তৃণমূলের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সাফল্য স্বীকার করছেন বিরোধীরা
Mamata Banerjee

চোখ খোলারও একটি বছর

তৃণমূলকে বিপুল গরিষ্ঠতায় জিতিয়ে ২০২১-এর ৫ মে তৃতীয় বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রিত্বে শপথ নিয়েছিলেন মমতা। নির্বাচিত সরকার পুনরায় কাজ শুরু করে।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২২ ০৪:৩৮
Share:

গরিষ্ঠ: তৃতীয় বার জিতে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথগ্রহণ, রাজভবন, মে ২০২১

আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তাদের তৃতীয় দফার প্রথম বছর পেরোল। তৃণমূলকে বিপুল গরিষ্ঠতায় জিতিয়ে ২০২১-এর ৫ মে তৃতীয় বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রিত্বে শপথ নিয়েছিলেন মমতা। অর্থাৎ নির্বাচিত সরকার সে দিন থেকে পুনরায় আনুষ্ঠানিক ভাবে কাজ শুরু করে।

Advertisement

জ্যোতি বসুকে বাদ দিলে রাজ্যে মমতাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বার ধারাবাহিক ভাবে ক্ষমতায় আসীন। ১৯৭৭ থেকে সাত দফার বামফ্রন্ট জমানায় জ্যোতিবাবু মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন একাদিক্রমে পাঁচ বার। তার পরের দু’বার, ২০০১ ও ২০০৬-এর বামফ্রন্ট সরকার চলেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে। তাঁদের হারিয়ে তৃণমূলের সরকারে মমতার যাত্রা শুরু ২০১১ থেকে। এ বার নিয়ে তাঁর তিন দফা হল।

২০২১-এর ভোট মমতার কাছে সম্ভবত ছিল সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। ভোটের আগে তৃণমূলে ভাঙন, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের বাংলা ‘দখলে’ ঝাঁপিয়ে পড়া, অর্থ ও ক্ষমতার আস্ফালন সব মিলিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আগ্রহ-উৎকণ্ঠা-দোলাচলে ভরা। ওই প্রেক্ষাপট স্মরণে রাখলে সকলে একবাক্যে বলবেন, আসন সংখ্যা দূরের কথা, তৃণমূলের জয় নিয়েই বিভিন্ন মহলে সংশয় দানা বেঁধেছিল। দলও তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল।

Advertisement

কিন্তু সেই কঠিন ভোট-পরীক্ষায় বিরাট সাফল্যের পরেও গত এক বছরে তৃণমূল সরকারের যাত্রাপথকে খুব ‘মসৃণ’ বললে হয়তো পুরোপুরি ঠিক হবে না। সরকার পত্তনের প্রথম দিন থেকে তার লক্ষণ নানা ভাবে স্পষ্ট।

এর পিছনে বিপুল গরিষ্ঠতায় জিতে আসা সরকারকে ‘বিড়ম্বিত’ করে রাখার লক্ষ্যে বিরোধী দলের সুচিন্তিত রাজনৈতিক কৌশল অবশ্যই রয়েছে। সরকার কাজ শুরু করা মাত্র রাষ্ট্রপতির শাসন বা কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের দাবি তোলা, কথায় কথায় কেন্দ্র থেকে ‘তদন্তকারী’ দল পাঠানো, রাজ্যপালের তীব্র ‘সরকার-বিরোধিতা’, একের পর এক সিবিআই তদন্ত কোনওটিকেই হিসাবের বাইরে রাখা চলে না।

তবে এর পাশাপাশিই আছে রাজ্যের শাসকবর্গের একাংশের কার্যকলাপ। সরকারের ভাবমূর্তি তাতে ঘা খাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ, প্রশাসনকে নিয়েও। যার দায় অনিবার্য ভাবে এসে পড়ছে মমতার উপর। যে-হেতু তিনিই সরকার ও দলের শীর্ষে।

যদিও তৃণমূলের ভোট ভাঁড়ারে এর কোনও ‘বিরূপ’ প্রভাব বোঝা যায় না। সেটা হলে তাতে তৃণমূলের জনসমর্থনের রেখচিত্র এ ভাবে ঊর্ধ্বমুখী থাকতে পারত না। অনেকেরই ধারণা, এর প্রধান কারণ মমতার বিভিন্ন সামাজিক ও আর্থিক সুরক্ষা প্রকল্প। বস্তুত বিজেপি এবং সিপিএম উভয়েই কবুল করে, মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিভিন্ন প্রকল্প তাঁকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার পিছনে অনেকখানি কাজ করেছে। যার ‘মোকাবিলা’ করা যায়নি।

সামাজিক সুরক্ষার দিকগুলিতে মমতা গোড়া থেকেই বিশেষ নজর দিয়েছেন। সব কিছু একশো ভাগ ত্রুটিহীন রাখা বাস্তবে অসম্ভব। তবু জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সর্বস্তরে সরকারি সহায়তার দাবি আজ নিছক কথার কথা নয়। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায়ে সরকারের দেওয়া নানা সুযোগসুবিধা ক্রমেই প্রসারিত হতে দেখা যাচ্ছে। বড় হচ্ছে উপভোক্তাদের বৃত্ত।

এ বারের পর্বে ‘দুয়ারে সরকার’, ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’, ‘পাড়ায় পাড়ায় সমাধান’ ইত্যাদি তার আরও সম্প্রসারিত কিছু পদক্ষেপ। প্রশাসনকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া ছাড়াও এর আর একটি বড় রাজনৈতিক দিক হল, সমর্থনের ভিতটি নিয়মিত ‘পরখ’ করে রাখা।

২০১৯-এর লোকসভা ভোটে রাজ্যে বিজেপির কাছে আঠারোটি আসন হেরে বড় ধাক্কা খেয়েছিল তৃণমূল। বিধানসভায় বিরাট সংখ্যাধিক্যের পরেও ২০২৪-এর লোকসভা ভোটকে তাই মমতা হালকা ভাবে নেবেন না, সেটা স্বাভাবিক অনুমান। কারণ তার সঙ্গে যুক্ত থাকবে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর আগামী দিনের অবস্থান।

সে দিকে লক্ষ রেখেই যত বেশি সংখ্যক মানুষকে আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষায় জড়িয়ে নেওয়ার কাজটি যে মমতার অগ্রাধিকার, এটা বোঝা যাচ্ছে। আর তা করতে গিয়ে অধিক সংখ্যক মানুষের কাছে কিছু না কিছু সুবিধাও পৌঁছে যাচ্ছে। বিরুদ্ধ সমালোচনা যতই থাক, এর ‘ইতিবাচক’ দিকটি উড়িয়ে দেওয়ার নয়। ২০২১-এর মতো ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা একটি বিধানসভা ভোটের ফল থেকে সেই বার্তা যেমন বিরোধীরা পেয়েছেন, তেমন মমতাও ‘পরীক্ষিত’ পথ ধরেই এগোচ্ছেন।

তবে আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা ইত্যাদির দিকে তাকালে তৃতীয় দফার তৃণমূল সরকারের প্রথম বছরটিকে খুব উজ্জ্বল বলা যাবে না। বস্তুত চাপ যা এসেছে, তা মূলত এই সব ক্ষেত্র থেকে। তার উপর আছে শাসক তৃণমূলের একাংশের বিরুদ্ধে কিছু দুর্নীতির অভিযোগ। এর ফলে ‘সক্রিয়’ হয়ে ওঠার পরিসর পেয়ে যাচ্ছে বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকার। ‘তৎপর’ হয়েছে রাজভবনও।

ভোটে বিপর্যস্ত হওয়ার পর থেকেই আইনশৃঙ্খলাকে প্রধান হাতিয়ার করেছে বিজেপি। তৃণমূল সরকারের বর্ষপূর্তি তাদের কাছে সেই অভিযোগের ‘উদ্‌যাপন’। ভোটে হিংসার অভিযোগ সামনে রেখে শপথের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে রাজ্যপালের প্রকাশ্য মতভেদ ছিল তার একটি অভিমুখ। এ সব প্রশ্নে শাসক ও বিরোধীর মতভেদ থাকবেই। অভিযোগের ‘বাস্তবতা’ নিয়েও অনেক ক্ষেত্রে সংশয়ের অবকাশ থাকে। তা সত্ত্বেও কেন্দ্র, বিজেপি, রাজ্যপাল সকলের তরফেই বিষয়টি নিয়ে ‘লড়াই’ জারি আছে। মাত্রাও বেড়েছে।

কিন্তু আনিস-কাণ্ড, বগটুই-কাণ্ড, ধর্ষণ ও মৃত্যুর মতো আরও কিছু ঘটনা অবশ্যই সরকারের মাথাব্যথার বিষয়। শাসক দলের সংস্রব থেকে পুলিশ-প্রশাসনের বিচ্যুতি, অনেক কিছুই এখন সামনে। এর থেকে এক দিকে ক্ষমতাসীন পার্টির নিচুতলায় বেপরোয়া হয়ে ওঠা স্পষ্ট হয়। অন্য দিকে শাসক দলের ‘প্রশ্রয়পুষ্ট’দের সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের ‘অনৈতিক বোঝাপড়া’ থাকার এবং পুলিশ-প্রশাসনের কাজে ব্যর্থতা ও গাফিলতির সন্দেহ দুই-ই ঘনীভূত হয়।

এর কোনওটিই শাসকের ধর্ম হতে পারে না। তৃতীয় তৃণমূল সরকারের প্রথম বছরে এগুলি কাঁটার মতো। বিপুল সংখ্যাধিক্যে জিতে আসা সরকারের পক্ষে যা অনভিপ্রেত। শুধু যুক্তি-যুদ্ধে এর অবসান অসম্ভব। অনুচিতও।

মনে আছে, ২০১৩-র মে মাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যখন সবেমাত্র দুই পেরিয়ে তিনে পা দিচ্ছে, তখন এমনই এক বর্ষপূর্তির সময় তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। লগ্নি-কেলেঙ্কারি, সিন্ডিকেটের মতো নানা বিষয়ে তৃণমূলের লোকজনদের নাম জড়িয়ে পড়া নিয়ে বিরোধীরা তখন শাসক মমতাকে নিশানায় বিঁধছেন। সংবাদমাধ্যমে তা নিয়ে বড় বড় খবরও হচ্ছে।

মমতা সে দিন বলেছিলেন, “আমাদের দল স্বচ্ছ। সরকার চলছে স্বচ্ছতার সঙ্গে। চ্যালেঞ্জ করে বলছি, আমাদের লুকোনোর কিছু নেই। তাই দু’-একজন কে কী বলল, কী কুৎসা রটানো হল, তাতে আমাদের আসে যায় না।” ভোটের রাজনীতি বার বার প্রমাণ করে দেয়, কে কী বলল, তাতে মমতার দলের বিশেষ কিছু দুশ্চিন্তার কারণ নেই।

এক বছর আগে দু’শো আসনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে লড়তে নামা বিজেপি পর্যুদস্ত হওয়ার পরে এখন তাদের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে তাই অকপটে স্বীকার করতে হচ্ছে, “আমরা ক্ষমতায় আসার যোগ্য হইনি।” ভোটে লড়ার কৌশলটিও তৃণমূলের কাছে ‘শেখার’ পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। কেউ বলতেই পারেন, সরকারের বর্ষপূর্তির লগ্নে প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষনেতার এই পর্যবেক্ষণ এক অর্থে শাসকদের ‘ভরসাপূর্তি’ও বটে!

তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপে মনে হয়, তিনিও হয়তো উপলব্ধি করছেন ‘অল ইজ় নট ওয়েল’। তাই নিজের দলের লোকেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা কঠোর অবস্থান নিচ্ছেন। পুলিশ, প্রশাসনকে ভর্ৎসনা করে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন বার বার। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি তৃতীয় দফা সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তিতে আশার আভাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন