পাহাড়-জঙ্গলের গাঁধী
Sunderlal Bahuguna

কোন মন্ত্রে দীর্ঘ সাত দশক মানুষ তাঁকে নেতা বলে মেনেছিল?

ক্ষমতার কাছে এই সব শান্তিকামী মানুষের চেয়ে অশান্তিজনক আর কিছু নেই।

Advertisement

জয়া মিত্র

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২১ ০৫:৪৪
Share:

উত্তরাখণ্ডের গ্রামে গ্রামে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত স্লোগান— “ক্যা হ্যায় জঙ্গল কা উপকার/ জমিন পানি ঔর বয়ার (বাতাস)/ জমিন পানি ঔর বয়ার/ ইয়ে হ্যায় জঙ্গল কা উপকার”— সুন্দরলাল বহুগুণা (ছবিতে) তৈরি করেননি। গ্রামীণ মানুষের মুখে মুখে ফেরা লাইনগুলোকে তিনি একটা ইতিহাস দিয়েছিলেন। গাছদের ‘রাখী বান্ধ্ ভাই’ বলে জড়িয়ে ধরার ঐতিহ্য অমৃতা দেবীর উত্তরকন্যাদের আলাদা করে শেখাতে হয়নি। শুধু সেই ভালবাসার সাহসকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন চণ্ডীপ্রসাদ ভট্ট, সুন্দরলাল বহুগুণার মতো পর্বতসন্তানরা।

Advertisement

সেই বহুগুণা চলে গেলেন। চুরানব্বই বছর বয়সে এক জন মানুষের যাওয়াকে অকালপ্রয়াণ বলা যায় না কোনও মতেই। কিন্তু কিছু মানুষ যখনই যান, তাঁদের জায়গাটা খালি হয়ে যায়; আর সেই শূন্যতা গভীর প্রয়োজনের সময়ে বুকে বেঁধে।

সুন্দরলাল বহুগুণার (১৯২৭-২০২১) নাম অনেকের কাছেই সত্তরের দশকে গঢ়বাল হিমালয়ের ‘চিপকো’ আন্দোলনের সমার্থক। কিন্তু কী ভাবে এক জন মানুষের জীবন তাঁকে সেই জায়গায় নিয়ে আসে, যাতে প্রায় সাত দশক ধরে একটা অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষ তাঁকে নিজেদের নির্ভরযোগ্য নেতা বলে মেনে নেন?

Advertisement

তেহরির ছোট গ্রাম থেকে লাহৌরে কলেজে পড়তে আসেন বহুগুণা। স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল সেই সময়ে তাঁকে রাজনীতিতে দীক্ষিত করেন গাঁধীর শিষ্য শ্রীদেব সুমন। ১৭ বছর বয়সে প্রথম কারাবাসে যান তরুণ ছাত্রটি। বেরিয়ে ফিরে আসেন স্বভূমিতে, আর গড়ে তোলেন ‘তেহরি রাজ্য প্রজামণ্ডল’— সমস্ত আবেগ নিয়ে মন ঢেলে দেন নিজের সমাজের কল্যাণমূলক কাজে। এরই মধ্যে পরিচিত হন আরও দুই একনিষ্ঠ গাঁধীবাদী মীরা বেন ও ঠক্কর বাপার সঙ্গে। ঠক্কর বাপার কাজকর্ম ও যাপন তাঁকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। বহুগুণা আরও মন দেন নিজের সমাজের মধ্যকার দুর্বলতাগুলো সরিয়ে ফেলে দৃঢ় করার দিকে। বিশেষ ভাবে জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতায়, কায়িক পরিশ্রমের মর্যাদা আর শিক্ষাবিস্তারের কাজে। প্রথম কাজটিতেই জোরালো বাধা আসে তাঁর নিজের উচ্চবর্ণ পরিবার, আত্মীয়, এমনকি বন্ধুদের থেকেও। সেই চাপের কাছে কোনও ভাবে হার না-মেনে একমন হয়ে এলাকার সমস্ত জাতের দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের জন্য তেহরিতেই তৈরি করেন ঠক্কর বাপা হস্টেল। একই সঙ্গে লেগে থাকেন তথাকথিত নিচু জাতির লোকেদের মন্দিরপ্রবেশের অধিকার দেওয়ার সামাজিক আন্দোলনে।

ক্রমে প্রত্যক্ষ রাজনীতি ছাড়েন সুন্দরলাল। গাঁধী আশ্রমের বিমলা নউটিয়াল ও তিনি সংসার পাতেন তেহরি গঢ়বালের ছোট সিলিয়ারা গ্রামে। গড়ে তোলেন ‘পার্বতীয় নবজীবন মণ্ডল’। মন ঠিক করেন নিজের ক্ষেত্রেই সমাজের সেবা করার জন্য।

ষাটের দশকে বিনোবা ভাবের আহ্বানে কয়েকটি দীর্ঘ পদযাত্রা করেন সুন্দরলাল ও তাঁর সঙ্গীরা। মাসের পর মাস ধরে হিমালয়ের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে গ্রামের মধ্য দিয়ে করা এই পদযাত্রাগুলো তাঁর ভাবনা ও কার্যধারায় আর একটি উত্তরণ ঘটায়। অসংখ্য নতুন মানুষের সঙ্গে কথা বলা, তাঁদের অভিজ্ঞতা শোনার পাশাপাশি তিনি চোখে দেখেন হিমালয়ের জঙ্গল ধ্বংসের ভয়ঙ্কর চেহারা। ওকজাতীয় যে সব চওড়া পাতার গাছ গঢ়বাল কুমায়ুন-সহ হিমালয়ের বিশাল অঞ্চলের ভূমি ও জলপ্রবাহের ব্যবস্থাকে রক্ষা করে এসেছে, তা ‘আধুনিকীকরণ’-এর নামে বিপর্যস্ত। ছোট ছোট পার্বত্য শহরগুলি স্ফীত হয়ে উঠেছে, তৈরি হয়েছে অসংখ্য পাকা রাস্তা। বড় পাতার গাছের প্রাচীন জঙ্গল হৃত হয়ে তৈরি হয়েছে সরলবর্গীয় বৃক্ষের বন, যা জল ধরে রাখতে পারে না, স্বাভাবিক জঙ্গলও না। ভূমিক্ষয় ঘটছে দ্রুত। জলের উৎসগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে। সরকারের ভুল নীতি ও সেই নীতিতে লাভবান কিছু লোকের সামনে জোর হারাচ্ছে পাহাড়ের প্রাচীন সমাজ। নানাবিধ লোভে নষ্ট হচ্ছে পার্বত্য সমাজের নীতিবোধগুলি— যে সব নীতি পাহাড়ের মানুষদের প্রকৃতির সঙ্গে এক সুশৃঙ্খলতায় স্থিত রেখেছিল।

বারে বারে এই সব পদযাত্রা এক দিকে যেমন তাঁর চোখ খুলে দিল প্রাকৃতিক নিয়ম লঙ্ঘিত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে, অন্য দিকে তিনি আরও ভাল করে বুঝতে পারলেন সংরক্ষণ-চেষ্টায় মেয়েদের গুরুত্ব। সামাজিক-পারিবারিক ধসের একটা বড় কারণ হিসেবে তিনি দেখলেন গ্রামে গ্রামে মদের নেশার করাল চেহারা। এই মাদক-বিরোধী অভিযানে মেয়েদের বিরাট বাহিনী যোগ দিল। মদের দোকান খোলার সরকারি চেষ্টার বিরোধে ষোলো দিন অনশন করলেন সুন্দরলাল। সেই আন্দোলনের চাপে সংলগ্ন পাঁচটি জেলাতে মদ নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হল সরকার, আর অসংখ্য মানুষ এগিয়ে এলেন তাঁর নেতৃত্বে জঙ্গল রক্ষার অভিযানে। পার্বতীয় সমাজের নবায়ন প্রচেষ্টার পাশাপাশি বহুগুণা প্রচার শুরু করলেন অরণ্য-আচ্ছাদনহীন পাহাড়ের নদী থেকে ভূমিধস ও আচমকা বন্যার বিপদ সম্পর্কে।

ফলে এটাই যেন স্বাভাবিক ছিল যে, ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গাঁধীর সরকার যখন অলকনন্দা নদী-কিনারে একটি জায়গা এক খেলনার সরঞ্জাম নির্মাতা কোম্পানিকে দিল, আর তারা জঙ্গল কেটে জমি হাসিল করতে এল, প্রতিটি গাছকে ঘিরে দাঁড়ালেন মেয়েরা, বাচ্চারা। যেন মাটি ভেদ করে প্রাচীন অরণ্যানীর রক্ষায় নবজন্ম নিল মেয়েদের প্রাচীন আন্দোলন। ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম থেকে গ্রামে। দূরদূরান্তে উড়ে গেল খবর বাতাসের পাখায় ভর করে, যে বাতাস অরণ্যের দান। পাঁচ বছর দাঁতে দাঁত দিয়ে লড়াইয়ের পর রক্ষা পেল জঙ্গল। ওই অঞ্চলে বৃক্ষচ্ছেদ নিষিদ্ধ হয় পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য।

তার পরও থামেনি লড়াই। বছরের পর বছর ধরে চলেছে তাঁর একের পর এক পদযাত্রা, যার দীর্ঘতমটি ছিল ১৯৮১-৮৩ সালে কাশ্মীর থেকে কোহিমার ৪৮৭০ কিলোমিটার যাত্রা। সংখ্যাতীত মানুষকে দেখেছেন আত্মীয়বোধে। বিজয় জড়ধারী, কুঁওর প্রসূনের মতো অসংখ্য তরুণ নেতা যোগ দিয়েছেন তাঁর সঙ্গে, তাঁর কথাগুলি গ্রাম থেকে গ্রামে গেয়ে বেড়িয়েছেন ঘনশ্যাম সৈলানির মতো অসামান্য গায়ক, হাজার হাজার মহিলা তাঁকে গ্রহণ করেছেন নিজেদের জন হিসেবে। তাঁর ডাকে যে কোনও আন্দোলনে জড়ো হয়েছেন পাহাড়ের মানুষরা। আর এই বছরের পর বছর ধরে যেখানেই শক্তিমানের তরফ থেকে অরণ্যছেদনের চেষ্টা হয়েছে, স্থানীয় মানুষরা ডাকামাত্রই সেখানে গিয়েছেন বহুগুণা। অজস্র বার অনশন করেছেন, গ্রেফতার হয়েছেন, ফিরে এসে আবার বসেছেন সেই একই কাজে। এই শীর্ণকায়, মৃদুভাষী, সম্পূর্ণ অহিংস আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষকে নিয়ে সাত দশক ধরে স্বস্তি পায়নি দেশের সরকার। দেশ-বিদেশের বহু বিজ্ঞানী, সমাজকর্মী ও সুস্থচিন্তার চিন্তকদের চাপে ১৯৮৩ সালে আইন হল হিমালয়ের ১০০০ মিটারের চেয়ে উঁচু কিংবা ত্রিশ ডিগ্রির চেয়ে বেশি ঢালু পাহাড়ে বাণিজ্যিক কারণে কোনও বড় গাছ কাটা যাবে না।

১৯৮১ সালে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন সুন্দরলাল বহুগুণা আর শান্ত ভাবেই ফিরিয়ে দেন সে প্রস্তাব— কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, “যখন আমার মায়ের শরীরের মাংস খসে যাচ্ছে হিমালয় পর্বতের মৃত্তিকার রূপে, আমি যোগ্য নই এই সম্মানের।” পরে ২০০৯ সালের পদ্মবিভূষণ-সহ বহু সম্মান ও পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন, বা বলা ভাল, সেই পুরস্কারসমূহই বরণ করেছিল তাঁকে। তাতে তাঁর কোনও সমস্যা হয়নি তেহরিতে গঙ্গা-ভীলাঙ্গনা সঙ্গমে বিরাট বাঁধের সাধ্যমতো বিরোধিতা করতে, পরাস্ত হওয়ার পরও হার না মানতে। এমনকি ২০১৩-তে কেদার বিপর্যয়ের পরও ৮৬ বছরের মানুষটি দৃঢ় ভাবে বলেন: “যদি এত বিপুল অরণ্য ধ্বংস না হত গঢ়বালে, ওই নদীধসে অমন অকল্পনীয় ক্ষয়ক্ষতি হত না।”

এমন মানুষদের নিয়ে ক্ষমতা স্বস্তিতে থাকে না। এই মানুষগুলো প্রকৃতি ও মানুষের মিলিত জীবনের সুস্থতার চেয়ে কোনও কিছুকেই বেশি মূল্যবান বলে বিশ্বাস করেন না। আর সে কথা বলাও বন্ধ করেন না। ক্ষমতার কাছে এই সব শান্তিকামী মানুষের চেয়ে অশান্তিজনক আর কিছু নেই।

তাঁদের মৃত্যুও তাই হয়তো আরও অনেক মানুষের মনে তরঙ্গ সৃষ্টি করে। ‘সুস্থ পরিবেশই একমাত্র স্থিতিশীল অর্থনীতি’— এই কথাটিকে মুছে ফেলা কঠিন হতে থাকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন