একুশ শতক তবে পঁচিশ পেরোল। পঁচিশের পূর্ণযৌবনে পৌঁছে অনেকেরই একটা আত্মজিজ্ঞাসা উপস্থিত হয়। একুশ শতকও যদি পিছন ফিরে তাকিয়ে জানতে চায়, কোথা থেকে এল সে, বিশ শতক কোথায় এসেছিল, আর সে-ই বা আজ কদ্দূর এল, কী উত্তর পাবে?
বিশ, একুশকে ‘অ্যাবসার্ড থিয়েটার’-এর চরিত্রের মতো পাশাপাশি ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল আয়ারল্যান্ডের এক প্রচলিত লোককাহিনি। সে দেশের পশ্চিম প্রান্তে এক চাষখেতে দাঁড়িয়ে দিগ্ভ্রান্ত পথিক নাকি কোনও স্থানীয় চাষির কাছে জানতে চেয়েছিল, ডাবলিন যাবে কোন পথ ধরে। চাষি নিতান্ত নিরুত্তাপ উত্তর দিয়েছিল, “আই উডন’ট স্টার্ট ফ্রম হিয়ার”, অর্থাৎ এতই দূর এবং জটিল পথ যে আমি হলে এখান থেকে শুরু করতাম না! যেন শুরু করার ক্ষেত্রে কোনও ‘চয়েস’ বা পছন্দ ছিল! ওই এক বাক্যেই পরিষ্কার— শুরুটাই কত ভুল হতে পারে, শেষ করা তো পরের কথা। তাই ভাবছিলাম, একুশ শতককে যদি ‘স্টার্টিং পয়েন্ট’ বেছে নেওয়ার ‘চয়েস’ দেওয়া হত, সে বেচারা বোধ হয় বিশের শেষ-কে বেছে নিতই না!
ভারতে ‘বিশের শেষ’ বলতেই শেষ দশক— যে দশক ভারতীয় মানসে অবধারিত ভাবে বয়ে আনে সে-যাবৎ অদেখা, না-ভাবা সব মুহূর্তের ইমেজ: রামজন্মভূমির রথযাত্রা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, কিংবা মণ্ডল আন্দোলনে জ্বলন্ত দেশ। ধর্ম ও জাতের প্রশ্নে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ‘সমাজতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রের প্রতি ক্রোধাক্ত বিস্ফোরণ। এই সব বিস্ফোরণই ঠেলে দিল দিল্লিতে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রথম সরকার গঠনের দিকে। অবশ্য ১৯৯৬ সালের মে মাসের সেই সংখ্যালঘু সরকারের মেয়াদ ছিল তেরো দিন। তবে কিনা, অভাবনীয়ের ক্বচিৎ কিরণে দীপ্ত বিজেপির জয়যাত্রা সেই তো সবে শুরু— অটলবিহারী বাজপেয়ীকে সামনে রেখে, লালকৃষ্ণ আডবাণীর কলকৌশলে ১৯৯৯ সালে দিল্লিতে পাঁচ বছরের জন্য প্রথম এনডিএ সরকার এসেই শতাব্দী পেরিয়ে দেশকে পৌঁছে দিল এক নতুন যুগে। এই সময়েই উল্কাসম উত্থান সেই নতুন নেতার, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী যিনি একুশে হবেন দেশের মহা-নেতা, ‘বিশ্বগুরু’।
এক শতক-শেষ থেকে অন্য শতকের প্রথম দশক— পর পর কার্গিল যুদ্ধ, গোধরা ও গুজরাত দাঙ্গা, মুম্বই তাজ হোটেল সন্ত্রাসী হামলা, আরএসএস-এর বহুপ্রতীক্ষিত রাজনৈতিক প্রাধান্য, সব মিলে এক অনাস্বাদিত, খানিকটা কল্পনাতীত, উচ্চতায় পৌঁছে গেল ভারতীয় হিন্দুত্ব রাজনীতি। তবে, এই ২০২৫ সালের আরএসএস শতবর্ষ পূর্তি উৎসব মনে পড়ায়— বিশ শতক ভারতকে যেখানে পৌঁছে দিয়েছিল, সেখান থেকে আজকের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের ঐতিহাসিক অভিযাত্রা ছিল কেবল একুশের যাত্রা শুরুর অপেক্ষা।
বিশ শতকের শেষে ভারতের ভোল পাল্টানো সত্তা-রাজনীতির জয়যাত্রা এত দিনে বহু-আলোচিত বিষয়। অঞ্চলভিত্তিক ও জাতভিত্তিক আইডেন্টিটি পলিটিকস-এর এই শিকড়ে চারিয়ে যাওয়ার ফল কী দাঁড়াল? কংগ্রেসের পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়া, বাম রাজনীতিকে খাদের কিনারে পৌঁছে দেওয়া, ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদকেই একমাত্র বিকল্প জাতীয় একতা বলে বোধ হওয়া— এই সব কিছু বিনি সুতোয় গাঁথা হয়ে গেল। সত্তা-রাজনীতির প্রশ্নের সঙ্গে বহুস্তরীয় বহুসংস্কৃতির সমাজে গণতন্ত্রের তৃণমূলীকরণও ছিল ওতপ্রোত জড়িয়ে। লক্ষ করার বিষয়, এই তৃণমূলীকরণ একেবারেই কোনও শ্রেণির প্রশ্ন হয়ে ওঠেনি, বরং তা ছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যেকার এত দিনের এলিট-সাবঅল্টার্ন ভাগাভাগির ফল। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের অভিযানকেও ও ভাবেই দেখতে হবে— দলের নামকরণের ঐতিহাসিকতাটিও খেয়াল করতে হবে বইকি।
এ আর কোনও নতুন কথা নয় যে, ভারতের গণতন্ত্রের আকার ও প্রকারে যে আজ এত আলাদা, তার কারণ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলিই ভিতর থেকে পাল্টে গিয়েছে, অথবা তাদের পাল্টানো হয়েছে। রাষ্ট্রের এই চরিত্র পরিবর্তনকে আমরা কথায় কথায় ফ্যাসিবাদ বলে থাকি। তবে ইতিহাসবিদ আর সমাজতাত্ত্বিকরা বলেন, এও গণতন্ত্রেরই এক বিবর্তিত রূপ। এই বিবর্তন বিশ শতকের উত্তরাধিকার এবং একুশ শতকের অর্জন। এরিক হবসবম বলেছেন, রাষ্ট্র চালায় যে সরকার আর সরকার নির্বাচন করে যে জনসমাজ, তারা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল ঠিকই, কিন্তু গণতন্ত্রের এই ক্রম-পরিবর্তনের ফল হল— সরকারকে আর জনসমাজের মঙ্গল বা উন্নতিতে দায়বদ্ধ থাকতে হল না। অর্থাৎ, নির্বাচন— যা হল গিয়ে গণতন্ত্রের অভ্রান্ত স্বাক্ষর— সেটার কাজ এখন দাঁড়াল কেবলমাত্র সরকারকে স্বীকৃতি বা ‘লেজিটিমেসি’ দেওয়া। শুধু সেটুকুর জন্যই সরকার জনগণের উপর নির্ভরশীল, আর কিছুর জন্য নয়: ‘উইদাউট নেসেসারিলি কমিটিং দেমসেলভস টু এনিথিং কংক্রিট’। এ সব দেখে তাঁর ইতিহাসবোধই পূর্বাভাস দিয়েছিল, কী হতে চলেছে। একুশ শতকের গণতন্ত্র বিরাট সংখ্যক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চলেছে, যার মোকাবিলার রাজনৈতিক পন্থা তার হাতে নাটকীয় রকমের কম (‘ড্রামাটিক্যালি ইল-সুটেড টু ডিলিং উইথ দেম’)। তার হাতে সুবিশাল ক্ষমতা, কিন্তু কী ভাবে সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে মানুষের ভাল করা যাবে, সেই অভিমুখ বা সেই অভিলাষ সে ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। তার হাতে আন্তর্জাতিক বিধিব্যবস্থার চমৎকার সমাহার, কিন্তু তার মধ্যে আর কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-আদর্শ নেই, সাম্যের আলো বা ন্যায়ের ছায়া নেই, কোনও মানবিক স্বার্থ রক্ষার দায় নেই। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ছত্রছায়ায় এই সব বিধিব্যবস্থা যারা করে, তারা হল বিশ্বের যত ‘ট্রান্স-ন্যাশনাল ফার্ম’ (কিংবা এক-এক দেশের মধ্যে কর্পোরেট বা ক্রোনি ক্যাপিটাল)— যাদের কাজ ‘টু বাইপাস পলিটিকস’।
গণতন্ত্রের এই পরিবর্তন কী আশ্চর্য নীরবেই না শুরু হয়েছিল! আজ ভারতের যে এসআইআর বা বিশেষ নিবিড় ভোটারতালিকা সংশোধনে কোটি কোটি মানুষের নাগরিকত্ব হরণের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে, তার গোড়াতে আছে শতক-শুরুর বছরগুলিতে ভারতের নাগরিকত্ব আইনকে নীরব মোচড়ে পাল্টে দেওয়ার সাফল্য। সমাজতাত্ত্বিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সদ্যপ্রকাশিত বইতে পড়ি, ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন কী ভাবে প্রথম নিয়ে আসে ‘ইললিগাল মাইগ্রান্ট’ শব্দবন্ধ, বন্ধ হয়ে যায় এই গোষ্ঠীর নাগরিকত্ব অর্জনের সম্ভাবনা।
আবার, অন্য দিকে গণতান্ত্রিক মতে নির্বাচিত নেতা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশ্বময় অভিবাসনযুদ্ধ ও শুল্কযুদ্ধে তৈরি হয় বহু দেশের সঙ্গে আমেরিকার নিজেরও গভীর নাগরিক বিপন্নতা। গণতন্ত্রের ধরাচূড়ার মধ্যে, উদারবাদের আচ্ছাদনে এই যে শীর্ষ-ক্যাপিটালের আস্ফালন, এর মধ্যে বাম ও সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিলোপের একটা ভূমিকা আছে, থাকতেই হবে। একের পর এক পরিবেশ শীর্ষসম্মেলনের নামে বিশ্বপরিবেশকে আরও দুর্দশার দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গেও এই একই জগৎব্যবস্থা যুক্ত। নেশন-স্টেট ও লিবারাল ডেমোক্র্যাসির নাম করে গণস্বার্থনিষ্পেষণের কর্মযজ্ঞ এখন একুশ শতকের অভিজ্ঞান।
একুশের পঁচিশ সালে বসে বাংলাদেশকে না ভেবে কি জো আছে! মনে পড়ে, গত শতকের শেষ দিকে কেমন সে দেশে প্রত্যহ জারি ছিল অপ্রত্যক্ষ কুরুক্ষেত্র। দেশটা যেন এক দিকে তার ফুটন্ত আগুন ঢাকাঢুকি দিয়ে রাখত, অন্য দিকে আগুন ওস্কানোর ব্রত নিয়ে তার দিকে ধেয়ে আসত পশ্চিমি ডলারস্রোত আর উপসাগরীয় ইসলামি মস্তিষ্কপ্রক্ষালক এজেন্টসমূহ। বিশ শতক মনে মনে বিলক্ষণ জানত যে, তার দিন ফুরাবে যবে, রাত্রি আঁধার হবে— ধর্মীয় সন্ত্রাসে। দীর্ঘ ইতিহাসের দৃষ্টিতে দেখলে ‘৯/১১’ও বিস্ময়কর নয়। বিশের শেষাংশ জুড়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ, সোভিয়েট ইউনিয়ন সকলেই পশ্চিম এশিয়ায় প্যালেস্টাইন থেকে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসের যে উর্বর ভূমি তৈরি করেছিল— তারই প্রত্যক্ষ ফসল। গত আড়াই দশক ধরে দুঃস্বপ্নময় দিন কেটেছে ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে, সিরিয়ার দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধে, গাজ়ায় ইজ়রায়েলের অবারিত ধ্বংসযজ্ঞে, পাকিস্তানের তীব্রতম রক্তক্ষরণে, মায়ানমারে অকল্পনীয় রোহিঙ্গা নির্যাতনে, আফগানিস্তানে তালিবান বিভীষিকায়, বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদের বর্বরতায়, এবং— ফিরে আসতে হয় ঘরে— ভারতীয় হিন্দুত্বের নব্যসন্ত্রাসে।
লক্ষণীয়, এ সবের মধ্যেই রাষ্ট্রের ভূমিকা থেকেছে প্রত্যক্ষ, এমনকি যে সমস্ত রাষ্ট্র আবার নিজেদের পরিচয় দেয় গণতান্ত্রিক, তাদেরও। সন্ত্রাসও এখন ‘বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’-এর মন্ত্রে মহিমান্বিত। এই ভয়াবহ তন্ত্র চলছে, চলবে। তাকে থামানোর জন্য কোনও বিশ্বশক্তি নেই, কোনও আন্তর্জাতিক মঞ্চ নেই: যদৃচ্ছ, সীমাহীন স্বৈরপ্রবাহ দশ দিকে উত্তাল। তা ছাড়া, থামানোর দরকারই বা কী, কেননা বিশ্বের একমেবাদ্বিতীয়ম্ যে শক্তি— বিশ্ববাজার— তার তো কোনও দায় নেই এ সব থামানোর, বরং তার অনেক কিছু লাভের আশা। সে জন্য অধিকাংশ রাষ্ট্রশক্তির মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ভালই। তবে কিনা, লাভ যে-হেতু ‘অর্থ’-এর লাভও বটে, ‘পরমার্থ’-এর অর্থাৎ ক্ষমতাভোগের লাভও বটে, প্রতিযোগিতা ঢুকে পড়ে স্বাভাবিক গতিতেই। পাশ্চাত্যেই হোক আর প্রাচ্যেই হোক, আমেরিকায় বা চিনে, দুনিয়া জুড়ে বনবন হিসেবের খেলা ছন্দে ছন্দে কত রং বদলায়। যদি যুদ্ধ কাজে লাগে। যদি বর্ণবিদ্বেষ বা জেনোসাইড চালিয়ে সুবিধা হয়। যদি লাগে মৌলবাদী ভাঙন-দাহন। সাধ্যমতো এ সবের লালনপালন চালাও— বিশ শতকই একুশকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে। দেখিয়ে দিয়েছে, মার্কেট আর মিলিটারি, দুই ঘনিষ্ঠ দোসর হয় প্রকাশ্যে রতিবিহারী, নয় প্রচ্ছন্নে অভিসারী। সুতরাং এদের তুষ্ট রাখো।
তবে একটা জায়গা আছে, যেখানে হয়তো একুশকে দেখে বিশ বলবে— তোমার প্রতি চাহিয়া বিস্ময়ের আর সীমা নাই! ইন্টারনেট ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স— বিশের শেষে ‘ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ’ কি জানত যে কত সত্বর তার সন্ততিসমাজ, মানুষের জীবনযাপন তো দূরস্থান, মানুষের মাথার ভিতরটাই পাল্টে নয়ছয় করে দেবে? জানত না বোধ হয়— তাই বিশ এখন একুশের জেন জ়ি-কে জানতে বুঝতে এবং কোনও মতে বাগে রাখতে দুনিয়াময় ছটফটিয়ে মরে।
তা, নতুন প্রজন্ম তো পুরনোকে টপকেই যায়, চিরকাল। একুশ শতক তার তারুণ্যেই দারুণ কৃতী। প্রথম কোয়ার্টার বা সিকি ভাগের রেকর্ড বলছে, বিশ শতককে অনায়াসে কয়েক গোল দিয়েছে সে। বিশ-বিশ্ব তাকে দেখে দেখে ভাবছে আঠারো শতকের সেই আমেরিকান রাষ্ট্রবিদ তথা প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস-এর উক্তি, কিছু আলাদা অর্থে: ‘পস্টারিটি! ইউ উইল নেভার নো হাও মাচ ইট কস্ট টু প্রিজ়ার্ভ ইয়োর ফ্রিডম!’ উত্তর-প্রজন্ম— তোমার [স্বেচ্ছাচারিতার] স্বাধীনতা বজায় রাখতে কতখানি দাম যে দিতে হয়েছে, তুমি জানবে না কখনও!
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে