ভারতের গ্রোস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি), অর্থাৎ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের হিসাব, এবং তার ফলে জিডিপির বৃদ্ধির হার নিয়ে বেশ ভাল রকম প্রশ্ন উঠল। ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড (আইএমএফ) অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার পর পর দু’বছর ভারতের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস স্ট্যাটিসটিক্স, অর্থাৎ জাতীয় আয় সংক্রান্ত পরিসংখ্যান নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য পেশ করল। প্রতি বছর আইএমএফ তার সদস্য দেশগুলির অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সমীক্ষা করে, যা ‘আর্টিকল ফোর কনসালটেশন’ নামে পরিচিত। সেই সমীক্ষায় এ বছর আইএমএফ ভারতের জাতীয় আয় সংক্রান্ত পরিসংখ্যানকে তৃতীয় নিম্নতম রেটিং ‘সি’ দিল।
কেন এই অবনমন, তার ব্যাখ্যা দিয়ে আইএমএফ বলেছে, ভারত সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যানে ‘কিছু খামতি’ রয়েছে, যার ফলে ‘অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যের উপর নজর রাখার কাজ খানিকটা বিঘ্নিত হয়েছে’। ভারতের জাতীয় আয় সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের পাশাপাশি, এ দেশের মূল্যস্তর সংক্রান্ত তথ্য এবং সরকারি আর্থিক হিসাবও এ বার আইএমএফ-এর মূল্যায়নে ‘সি’ রেটিং পেয়েছে। সব মিলিয়ে, আইএমএফ কার্যত স্পষ্ট ভাবেই বুঝিয়ে দিল যে, ভারতের সরকারি পরিসংখ্যানের উপরে নির্ভর করে কোনও নীতির যথাযথ পর্যালোচনা করা কঠিন; ভারতীয় অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে ধারণা করাও কঠিন। আইএমএফ-এর আর্টিকল ফোর কনসালটেশনের মূল উদ্দেশ্যটিই ভারতের ক্ষেত্রে ব্যাহত হয়েছে।
আর্টিকল ফোর কনসালটেশন অবশ্য হালের ঘটনা— ‘ডেটা অ্যাডিকোয়েসি অ্যাসেসমেন্ট ফর সারভ্যালেন্স’ নামক নতুন ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে অর্থ ভান্ডারের সদস্য দেশগুলির সরকারি পরিসংখ্যানের গুণগত মান পরীক্ষার এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের গোড়ায়। কিন্তু, তার আগে থেকেই, বিশেষত ২০২৩ সালে, আইএমএফ একাধিক বার ভারতের তথ্য-ঘাটতির কথা উল্লেখ করেছিল।
অর্থ ভান্ডার ভারতের জিডিপি পরিসংখ্যান নিয়ে একাধিক নির্দিষ্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তার প্রথমটি হল বেশ পুরনো বেস ইয়ার সংক্রান্ত। ‘বেস ইয়ার’ হল সেই অর্থবর্ষ, যার নিরিখে বর্তমান অর্থবর্ষের প্রকৃত জিডিপি (অর্থাৎ, টাকার অঙ্কে আয়বৃদ্ধির হিসাব থেকে মূল্যবৃদ্ধির অংশটি বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে) হিসাব করা হয়। ভারতে বর্তমানে ২০১১-১২ অর্থবর্ষকে বেস ইয়ার ধরে জিডিপি হিসাব করা হয়। ২০১৫ সাল থেকেই এই বেস ইয়ারের নিরিখে হিসাব করা হচ্ছে। তার পর আর সরকার নতুনতর বেস ইয়ার ধার্য করেনি— কেন, সেই কারণ খুঁজলে ২০১৬ সালে নোট বাতিল, এবং তার পরের বছর জিএসটি প্রবর্তনের জোড়া ধাক্কার কথা বলতে হবে। সেই ঝাপটা সামলে ওঠার আগেই অতিমারি ও লকডাউনের কারণে অর্থব্যবস্থায় বিপুল ধাক্কা লাগে। সরকার জানিয়েছে, আগামী বছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষকে নতুন বেস ইয়ার হিসাবে ধরে জিডিপির অঙ্ক কষা হবে।
ভারতে প্রকৃত জিডিপি হিসাব করতে পাইকারি মূল্যসূচক ব্যবহার করা হয়, প্রডিউসার প্রাইস ইন্ডেক্স (পিপিআই) বা উৎপাদক মূল্য সূচক নির্ধারণ নয়— আইএমএফ-এর মতে এতে ভারতীয় পরিসংখ্যানের দ্বিতীয় দুর্বলতা। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সূচকটি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ উৎপাদক তাঁর পণ্যের জন্য কী দাম পাচ্ছেন, এই সূচকে তার প্রতিফলন ঘটে। অন্য দিকে, পণ্য বাজারে পৌঁছনোর পর তার মূল্যস্তরের প্রতিফলন ঘটে পাইকারি মূল্যসূচকে। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দুই সূচকের ফারাক বোঝা যাবে কৃষির কথা ভাবলে— ফসল শেষ পর্যন্ত কী দামে বিক্রি হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি এটা জানা যে, কৃষক তাঁর ফসলের জন্য কী দাম পাচ্ছেন। সেই তথ্যটি থাকলে তবেই কৃষকের স্বার্থের অনুকূল নীতি নির্ধারণ করা সম্ভব। এনডিএ সরকার যেখানে কৃষকের আয় বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করেছে, সেখানে পিপিআই বিষয়ে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের মতটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
জিডিপির হিসাব দু’ভাবে করা সম্ভব— উৎপাদনের দিক থেকে, এবং ব্যয়ের দিক থেকে। তাত্ত্বিক ভাবে, এই দু’টি আলাদা পথে জিডিপির যে অঙ্ক পাওয়া যাবে, সে দু’টি কাছাকাছি হওয়ার কথা। কিন্তু, ভারতের ক্ষেত্রে দু’টি হিসাবে অনেকখানি ফারাক থাকছে। আইএমএফ এ দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গত বেশ কয়েকটি ত্রৈমাসিকে দেখা গিয়েছে যে, ভারতে এই দু’টি হিসাবের মধ্যে ফারাক ৩ শতাংশ, বা তার বেশি। আইএমএফ-এর মতে, এই ফারাক বলছে যে, ব্যয়ের দিক থেকে জিডিপির হিসাব বা এক্সপেন্ডিচার অ্যাপ্রোচের তথ্যের পরিধি আরও বাড়াতে হবে, এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের হিসাব ঠিক ভাবে ধরতে হবে।
গত দেড় দশকে ভারতে তথ্য সংগ্রহের কাজে বড় ধরনের ঢিলেমি দেখা গিয়েছে, এবং তার ফলে জিডিপি পরিসংখ্যানের নির্ভুলতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। জনশুমারির কাজ যে দীর্ঘ হল, তা ভারতীয় অর্থব্যবস্থার তথ্যভান্ডারের বিপুল ক্ষতি করল। তা ছাড়াও, ভারতে উৎপাদন এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে উপস্থিত সব প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য পাওয়ার অন্যতম নির্ভরযোগ্য সূত্র ইকনমিক সেনসাস-ও শেষ বার পাওয়া গিয়েছিল ২০১৩-১৪ সালে। সেই ষষ্ঠ ইকনমিক সেনসাসের পর সপ্তম সেনসাসের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে; ২০২৩-এ সরকার ঘোষণা করেছিল যে, তার কাজ শেষ হয়েছে— কিন্তু সেই সেনসাসের ফলাফল এখনও গণপরিসরে প্রকাশিত হয়নি। সব মিলিয়ে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা সম্বন্ধে তথ্যভান্ডারের অবস্থা এখন অত্যন্ত খারাপ।
তার মধ্যে, ভারতের সুবৃহৎ অসংগঠিত ক্ষেত্র সংক্রান্ত তথ্যে ঘাটতি সর্বাধিক। সরকারি অনুমান হল, ভারতের জিডিপি/জিভিএ (গ্রোস ভ্যালু অ্যাডেড বা মোট যুক্তমূল্য)-র ৪৫-৫০% অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে আসে। কাজেই, এই ক্ষেত্র সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান না থাকলে এক দিকে যেমন জিডিপির অনুমানে তার প্রভাব পড়ে,তেমনই এই ক্ষেত্র সম্বন্ধে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ভারতে কৃষিবহির্ভূত অসংগঠিত ক্ষেত্র (নির্মাণ ক্ষেত্র বাদে) সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে অতীতের ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে (এনএসএস)-র পরিসংখ্যানে— এই ক্ষেত্রে সর্বশেষ সমীক্ষা দু’টি হয়েছিল যথাক্রমে ২০১০-১১ এবং ২০১৫-১৬ সালে। ২০২১-২২ সালে সরকার স্থির করে, কৃষি এবং নির্মাণ ক্ষেত্র বাদে বাকি অসংগঠিত ক্ষেত্র নিয়ে অ্যানুয়াল সার্ভে অব আনইনকর্পোরেটেড সেক্টর এন্টারপ্রাইজ়েস (এএসইউএসই) প্রকাশিত হবে।
পুরনো এনএসএস এবং নতুন এএসইউএসই সমীক্ষার তথ্য পাশাপাশি রাখলে কিছু উদ্বেগজনক প্রবণতা নজরে আসবে। এনএসএস সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ভারতে কৃষি ও নির্মাণবহির্ভূত অসংগঠিত ক্ষেত্রের আয়তন জিডিপির ৯%; কিন্তু এএসইউএসই পরিসংখ্যান বলছে, তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ শতাংশে। অন্য দিকে, এনএসএস-এর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫-১৬ সালে দেশের ১১ কোটির বেশি মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত ছিলেন; এএসইউএসই পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩-২৪ সালে সেই সংখ্যাটি ছিল ১২ কোটির কাছাকাছি। সরকার দাবি করে যে, ভারতে অসংগঠিত ক্ষেত্র আগের তুলনায় বেশি সংগঠিত হয়েছে, অতএব তার অবস্থার উন্নতি ঘটেছে— কিন্তু, এখনও দেশের ২০ শতাংশের বেশি শ্রমিক অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত, এই তথ্যটি কি সরকারি দাবির পরিপন্থী নয়?
ভারতের জিডিপির ৩০% আসে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসংস্থা (মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ়েস) থেকে। সেখানেও পরিসংখ্যানের ঘাটতি সাংঘাতিক। ১৯৯৮-এর চতুর্থ অর্থনৈতিক সেনসাসের পর থেকে এই ক্ষেত্র সম্বন্ধে আর কোনও সরাসরি পরিসংখ্যান নেই। ২০২৩-এর আর্টিকল ফোর কনসালটেশন-এ আইএমএফ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। কাজেই, জিডিপির নিরিখে ভারতীয় অর্থনীতির ‘জয়যাত্রা’র গল্পটি বলার আগে আরও বেশি নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জিডিপির হিসাব কষা জরুরি— এমন পরিসংখ্যান, যা আর্থিক ভাবে পশ্চাৎপদ মানুষের অর্থনৈতিক বাস্তবটিকে স্পষ্ট ভাবে দেখাবে।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে