সম্পাদকীয় ১

বিশ্বাসে মিলায়

নিজের জ্ঞানবুদ্ধি অনুসারে কর্তব্য সম্পাদন করিলে কোনও বিপদের আশঙ্কা নাই— এই বিশ্বাসটির অভাব ভারতকে ফের নীতিপঙ্গুত্বের দোরগোড়ায় আনিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৭ ০০:২০
Share:

মানবসভ্যতার অগ্রগতির প্রধানতম চালিকাশক্তি কী? মানুষের অনন্ত উদ্ভাবনী ক্ষমতা নহে, বাজারের অদৃশ্য হাতও নহে। নিজের স্বার্থসিদ্ধির সুতীব্র তাগিদ নহে, পরহিতৈষণার আগ্রহ নহে, গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে থাকিতে শেখা নহে, ব্যক্তির একক সত্তার স্বীকৃতিও নহে। মানবসভ্যতা মূলত যাহার জোরে অগ্রসর হইয়াছে, তাহার নাম বিশ্বাস। সভ্যতার সর্বাঙ্গে বিশ্বাস বস্তুটি এমন ওতপ্রোত ভাবে জড়াইয়া আছে যে সাদা চোখে তাহাকে ঠাহর করাই মুশকিল হইয়া দাঁড়ায়। আধুনিক সময়ে বিশ্বাস শুধুমাত্র তাহার অভাব ঘটিলেই চোখে পড়ে— বিশ্বাসের অভাবে যখন কাজ থমকাইয়া যায়, তখন তাহার মহিমা বোঝা যায়। কয়েক বৎসরের ব্যবধানে দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে যেমন টের পাওয়া যাইতেছে। ইউপিএ-র দ্বিতীয় দফায় যাহা ‘নীতিপঙ্গুত্ব’ নামে কুখ্যাত হইয়াছিল, নরেন্দ্র মোদীর শাসনের তিন বৎসর না কাটিতেই তাহা ফিরিয়া আসিতেছে। কয়লাখনি বণ্টন মামলায় অনিয়মের অভিযোগে তৎকালীন কয়লাসচিব, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত হরিশচন্দ্র গুপ্ত এবং অন্য দুই কর্মরত আমলাকে বিশেষ সিবিআই আদালত দুই বৎসর কারাদণ্ড দেওয়ায় যে প্রতিক্রিয়াগুলি সামনে আসিতেছে, তাহাতে নীতিপঙ্গুত্বের অশনি সংকেত স্পষ্ট। প্রশ্ন উঠিতেছে, কোনও আমলার বিবেচনায় যে সিদ্ধান্তটি দেশের স্বার্থরক্ষায় সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য, শেষ অবধি তাহা যদি কোনও কারণে বিপরীত ফলদায়ী হয়, এবং তাহার দায় যদি সেই আমলার উপর বর্তায়— তবে আমলারা এই ঝুঁকি লইবেন কেন? হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকিলে অন্তত দুর্নীতির দায়ে জেল খাটিতে হইবে না। অর্থাৎ, নিজের জ্ঞানবুদ্ধি অনুসারে কর্তব্য সম্পাদন করিলে কোনও বিপদের আশঙ্কা নাই— এই বিশ্বাসটির অভাব ভারতকে ফের নীতিপঙ্গুত্বের দোরগোড়ায় আনিয়াছে।

Advertisement

আমলারা হাত গুটাইয়া লইলে তাহাকে ‘অযৌক্তিক’ বলিবার কোনও উপায় নাই। যুক্তির অভাব আসলে বিচারপদ্ধতিতে। কোনও আমলাই দুর্নীতিগ্রস্ত নহেন, এমন দাবি কেহ করিবেন না। কিন্তু, যদি কোনও সিদ্ধান্তের ঔচিত্য কেবলমাত্র তাহার ফলাফলের ভিত্তিতে বিচার করা হয়, তবে সৎ-অসতের মধ্যে ফারাক করা কঠিন হইতে পারে। এক জন অসৎ আমলার দুর্নীতি-প্রণোদিত সিদ্ধান্তে সরকারের যতখানি ক্ষতি হইতে পারে, এক জন সৎ আমলার সম্পূর্ণ সৎ ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ফলেও সমপরিমাণ ক্ষতি হওয়া সম্ভব। প্রথম ক্ষেত্রটি নিছক দুর্নীতি, দ্বিতীয়টি দুর্ভাগ্য, অথবা বড় জোর সংশ্লিষ্ট আমলার অকুশলতা। বিচারব্যবস্থায় যদি এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক করিবার ব্যবস্থা না থাকে, তবে সৎ আমলাদেরই অধিকতর সমস্যা। অতএব, তাঁহারাই আরও বেশি হাত গুটাইয়া লইবেন। তাহাতে দ্বিগুণ ক্ষতি। কোনও সিদ্ধান্তের ফলে কী ক্ষতি হইয়াছে, সেই বিচারের পাশাপাশি দেখা প্রয়োজন, সিদ্ধান্তটির উদ্দেশ্য অসৎ ছিল কি না। ফলাফল হইতে উদ্দেশ্যের বিচার শুধু ভুল নহে, বিপজ্জনক।

বিশ্বাসের আরও ক্ষতি করিয়াছে বর্তমানের ‘তল্লাশি রাজ’। দিল্লির হাওয়ায় অভিযোগ ভাসিতেছে, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার অতি ঘনিষ্ঠ কয়েক জন নেতার বিরাগভাজন হইলে সিবিআই আদি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে নাহক হয়রানিই ভবিতব্য। প্রধানমন্ত্রীর কুনজর যে শুধু বিরোধী নেতা অথবা অসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তাদের উপরই পড়িবে, সেই ভরসা কাহারও নাই। যুক্তিজ্ঞান বলিবে, যে আমলা আপাতত কর্তাদের নেকনজরে আছেন, তিনিও সাবধানে থাকিবেন— কর্তার স্নেহধারা কখন শুকাইয়া যায়, কে জানে! অন্যায় না করিলে শাস্তি হইবে না, এই বিশ্বাসটি ক্রমেই অলীক হইতেছে। কাজেই, প্রত্যেকেই নিজের ঘুঁটি সামলাইতে ব্যস্ত। তাহাতে দেশের ঠিক কতখানি ক্ষতি হইতেছে, সেই হিসাব রাখিবার দায় কাহারও নাই।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement