উপত্যকায় অসংখ্য সাংবাদিকের হেনস্থা হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। যে সব খবর সরকারের মনোমত হয়নি বা প্রশাসনের ম‌নে হয়েছে সেই খবরে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ বিঘ্নিত হতে পারে, সে সব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে ডেকে পাঠানো, জিজ্ঞাসাবাদ করা, খবরের সূত্র জানতে চাওয়া, ভয় দেখানো থেকে শুরু করে গ্রেফতারি— সবই চলছে।

কয়েকটি ঘটনা বহু আলোচিত। কাশ্মীরের প্রখ্যাত লেখক-সাংবাদিক গওহর গিলানিকে দিল্লির ইন্দিরা গাঁধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। তিনি জার্মানি যাচ্ছিলেন। এখানেই হেনস্থার শেষ নয়। পরে তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইনের (ইউএপিএ) ধারা প্রয়োগ করে পুলিশ। অভিযোগ আনা হয়, তিনি কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদকে গৌরবান্বিত করছেন।

শুধু গিলানিই নন, মহিলা চিত্র সাংবাদিক মাসরাত জারা-র বিরুদ্ধেও কাশ্মীর পুলিশ ইউএপিএ প্রয়োগ করেছিল। ২৬ বছরের মাসরাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সমাজমাধ্যমে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ নানা বিষয় আপলোড করছেন যা উপত্যকার শান্তি বিঘ্নিত করছে। মাসরাত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের হয়েও কাজ করেন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, মাসরাতের যে পোস্ট নিয়ে পুলিশ ২০২০-র এপ্রিলে তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ-র ধারা প্রয়োগ করে এফআইআর দায়ের করে, সেটি তিনি তাঁর ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছিলেন ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে। মাসরাতের তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছিল, কয়েক বছর আগে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বুরহান ওয়ানির ছবি দেওয়া একটি পোস্টার তুলে ধরে একদল লোক বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। পোস্টারে উর্দুতে লেখা, ‘শহিদ বুরহান ওয়ানি’।

কাশ্মীরের সাইবার পুলিশ স্টেশন তাদের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে মাসরাত জারা-র ওই ছবির স্ক্রিন শট পোস্ট করে তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির অন্যান্য ধারা প্রয়োগের কথা জানায়। মজার কথা হল, পুলিশের ওই পোস্টে মাসরাতের সাংবাদিক পরিচয়ের কথা জানানো হয়নি। তাঁকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘এক জন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী’ বলে। ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ ওই পোস্ট দেওয়ার প্রায় ১৯ মাস পরে কেন ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হল, সেই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু মেলেনি!

শ্রীনগর বা শহরাঞ্চলে তা-ও এক রকম পরিস্থিতি। কিন্তু কাশ্মীরের বিভিন্ন জেলায় কার্যত প্রাণ বিপন্ন করে যে সব অকুতোভয় সাংবাদিক কাজ করে চলেছেন, তাঁদের অবস্থা সত্যিই করুণ! তাঁদের কথায় কথায় থানায় ডেকে পাঠানো হয়। নিরন্তর অভিযোগ উঠছে, কোনও বিক্ষোভ বা স্পর্শকাতর কোনও বিষয়ে খবর করতে যাওয়া সাংবাদিকদের উপর বার বার নির্মম হামলা চালাচ্ছে সেনাবাহিনী বা পুলিশ। ভয়ঙ্কর হুমকি দেওয়া হচ্ছে, নানা অছিলায় হেনস্থা করা হচ্ছে তাঁদের। এই হয়রানির প্রতিবাদ করেছে কাশ্মীর প্রেস ক্লাব-সহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। এমনকি, রাষ্ট্রপুঞ্জও কাশ্মীরে সাংবাদিক নিগ্রহের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে নানা সময়ে বিবৃতি দিয়েছে।

কিন্তু তাতে কী আসে যায়? নিজেদের ঢাক পেটানোর জন্য ছাড়া শাসক দলের কাছে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের কার্যত কোনও মূল্যই যে নেই, তা তো ইতিমধ্যেই প্রমাণিত! এই প্রসঙ্গেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের একটি মন্তব্যের কথা মনে করানো যাক। ২০১৯-এর অক্টোবরে নয়াদিল্লিতে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে এক আলোচনা সভায় ডোভাল বলেছিলেন, “সন্ত্রাসবাদীরা কোনও কিছু করার পরে সংবাদমাধ্যম যদি সেটা না দেখায় তা হলেই সন্ত্রাসবাদ ধ্বংস হয়ে যাবে।”

গণতন্ত্র ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন অজিত ডোভাল ও তাঁর নিয়োগকর্তারা। সাজাদ গুলদের তো তার মূল্য দিতেই হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন