বাবা মসন্দলির দ্বারস্থ হন সব সম্প্রদায়ের মানুষ

ছিলেন শাসক। দরবারি ষড়যন্ত্রে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ত্যাগ করেন মসনদ। হিন্দু-মুসলমান সব ধর্মের প্রজা তাঁর কাছে সমান। সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক মসন্দলি বাবার কথা লিখলেন সমীর দাসসংক্ষিপ্ত আচার। কিন্তু অটল বিশ্বাস। লোককথা, গল্পকথা, প্রবাদ বাদ দিলেও এই একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের জয়যাত্রার যুগেও বহু মানুষ নানা বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের কাহিনি শোনাবেন। সেই কাহিনি মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরার কাহিনি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৩৭
Share:

ঐতিহাসিক: মসন্দলি বাবার মসজিদ। নিজস্ব চিত্র

রসুলপুর নদীর মোহনার অদূরেই পেটুয়াঘাট মৎস্য বন্দর। নদীর অন্য পাড়ে হিজলি। গভীর সমুদ্রে ট্রলার নিয়ে ভেসে পড়ার আগে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নাবিকদের একবার আসতেই হবে হিজলির পিরের ‘থানে’। বাবাসাহেবের কোর্টগোড়া। হাতে পুজোর থালা। তাতে গুড় বা চিনির সঙ্গে চালের গুঁড়ো মেশানো এক ধরনের শক্ত কড়কড়ে মিষ্টান্ন— ‘বাবাসাহেবের কড়কড়া’ বা ‘খুড়মা’। তার সঙ্গে তাঁর মাজারে চড়ানোর জন্য রঙিন কাপড়, গোলাপ জল আর ধূপ। মসজিদের প্রবেশ দ্বারে চৌকির উপর বসেন খাদেম বা সেবায়েত কমিটির সদস্যরা। তাঁরা দক্ষিণার বিনিময়ে খুড়মার পাত্রে ফুল দিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। ধূপ জ্বেলে দিতে হবে রেলিং ঘেরা মাজারের বাইরে। গোলাপ জল ছিটিয়ে দিতে হবে থানে। আর রঙিন কাপড়টি পুজোর থালা থেকে নিয়ে হাফেজ সানোয়ার খান চড়িয়ে দেবেন মাজারে। নাবিক ভক্তরা জয়ধ্বনি দেবেন, ‘জয় বাবা মসন্দলি’।

Advertisement

সংক্ষিপ্ত আচার। কিন্তু অটল বিশ্বাস। লোককথা, গল্পকথা, প্রবাদ বাদ দিলেও এই একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের জয়যাত্রার যুগেও বহু মানুষ নানা বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের কাহিনি শোনাবেন। সেই কাহিনি মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরার কাহিনি।

মসন্দলি বাবা কে? তিনি ঐতিহাসিক ব্যক্তি নবাব তাজ খাঁ মসনদ-ই-আলা। তাম্রলিপ্ত বন্দরের গরিমা তখন অস্তমিত। রূপনারায়ণ নদের মোহনা এবং ভাগীরথী নদীর পশ্চিম পাড় ঘেঁষে জেগে উঠছে একের পর এক দ্বীপ— মহিষাদল, গুমগড়, দোরো, কেওড়ামাল, খেজুরি, হিজলি। ১৬৮২-৮৪ খ্রিস্টাব্দে জর্জ হিরোনের মানচিত্রে দেখা যায়, খেজুরি ও হিজলি উভয়েই মূল ভূখণ্ড থেকে হিজলি নদী দিয়ে বিচ্ছিন্ন। খেজুরি ও হিজলির মাঝে কাউখালি নদী। তার আগে ১৬৬০ সালে ভ্যানডেন ব্রুকের মানচিত্রেও হিজলি দ্বীপের উল্লেখ রয়েছে।

Advertisement

সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে চণ্ডীভেটির সম্পন্ন মুসলমান মনসুর ভুঁইয়ার ছোট ছেলে রহমত ভুঁইয়া দাদা জামালের সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে হিজলি দ্বীপের জেলে পাড়ায় আশ্রয় নেন। হিজলি তখন গভীর জঙ্গল। হিংস্র জীবজন্তুও ছিল। কিন্তু সাহসি রহমত ঝোপঝাড় কেটে আবাদি জমি তৈরি করেন। ধীবর যুবকদের নিয়ে সেনাবাহিনী গ়ড়েন। তারপর মূল ভূখণ্ডের কয়েকটি গ্রাম অধিকার করে জমিদারি পত্তন করেন। রাজধানী হয় হিজলি।

১৬২৮ সালে ওড়িশার মুঘল সুবেদার বাকর খাঁর কাছে সনদ ও ইখতিয়ার খাঁ উপাধি পান। তাঁর মৃত্যুর পরে বড় ছেলে দাউদ খাঁ রাজা হন। কিন্তু তাঁর আয়ুষ্কাল অল্প। দাউদের মৃত্যুর পরে তাঁর বড় ছেলে তাজ খাঁ রাজা হন। সহোদর সেকেন্দার ছিলেন বীর। অবিবাহিত ভাইয়ের সাহায্যে তাজ খাঁ রাজ্যের সীমা উত্তরে তমলুক, পশ্চিমে সুবর্ণরেখা নদী, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও পূর্বে ভাগীরথীর পশ্চিম সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। কিন্তু কিছু রাজ কর্মচারী এবং স্ত্রীর ষড়যন্ত্রে সেকেন্দার খুন হওয়ার পরে তাঁর মনে বৈরাগ্য জন্মায়। তিনি একমাত্র পুত্র বাহাদুরকে সিংহাসনে বসিয়ে শাহ আবুল হক উদ্দিন চিশতির কাছে দীক্ষা নেন। ত্যাগ করেন রাজপ্রসাদ। ১৬৪৮-৪৯ সালের মধ্যে প্রাসাদ থেকে কিছু দূরে মসজিদ নির্মাণ করেন। সেটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বায় প্রায় ৫০ ফুট। চওড়া প্রায় ২৫ ফুট। পূর্ব দিকে মূল দরজা। তিনটি গম্বুজওয়ালা ছাদ। ভিতরের হলঘরটি উপাসনাস্থল। অদূরে একটি কুয়ো এবং মিষ্টি জলের কুণ্ড। মসজিদের সামনে হুজরার মধ্যে তিনি সাধনরত অবস্থায় দেহত্যাগ করেন।

তাজ খাঁ শাসক হিসেবে হিন্দু-মুসলমান সকল প্রজাকে সমান চোখে দেখতেন। তাঁর দুই হিন্দু স্ত্রী ছিলেন। দেবদেউল নির্মাণ ও পূজার্চনার জন্য অনেক নিষ্কর জমি দান করেন। তাজ খাঁর প্রধান তিন রাজকর্মচারী ভীমসেন মহাপাত্র, দ্বারকা দাস ও দিবাকর দাস ছিলেন হিন্দু। হিজলিতে বাণিজ্য করতে আসা বিদেশিদের সঙ্গেও তিনি ভাল ব্যবহার করতেন। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নিম্ন বঙ্গের এই সব অঞ্চল ছিল অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। খানাখন্দ, দহ বা জলাশয়ে পরিপূর্ণ। ম্যালেরিয়া মহামারীর মতো লেগে থাকত। তা সত্ত্বেও জীবন জীবিকার টানে বহু মানুষ এই অঞ্চলে এসে বসতি গড়ে তোলেন। হিজলি তখন প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র। তৎকালীন ভারতের এক তৃতীয়াংশ লবণের চাহিদা মেটাত হিজলি। এ ছাড়া চাল, কার্পাস, পাট, রেশমজাত সূক্ষ্ম বস্ত্র, চিনি, মোম হিজলি বন্দর থেকে দেশে বিদেশে রফতানি হত।

তাজ খাঁর মৃত্যুর পরে হিজলির গৌরব কমতে থাকে। তাঁর রাজপ্রাসাদ-সহ প্রধান প্রধান নগরের প্রায় ন’মাইল এলাকা সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। শুধু বেঁচে যায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদটি। কালক্রমে এই মসজিদ ও তাঁজ খাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠে নানা অলৌকিক কাহিনি। দূর-দূরান্ত থেকে আসেন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ভক্তরা। প্রতি বৃহস্পতিবার হিন্দু ‘গুড়িয়া’ সম্প্রদায়ের কয়েকজনের তৈরি সিন্নি ভোগ দেওয়া হয় মসলন্দি বাবাকে। প্রতি বছর চৈত্র মাসের প্রথম শনিবার হয় বাবার উৎসব।

‘চৌদিকেতে লোনা পানি মধ্যেতে হিজলি/তাহাতে বাদশাহী করে বাবা মসন্দলী’। লিখেছিলেন কবি জয়নুদ্দী। কিন্তু সেই অবস্থা এখন আর নেই। এখন একদিকেই শুধু নোনা জল। দুর্গম পথ সুগম হয়েছে। তাঁর মাজার ঘিরে এখন ঘন বসতি। পর্যটন ও বাণিজ্য কেন্দ্র। বিস্তীর্ণ ঝাউবনে প্রায় সারা বছরই চলছে বনভোজন। অদূরে তৈরি হয়েছে বাস এবং অটো স্ট্যান্ড। কলকাতা থেকে চার ঘণ্টার সড়ক পথে হেঁড়িয়া-খেজুরি হয়ে হিজলি পৌঁছন যায়। রাত্রি যাপনের জন্য এলাকায় ব্যবস্থা রয়েছে। মাজার থেকে শ’তিনেক মিটার দূরে জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল চলে আসে। ভাটার সময়ে চর জাগে এক মাইলের বেশি। চড়ায় দু’চাকার, চার চাকার যান চালানো কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। ভ্রমণ পিপাসুদের সকাল-সন্ধ্যায় বেড়ানোর জন্য অতি মনোরম স্থান। সমুদ্রস্নানও চলে। তবে জল ঘোলা। নেই বিশাল ঢেউ ভাঙার রোমাঞ্চ।

তবুও পূর্ব মেদিনীপুরের এক সময়ের হারিয়ে যাওয়া হিজলি আবার প্রাণ স্পন্দনে জেগে উঠছে ৩৬৮ বছরের পুরনো এক মাজারকে ঘিরে।

লেখক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সহ-সচিব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন