যেন সহজে গায়ে না লাগে
TMC

নিজেদের ভাবমূর্তিতে কালি না লাগলেই নেতারা ‘নিরাপদ’

জাঠ নেতা ওমপ্রকাশ চৌটালা যেমন-তেমন রাজনীতিক ছিলেন না। দেশের প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী চৌধরি দেবী লালের পুত্র। পাঁচ বারের মুখ্যমন্ত্রী।

Advertisement
প্রেমাংশু চৌধুরী শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২২ ০৫:৫৯
Share:

লক্ষ্যমুখ: এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতির পর মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত বিজেপি নেতা ও সমর্থক, কলকাতা, ২ অগস্ট। পিটিআই

শিক্ষামন্ত্রী নন। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেই জেলে যেতে হল। পশ্চিমবঙ্গ নয়, হরিয়ানার কথা বলছি। ২০১৩ সালের কথা। হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোক দলের সুপ্রিমো ওমপ্রকাশ চৌটালা, তাঁর পুত্র অজয় চৌটালা, তিন সরকারি অফিসারকে বিশেষ সিবিআই আদালত ১০ বছরের কারাদণ্ডের শাস্তি দিল। অপরাধ? চৌটালা মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় হরিয়ানায় তিন হাজারের বেশি জুনিয়র বেসিক শিক্ষককে বেআইনি ভাবে নিয়োগ করা হয়েছিল।

Advertisement

জাঠ নেতা ওমপ্রকাশ চৌটালা যেমন-তেমন রাজনীতিক ছিলেন না। দেশের প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী চৌধরি দেবী লালের পুত্র। পাঁচ বারের মুখ্যমন্ত্রী। শেষ বার মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ই শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সুপ্রিম কোর্টে গিয়েও লাভ হয়নি। সাজা বহাল ছিল। চৌটালা জেলে গেলেন। তাঁর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোক দল ওরফে আইএনএলডি-র পতনও শুরু হল। জেল খেটে বছরখানেক আগে তিহাড় থেকে ছাড়া পেয়েছেন চৌটালা। এই এক দশকে হরিয়ানা বিধানসভায় আইএনএলডি-র বিধায়ক সংখ্যা মাত্র ১-এ নেমে এসেছে।

আইএনএলডি-র ভাগ্যাকাশে সূর্যাস্ত হলেও চৌটালার নাতি দুষ্যন্ত চৌটালা এখন হরিয়ানা সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী। তিনি আইএনএলডি থেকে বেরিয়ে জননায়ক জনতা পার্টি নামে নতুন দল গড়েছিলেন। বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকারে যোগ দিয়েছেন। বাপ-ঠাকুরদা শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি করে জেলে গেলেও, দুষ্যন্ত নিজের গায়ে তার কালি লাগতে দেননি। উল্টে নিজের তরুণ, শিক্ষিত, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন।

Advertisement

রাজনীতির খেলাটা এমনই। সেখানে কোন দলের নেতার বাড়ি থেকে কত টাকা উদ্ধার হল, তাতে ভোটের ফলাফল নির্ধারণ হয় না। রাজনীতিকরা দুর্নীতির কালি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারলেন কি না, না কি তাঁর বিরোধীরা পাকাপাকি ভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে চুনকালি লেপে দিতে পারলেন, সেটাই আসল।

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি, তাঁর ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা নগদ উদ্ধারের পরে বঙ্গের রাজনীতিতে এই খেলাটিই শুরু হয়েছে। বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস চাইছে, তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্বের গায়ে দুর্নীতির কালি লেপে দিতে। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইছেন, এই দুর্নীতি থেকে দূরে সরে, নিজের সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা, এখনও হাওয়াই চটি পরা ‘সততার প্রতীক’ ভাবমূর্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে। তিনি জানেন, পার্থ নন, বিরোধীদের আসল নিশানা তিনিই। তাই তাঁর গায়ে কেউ কালি ছেটাতে গেলে তাঁর কাছে আলকাতরা রয়েছে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মমতা। আদালতের রায়ের আগেই পার্থকে দল-সরকারের পদ থেকে সরিয়েছেন। তাঁর ভাইপো, তৃণমূলের নতুন প্রজন্মের মুখ অভিষেক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা বলে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের দল, সরকারে তুলে আনার বার্তা দিতে চাইছেন। তাঁকে বেআইনি গরু, কয়লা পাচারের কেলেঙ্কারি থেকেও নিজের গা-বাঁচানোর লড়াই করতে হচ্ছে। অর্পিতার বাড়ি থেকে কত টাকা উদ্ধার হল, সেটা রাজনীতিতে গৌণ। সেই টাকা উদ্ধারের কালিমা থেকে মমতা-অভিষেক নিজেদের বাঁচাতে পারবেন কি না, সেটাই মুখ্য বিষয়।

তৃণমূলের যেমন সবচেয়ে বড় পুঁজি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি, নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তিও তেমনই বিজেপির প্রধান অস্ত্র। এমন নয় যে, মোদী সরকারে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। খোদ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই কখনও অনিল অম্বানী, কখনও গৌতম আদানিকে বিশেষ সুবিধা, বিদেশে বরাত পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে রাহুল গান্ধী মোদীর বিরুদ্ধেই রাফাল চুক্তিতে অনিল অম্বানীকে ফয়দা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন। রাহুলের ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগানের মূল লক্ষ্যই ছিল, মোদীর ধোপদুরস্ত ভাবমূর্তিতে কালি ছেটানো।

রাহুল সফল হননি। মোদী নিজের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রেখে ফের ক্ষমতায় বসেছেন। রাজীব গান্ধী এইখানেই ব্যর্থ হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী পদে থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে বফর্স কেলেঙ্কারিতে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। পরবর্তী কালে আদালতের রায় যা-ই হোক না কেন, রাজীবের সঙ্গে বফর্স কেলেঙ্কারির নাম পাকাপাকি ভাবে জড়িয়ে থেকেছে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর জমানায় নীরব মোদী-মেহুল চোক্সীদের ব্যাঙ্ক প্রতারণা কেলেঙ্কারি হয়েছে। মামা-ভাগ্নে হিরের ব্যবসায়ী দু’জনেই নরেন্দ্র মোদীর পূর্বপরিচিত ছিলেন। তা সত্ত্বেও মোদী তাঁর ভাবমূর্তি নিষ্কলঙ্ক রাখতে এখনও পর্যন্ত সফল।

কোনও রাজনীতিককে তাঁর নিজের, দলের বা সরকারের দুর্নীতির কতখানি খেসারত দিতে হবে, তা বিরোধীদের উপরেও নির্ভর করে। পশ্চিমবঙ্গে স্কুলে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে যখন রাজ্য রাজনীতি উত্তাল, তার ঠিক আগেই উত্তরপ্রদেশে সাড়ে তিন হাজারের কাছাকাছি শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়েছে। সেই শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি। যোগী আদিত্যনাথের আমলেই বেআইনি নথি কাজে লাগিয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। তিন বছর ধরে তার তদন্ত চলছে। প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা বলেছিলেন, মধ্যপ্রদেশের সরকারি চাকরির নিয়োগে ব্যপম কেলেঙ্কারির থেকেও উত্তরপ্রদেশের শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি অনেক বড়। বাস্তবে ব্যপম কেলেঙ্কারির জেরে শিবরাজ সিংহ চৌহানকে মধ্যপ্রদেশে বিপাকে পড়তে হলেও, উত্তরপ্রদেশে যোগীর গেরুয়া বসনে কালি ছেটানো যায়নি। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত হবে আশ্বাস দিয়ে যোগী দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসেছেন।

মনমোহন জমানার কথাই ধরা যাক। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে টু-জি, কমনওয়েলথ, কয়লা খনি বণ্টন— নিত্যনতুন দুর্নীতির অভিযোগের ফয়দা তুলেছিল বিজেপি। আম আদমি পার্টি সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেই নিজের রাজনৈতিক ভিত তৈরি করেছে। কংগ্রেসকে তার খেসারত দিতে হয়েছে বটে, কিন্তু সেই ইউপিএ সরকারের প্রধান চালিকাশক্তি হলেও সনিয়া গান্ধীকে দুর্নীতির তির বিঁধতে পারেনি। গান্ধী পরিবার নিজেকে আড়ালে রেখেছে। অনেকে মনে করেন, রাহুল গান্ধী মনমোহন সরকারে মন্ত্রী হিসেবে কাজ করলে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতেন। বাস্তব হল, রাহুল মন্ত্রীর পদে থাকলে তাঁকে যাবতীয় দুর্নীতির দায়ও নিতে হত। রাহুল সে ভুল করেননি। উল্টে তিনি যে ঘোরতর ভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, তা বোঝাতে ইউপিএ সরকারের অধ্যাদেশ ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিত বলে অবস্থান নিয়েছিলেন। রাজনীতিকরা আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে সাংসদ-বিধায়কদের পদ ছাড়তে হবে বলে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল। মনমোহন সরকার আদালতের রায় নাকচ করতে অধ্যাদেশ জারি করেছিল। লক্ষ্য ছিল, লালুপ্রসাদের সাংসদ পদ বাঁচানো। রাহুল সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে অপমান করেছিলেন বলে অনেকের অভিযোগ। বাস্তবে রাহুল সে দিন নিজের স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্র্যান্ড তৈরি করেছিলেন। ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় ইডি-র তদন্তকে হাতিয়ার করে এখন সনিয়া-রাহুলের সেই ভাবমূর্তিতেই কালি ছেটানোর চেষ্টা করছে বিজেপি।

বঙ্গের রাজনীতিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে আদর্শ। জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। বামফ্রন্ট সরকারকে ‘চোরেদের সরকার’ বলায় বামফ্রন্ট সরকারের সে সময় খুব একটা ক্ষতি হয়নি। কিন্তু বুদ্ধদেব সে দিনই নিজের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির ব্র্যান্ডের কপিরাইট পেয়ে গিয়েছিলেন। সেই ভাবমূর্তিকে পুঁজি করেই বুদ্ধদেব উন্নততর বামফ্রন্টের স্বপ্ন দেখিয়ে অন্তত শেষ বার বাম সরকার তৈরি করতে পেরেছিলেন।

যাঁরা ভাবছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দুর্নীতি থেকেই তৃণমূলের পতন শেষ হবে, তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, তৃণমূল সারদা-নারদ কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও তৃতীয় বার ক্ষমতায় এসেছে। দুই কেলেঙ্কারিতে মমতার সৎ ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তা ভেঙে পড়েনি। বিজেপি বা অন্য বিরোধীরা তার ফয়দা তুলতে পারেনি। এ বার শুভেন্দু অধিকারী, মহম্মদ সেলিম, অধীর চৌধুরীরা মমতার ভাবমূর্তিতে ভাঙন ধরাতে চাইবেন। তা ঠেকাতে মমতা-অভিষেক পার্থ বা অন্যদের ঘাড়ে দায় ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। এটাই রাজনীতির লড়াই।

খেলা এখনও শেষ হয়নি। আসলে এ বারই খেলাটা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন