Lalan Sheikh

একটি মৃত্যু আর অনেক প্রশ্ন

২১ মার্চ গভীর রাতে বগটুই গ্রামে ১০ জনকে কুপিয়ে-পুড়িয়ে মারার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ছিলেন তিনি। অভিযোগ উঠেছিল, লালনের নেতৃত্বেই দুষ্কৃতীর দল এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

Advertisement

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ ০৬:১০
Share:

সুপ্রিম কোর্টেরও বক্তব্য, হেফাজতে হিংসা ও মৃত্যুর ঘটনা সভ্যতার লজ্জা। ফাইল চিত্র।

সিবিআই হেফাজতে লালন শেখের অস্বাভাবিক মৃত্যু কয়েকটি গুরুতর প্রশ্নের মুখে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বীরভূমের বগটুই গ্রামে গত ২১ মার্চের গণহত্যার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত লালন শেখকে সিবিআই গ্রেফতার করেছিল ৪ ডিসেম্বর। তখন আপাত ভাবে তিনি সুস্থ। সেই লালনকে ১২ ডিসেম্বর ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল রামপুরহাটে সিবিআইয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পের শৌচাগারে। সিবিআইয়ের দাবি, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। লালনের পরিবারের অভিযোগ, সিবিআই হেফাজতে অত্যাচারের ফলেই মৃত্যু হয়েছে লালনের।

Advertisement

আমাদের দেশে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা হামেশাই ঘটে থাকে। ‘আত্মহত্যা’র অভিনব সব পন্থা আবিষ্কৃত হতে শোনা যায়। অভিযুক্তেরা দড়ি জোগাড় করে, দড়ি না পেলে পরনের গামছা, জামাকাপড় গলায় বেঁধেও শৌচাগার কিংবা জেলখানার সেলের গরাদে ঝুলে পড়ে! অথচ হেফাজতে মৃত্যুর একটি ঘটনাতেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাঁদের দায় এড়াতে পারেন না। সুপ্রিম কোর্টেরও বক্তব্য, হেফাজতে হিংসা ও মৃত্যুর ঘটনা সভ্যতার লজ্জা।

লালন শেখের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ২১ মার্চ গভীর রাতে বগটুই গ্রামে ১০ জনকে কুপিয়ে-পুড়িয়ে মারার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ছিলেন তিনি। অভিযোগ উঠেছিল, লালনের নেতৃত্বেই দুষ্কৃতীর দল এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ওই দিনই রাতে তৃণমূল নেতা তথা রামপুরহাটের বড়শাল পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখ খুন হয়ে যান। সেই ঘটনারও সাক্ষী ছিলেন ভাদুর ‘ডান হাত’ বলে পরিচিত লালন। হাই কোর্টের নির্দেশে, দুই ঘটনারই তদন্ত চালাচ্ছে সিবিআই। স্পষ্টতই, দু’টি মামলাতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারতেন লালন শেখ।

Advertisement

লালনের বাড়ির ক্লোজ়ড সার্কিট টিভি ক্যামেরার হার্ড ডিস্কের সন্ধানে সিবিআই তদন্তকারীরা তাঁকে নিয়ে ওই ১২ ডিসেম্বর বগটুই গ্রামে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁরা গোটা ঘটনার পুনর্গঠন করছিলেন বলে জানা যাচ্ছে। সেই হার্ড ডিস্ক কিন্তু এখনও পাওয়া যায়‌নি। ২০২০ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নির্দেশ দেয়, হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করার আগে মৃত্যুর কারণ বলা যাবে না। লালন শেখের ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয়নি। সিবিআই আগেই জানিয়ে দেয়, লালন আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু নিজেদের হেফাজতে থাকা লালনের মতো এ রকম এক গুরুত্বপূর্ণ অভিযুক্তকে কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রাখার জন্য কী ব্যবস্থা হয়েছিল, তা পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আগে জানা যাবে না। শৌচাগারের বাইরে তাঁর পাহারায় রাজ্য পুলিশের এক কর্মীও ছিলেন বলে জানা যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, সিবিআইয়ের ওই অস্থায়ী ক্যাম্প প্রহরার জন্য যে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল, তাদের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে কী ছিল।

এই প্রসঙ্গেই বিচারপতি ডি কে বসু বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি মামলার প্রসঙ্গ উল্লেখ্য। ১৯৯৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট ওই মামলার রায়ে কাউকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে ১১ দফা নির্দেশনামা জারি করে, যা ‘ডি কে বসু গাইডলাইন’ বলে প্রসিদ্ধ। ওই নির্দেশনামা অনুসারে গ্রেফতার হওয়া বা কয়েদ হওয়া অভিযুক্তের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে নানা রক্ষাকবচের কথা বলে সুপ্রিম কোর্ট।

বলে বটে, কিন্তু মানে কে? ভিআইপিদের কথা আলাদা, কিন্তু সাধারণ অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে কি তা পুঙ্খানুপুঙ্খ মানা হয়? ভুক্তভোগীরা জানেন, তা বহু ক্ষেত্রেই মানা হয় না। আগে ধরলেও খাতায়কলমে গ্রেফতারি পরে দেখানো, এক জায়গায় ধরলেও অন্য জায়গার কথা লেখা, স্বীকারোক্তি আদায়ে হেফাজতে অত্যাচার— এ সব তো নিত্যনৈমিত্তিক অভিযোগ। মজার কথা, পুলিশ বা অন্য এজেন্সিগুলি ভালই জানে যে, হেফাজতে স্বীকারোক্তির কোনও মূল্য আদালতের কাছে নেই। তা সত্ত্বেও নির্বিচারে ‘থার্ড ডিগ্রি’ প্রয়োগ করা হয়, যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ‘স্বীকারোক্তি’ থেকে অন্য নানা সূত্র পাওয়া যায়।

জানা নেই, লালনের ক্ষেত্রেও কোনও ‘বড়’ বা ‘প্রভাবশালী’র নাম বার করার ব্যস্ততা সিবিআইয়ের ছিল কি না। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁর সঙ্গে ‘বাড়াবাড়ি’ করা হয়নি, সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন ওঠে, শৌচাগারের শাওয়ারের পাইপে গামছা বেঁধে ঝুলে পড়ে আত্মঘাতী হতেও তো যথেষ্ট সময় লাগার কথা! অতটা সময় বাইরে রক্ষীরা লালনকে দিলেন কেন!

সারা দেশে হেফাজতে মৃত্যু এবং ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে ২০২২-এর ২৬ জুলাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই সংসদে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের থেকে পাওয়া তথ্য পেশ করেন। ২০২০-র ১ এপ্রিল থেকে ২০২২-এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত হিসেব: হেফাজতে মৃত্যুর নিরিখে উত্তরপ্রদেশের পরেই পশ্চিমবঙ্গ। ২০২০-২১’এ এই রাজ্যে হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ১৮৫। ২০২১-২২’এ এই সংখ্যা ২৫৭। যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৪৫১ এবং ৫০১।

লালন শেখের মৃত্যু ঘিরে রাজনৈতিক চাপানউতোর এখন তুঙ্গে। নিরপেক্ষ তদন্তে তাঁর এই অপমৃত্যুতে দিনের শেষে লাভ কার, তা সামনে আসবে কি? এই অপমৃত্যু বগটুইয়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে না তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন