প্রতীকী ছবি।
রবিশঙ্কর প্রসাদ প্রশ্ন করিয়াছেন, ‘সাংবিধানিক নৈতিকতা’ বস্তুটি ঠিক কী? তাহা কি যথাযথ ভাবে সংজ্ঞায়িত হইয়াছে? আইনমন্ত্রীর পরামর্শ, এক বিচারপতির নিকট সরকারের কোনও সিদ্ধান্ত ‘সাংবিধানিক নৈতিকতা’র মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ না হইলে অন্য বিচারপতিরাও সে বিষয়ে একমত হইবেন, নৈতিকতার সংজ্ঞাকে তেমন ভাবেই বাঁধিয়া লওয়া প্রয়োজন। এমন সংশয় অস্বাভাবিক নহে যে, ইহা যতখানি প্রশ্ন বা পর্যবেক্ষণ, তাহার অধিক শ্লেষোক্তি। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সাংবিধানিক নৈতিকতার গুরুত্বের কথা একাধিক বার আসিয়াছে। সমকামিতাকে অপরাধের তালিকা হইতে বাদ দেওয়ার প্রশ্নেই হউক বা শবরীমালায় মহিলাদের প্রবেশাধিকারের প্রশ্নে, দেশের শীর্ষ আদালতের অবস্থান ‘পপুলার মরালিটি’ বা ‘গণ-নৈতিকতা’র বিপ্রতীপ। অর্থাৎ, সমাজ যাহাকে ‘নৈতিক’ বলিয়া জ্ঞান করিয়াছে, সংবিধানের ব্যাখ্যা করিয়া আদালত জানাইয়াছে, প্রকৃত প্রস্তাবে তাহা নৈতিক নহে। বরং, সমাজ যে সিদ্ধান্তের পথরোধ করিতে বদ্ধপরিকর, সংবিধান তাহাকেই মান্যতা দেয়। রবিশঙ্কর প্রসাদ প্রধানত রাজনীতিক।
অতএব, সমাজের নৈতিকতার ঊর্ধ্বে সাংবিধানিক নৈতিকতাকে ঠাঁই দেওয়া হইলে তাঁহার মনে প্রশ্ন জাগিতেই পারে। কিন্তু, ঘটনাচক্রে আর এক রাজনীতিক— উত্তরপ্রদেশের দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ— একই দিনে জানাইলেন, তিনি অযোধ্যার জেলাশাসককে একখণ্ড ভারতীয় সংবিধান উপহার দিতে চাহেন। স্মরণ করাইয়া দিতে যে প্রশাসক হিসাবে তাঁহার দায়বদ্ধতা শুধু সংবিধানের প্রতি, জনতার আবেগ বা শাসকের রাজনৈতিক তাগিদের প্রতি নহে। ধর্মসভা উপলক্ষে অযোধ্যায় বিপুল গৈরিক সমাবেশ হইল, এবং মন্দির নির্মাণের প্রবল দাবি উঠিল। বিতর্কিত জমিতে কী হইবে, সেই সিদ্ধান্তটি সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। সিদ্ধান্ত না হওয়া অবধি বিতর্কিত অঞ্চলে কোনও রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কার্যকলাপ বন্ধ রাখাই প্রশাসনের কর্তব্য। সংবিধান তেমন নির্দেশই দেয়। অতএব, এই জমায়েতটিকে ঠেকাইবার দায়িত্ব ছিল উত্তরপ্রদেশ সরকারের, অযোধ্যার স্থানীয় প্রশাসনের। জেলাশাসক বলিয়াছেন, এত মানুষকে ঠেকাইবার সাধ্য তাঁহার নাই। আজাদ তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিতে চাহেন যে সংবিধানের সম্মান রক্ষার সামর্থ্য যদি না-ই থাকে, তবে দায়িত্ব হইতে সরিয়া দাঁড়ানোই বিধেয়।
সমাপতন নহে। ২৬ নভেম্বর ভারতের সংবিধান দিবস। সেই উপলক্ষেই প্রধান বিচারপতি স্মরণ করাইয়া দিলেন, সংবিধানের পথ হইতে বিচ্যুত হইলে তাহার মূল্য চুকাইতে হইবে। লক্ষণীয়, সংবিধানের মতই শেষ কথা কি না, সেই প্রশ্নের দুই প্রান্তের দুইটি অবস্থান। এক দিকে আছেন ক্ষমতাসীন মন্ত্রী। অন্য দিকে, বিরোধী রাজনীতিক। প্রধান বিচারপতির অবস্থানটি কোন মেরুর কাছাকাছি, পাঠ করিতে সমস্যা হয় না। এই উদাহরণটি বলিতেছে, সংবিধানের সর্বোচ্চতা স্বীকার করা এবং শাসনক্ষমতার মধ্যে একটি বিরোধ বর্তমান। অমিত শাহ হইতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মেজো-সেজো নেতা, আরও অনেকের কথাতেই সেই বিরোধ প্রকট হইয়াছে। যাঁহাদের হাতে সংবিধানের সম্মানরক্ষার ভার ন্যস্ত, তাঁহারাই সংবিধানের প্রশ্নাতীত মান্যতা স্বীকার করিতে নারাজ, ইহার অপেক্ষা দুর্ভাগ্য আর কী হইতে পারে? সমাজের নৈতিকতা তাঁহাদের নিকট জরুরি, কারণ তাঁহাদের ভোটে লড়িতে হয়। শবরীমালায় মহিলাদের প্রবেশাধিকার ঠেকাইলে যদি দক্ষিণ ভারতে হিন্দু ভোট বিজেপির ঝুলিতে আসে, অথবা অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণের হুঙ্কারকে প্রশ্রয় দিলে যদি গোবলয়ের গৈরিক জনতা সন্তুষ্ট থাকে, রবিশঙ্কর প্রসাদদের নিকট তাহাই শেষ কথা। দুর্ভাগ্য। সংবিধান মানা যে ঐচ্ছিক নহে, আবশ্যিক, রাজনীতির ক্ষুদ্র স্বার্থে তাঁহারা যদি এই কথাটি ভুলিয়া যান, তবে ক্ষমতায় থাকিবার নৈতিক অধিকার তাঁহাদের থাকে কি?