গণতন্ত্র চাই? এই তো আমি

আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণমান যেমনই হোক না কেন, নেতা ও নেত্রীদের দাপট বেড়েই চলেছে। নানা দলে, নানা রাজ্যে। তবে এ ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদী প্রথম শ্রেণিতে প্রথম।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৭ ০০:০০
Share:

আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণমান যেমনই হোক না কেন, নেতা ও নেত্রীদের দাপট বেড়েই চলেছে। নানা দলে, নানা রাজ্যে। তবে এ ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদী প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। তিন বছর ধরে দেখছি, প্রধানমন্ত্রীর সামান্যতম সমালোচনা শুনলেও তাঁর ভক্তরা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন— মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে বলে মোদীজির নিন্দা! হে রাম, ওদের ক্ষমা কোরো, ওরা জানে না ওরা কী করছে! এই প্রবণতার একটা বড় কারণ নিশ্চয়ই দলে ও সরকারে প্রধানমন্ত্রীর অতিকায় আধিপত্য। নরেন্দ্র মোদী আর যা-ই হোন, ‘ফার্স্ট অ্যামং ইকোয়ালস’ নন, সবার উপরে সতত তিনিই সত্য, তাঁহার উপরে নাই। কিন্তু শুধু সভয় সমীহ নয়, তাঁর পারিষদদের কথায় আহত অভিমানও স্পষ্ট: সকলের সব দায় যিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, পাশে না দাঁড়িয়ে বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করছেন! গণতন্ত্র শিরোধার্য, কিন্তু তিনিই তো গণতন্ত্রের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি, তাঁর মধ্যে দিয়েই তো জনগণের শাসন মূর্তি পাচ্ছে!

Advertisement

ঠিক এখানেই ‘পপুলিজম’ বা জনতাতন্ত্রকে খুঁজে নেবেন ইয়ান-হ্বের্নার ম্যুয়লার। প্রিন্সটন-এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। তিনি একটি ছোট্ট বই লিখেছেন: হোয়ট ইজ পপুলিজম? ইদানীং এই শব্দটি বিশ্ব জুড়ে রাজনীতির আলোচনা ছেয়ে ফেলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে ব্রেক্সিট, গ্রিসের সিরিজা থেকে ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্ট কিংবা ইটালির ফাইভ স্টার মুভমেন্ট— নানা ভূখণ্ডে নানা রূপে পপুলিজম-এর অভিযান চিহ্নিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মূলধারার যে সব রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠান এত দিন রাজত্ব করে এসেছে, আমজনতা তাদের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, তাদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ হতাশ, কারণ কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখতে গিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে ডুবিয়েছে। তাই জনতা বেছে নিচ্ছে এমন সব দল বা নেতাকে, যাঁরা জনতার স্বার্থ দেখেন, জনতার কথা বলেন। এটাই জনতাতন্ত্র। পপুলিজম।

ম্যুয়লার এই সংজ্ঞায় সন্তুষ্ট নন। তাঁর মতে, মূলস্রোতের রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ালেই পপুলিজম হয় না, পপুলিস্ট নায়ক বা নায়িকার একটা বিশেষ লক্ষণ আছে— তিনি দাবি করেন, তিনিই জনতার যথার্থ প্রতিনিধি, যারা সে দাবি মানতে নারাজ তারা অপ্রাসঙ্গিক। লক্ষণীয়, গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের গুরুত্বকে এখানে অস্বীকার করা হচ্ছে না, বরং সেই প্রতিনিধিত্বের ধ্বজা ধরেই পপুলিজম নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর। জনতাতন্ত্র গণতন্ত্রকে খারিজ করে না, তাকে ব্যবহার করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাইমারিজ-এ এক বক্তৃতায় ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল মানুষকে এককাট্টা করা, (যারা এককাট্টা হয়ে আমাদের শিবিরে যোগ দিল না, সেই) অন্যদের নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।’ আমিই সকলের জন্য আছি, অপরের কী বা প্রয়োজন?

Advertisement

কথাটা কি মজ্জায় মজ্জায় অগণতান্ত্রিক নয়? যে বহুত্ব গণতন্ত্রের অন্তরাত্মা, ‘আমিই জনস্বার্থের ধারক ও বাহক’ বলে দাবি করলে কি তাকেই নস্যাৎ করা হয় না? অবশ্যই। কিন্তু জনতাতন্ত্রের তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। ওই দাবি কত শতাংশ মানুষ মানছে, সেটাও তার কাছে কোনও প্রশ্নই নয়, কারণ দাবিটা তোলা হচ্ছে নৈতিকতার মোড়কে পুরে। যারা দাবি মানল না, পপুলিস্ট নায়কনায়িকার চোখে তারা অ-নৈতিক, সুতরাং জনতা থেকে দূরে। সমালোচনায় মুখর সংবাদমাধ্যমকে ট্রাম্প যখন ‘গণশত্রু’ তকমা দেন, তখন যুক্তি-তথ্য দিয়ে তাঁকে প্রতিহত করার চেষ্টা অর্থহীন। কারণ তাঁর কথাটা যুক্তি বা তথ্যের নয়, কাঁচা আবেগের, যে আবেগ নৈতিকতার মুখোশ পরে বহুজনের মন ভোলায়। কাঁচা আবেগ এবং কাঁচা গোবর, একই নৈতিকতায় মন্ত্রঃপূত, তার সঙ্গে যুক্তি-তর্ক চলে না।

এ ব্যাধি ট্রাম্পের একার নয়, এ হল পপুলিজমের স্বভাবধর্ম। এই ধর্মের অনুগামীরা স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের প্রতি বিরূপ, সেটা বড় কথা নয়— সে বিরূপতা তো শাসকের বহুলপ্রচলিত স্বভাব। কিন্তু আগমার্কা পপুলিস্ট বুঝতেই পারেন না, তিনি থাকতে আদৌ আলাদা সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজন হবে কেন? সংবাদমাধ্যম তো কেবল পাবলিকের কাছে তাঁর মন কী বাত পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম! ইটালির ফাইভ স্টার মুভমেন্ট দলটি কার্যত তার নায়ক পেপে গ্রিয়ো-র ব্লগের জনপ্রিয়তায় সওয়ার হয়েই উঠে এসেছিল। তাঁর সমর্থকরা যখন ভোটে জিতে আইনসভায় প্রবেশ করেন, তখন দলের এক সহ-নায়ক জানিয়েছিলেন: ইটালির জনমত নিজেই এখন পার্লামেন্টে এসে গিয়েছে!

নিজেকে জনস্বার্থের অদ্বিতীয় রক্ষাকর্তা মনে করলে যে কোনও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকেই শত্রু ভাবা স্বাভাবিক। এই কারণেই মুক্ত সংবাদমাধ্যম, বিরোধী দল, মেরুদণ্ডী আমলাতন্ত্র, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, সন্ধানী এনজিও— সকলের প্রতি পপুলিস্ট নেতা ও নেত্রীরা খড়্গহস্ত। সজাগ, সচেতন নাগরিক সমাজ তাঁদের দু’চোখের বিষ। তার কারণ শুধু এই নয় যে, সেই সমাজ তাঁদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। তাঁরা ভাবেন, জনতার দেখাশোনার জন্যে তো তাঁরাই আছেন, নাগরিক সমাজের দরকারটা কী?

স্বৈরতন্ত্র বিপজ্জনক, কিন্তু তাকে চেনা যায়। জনতাতন্ত্র গণতন্ত্রের ভেক ধরে থাকে। মুখ যত ভয়ানক হোক, মুখোশ আরও ভয়ানক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন