নির্যাতিতার প্রশ্ন

সালিশির রায়গুলি কিন্তু বলিয়া দেয়, বিবাহিত মহিলা শুধুমাত্র স্বামীর সম্পত্তি নহেন, সংশ্লিষ্ট গ্রাম কিংবা জাত-গোষ্ঠীরও সম্পত্তি। তাহাদের সুনাম রক্ষার দায় একান্ত ভাবেই নারীর ‘সদাচরণ’-এর উপর নির্ভরশীল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৮ ০১:১৪
Share:

প্রশ্ন তুলিয়াছেন খানাকুলের ধরমপুরের নির্যাতিতা। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, প্রাসঙ্গিকও বটে। সুপ্রিম কোর্ট বলিয়াছে পরকীয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ নহে, কিন্তু পাড়া বা গ্রামের মাতব্বরি তাহাতে বন্ধ হইবে কি? প্রশ্ন তাঁহার একার নহে, বরং অগণিত নারীর, যাঁহারা পরকীয়া চালাইবার ‘অপরাধ’-এ সেই মাতব্বরির শিকার হইয়া থাকেন— কখনও ত্রিপুরায়, কখনও খানাকুলে, কখনও লাভপুরে। তাঁহাদের মধ্যে কেহ গ্রামছাড়া, কেহ লাঞ্ছিত, কেহ ধর্ষিত, আবার কেহ মাতব্বরির মাত্রা সহ্য করিতে না পারিয়া আত্মঘাতী। স্বাভাবিক যে, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও তাঁহাদের নিশ্চিন্ত করিতে পারিবে না। কারণ তাঁহারা জানেন, আদালতের আলোক দেশের প্রত্যন্ত কোণগুলিতে পৌঁছায় না। যেমন আদালত কর্তৃক সালিশি সভাকে বেআইনি ঘোষণা করিবার রায়টি এখনও পৌঁছায় নাই। সেই রায়কে অগ্রাহ্য করিয়া আজও মহিলাদের চারিত্রিক শুদ্ধতা বজায় রাখিবার কর্তব্যটি সাগ্রহে নিজ হস্তে সারিয়া থাকে সালিশি সভা এবং গ্রামের মাতব্বররা।

Advertisement

বস্তুত, পরকীয়া সংক্রান্ত ঘটনা লইয়া বিভিন্ন সালিশির রায় শুনিয়া বোধ হয়, পরকীয়ার প্রশ্নে স্বামীর ভূমিকাটিও গৌণ, গ্রাম এবং গোষ্ঠীর সুনামই প্রধান। পরকীয়া প্রশ্নে ৪৯৭ ধারাটি লইয়া সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল এই যে সেখানে মহিলাদের পুরুষের সম্পত্তি গণ্য করা হইয়াছিল। সালিশির রায়গুলি কিন্তু বলিয়া দেয়, বিবাহিত মহিলা শুধুমাত্র স্বামীর সম্পত্তি নহেন, সংশ্লিষ্ট গ্রাম কিংবা জাত-গোষ্ঠীরও সম্পত্তি। তাহাদের সুনাম রক্ষার দায় একান্ত ভাবেই নারীর ‘সদাচরণ’-এর উপর নির্ভরশীল। পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক তো বটেই, তাহাকে ঘরে বসাইয়া দুই-চারিটি কথা বলাও সেই সদাচরণের পরিপন্থী। পাপক্ষালনের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই তাঁহার প্রাপ্য। সর্বোচ্চ আদালত যতই বলিয়া থাকুক, পরকীয়াকে অপরাধ বলা আসলে পশ্চাৎমুখী চিন্তার পরিচয়, ব্যক্তিমর্যাদার ও নারীর সমানাধিকারের বিরোধী, তাহা নিতান্তই আদালতের ভাষা। যাহারা নিজ পশ্চাৎমুখী চিন্তাধারাকে সযত্নে লালন করিতে চাহে, সেই তথাকথিত সমাজরক্ষকদের কানে আদালতের কথা প্রবেশ করিবে কেন? সুতরাং, তাহারা দাপটে বলিতে পারে, এমন কাণ্ড (পরকীয়া) ফের ঘটিলে ফের চুল কাটিয়া দিব। অর্থাৎ, এই রায় লইয়া যতই মাতামাতি হউক, মাতব্বরি তাহার জায়গাতেই অনড় থাকিবে।

প্রশাসনের দিক হইতে দেখিলে, মাতব্বরির এই দাপট নিঃসন্দেহে বড় সঙ্কট। আদালত তাহার রায়ের মাধ্যমে নবযুগ সূচনা করিতে পারে, আইন প্রণয়নের পথটি দেখাইতে পারে। আইনসভা আইন পাশ করিতে পারে। কিন্তু সেই আইন সর্বত্র মানা হইতেছে কি না, তাহা একান্তই শাসনবিভাগের দায়িত্ব। নবান্নের প্রশাসনিক কেন্দ্রে বসিয়া খানাকুল তথা পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র সেই রায় প্রতিষ্ঠার কাজ সম্ভব নহে। সে ক্ষেত্রে প্রশাসনের সর্বনিম্ন স্তর অর্থাৎ পঞ্চায়েতের হস্তে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব হইতেছে কি না দেখা জরুরি। কেবল পরকীয়া নহে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রশাসনকে কার্যত অগ্রাহ্য করিয়া গ্রামীণ শাসনের দায়িত্বটি স্থানীয় কিছু ক্ষমতাবানের হাতে কুক্ষিগত থাকিবার বহু নজির মিলিয়া থাকে। ভোটবাক্সের তাগিদে প্রশাসন নড়িয়া বসে না। উটপাখি হইবার এই প্রবণতা দ্রুত বন্ধ হওয়া দরকার।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন