এ বারের পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কারের পথ ধরে

ব্যর্থতাও যখন মূল্যবান

কোয়ান্টাম এক বিশাল ব্যাপার। পরমাণুর অন্দরে ভুলভুলাইয়া নিয়ে তার কারবার। সেখানে আলো ফেলতে প্রাণপাত করেছেন অনেকেই।

Advertisement

পথিক গুহ

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share:

উপাখ্যান: অ্যালুমিনিয়াম সিলিন্ডার নিয়ে পরীক্ষারত জোসেফ ওয়েবার

এ যেন এক মহাকাব্য। বিজ্ঞানের দুর্ভাগ্য যে, তার হাতে কোনও হোমার নেই। নইলে অবশ্যই লেখা হয় কোনও উপাখ্যান।— অ্যাটম বোমা তৈরির প্রধান বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার বলেছিলেন কথাটা। কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রসঙ্গে। গত শতাব্দীর গোড়ায় ফিজিক্সের ওই শাখা উলটে পালটে দিল সব। অচল হয়ে গেল বিজ্ঞানে যুগ যুগ ধরে লালিত ধ্রুপদী চিন্তাভাবনা। নিজেদের আবিষ্কারে চমকে উঠলেন এক এক জন গবেষক। তো গবেষণার সেই ধুন্ধুমার পর্বের দিকে তাকিয়ে মন্তব্যটি করেছিলেন ওপেনহাইমার।

Advertisement

কোয়ান্টাম এক বিশাল ব্যাপার। পরমাণুর অন্দরে ভুলভুলাইয়া নিয়ে তার কারবার। সেখানে আলো ফেলতে প্রাণপাত করেছেন অনেকেই। সমবেত সেই প্রচেষ্টা দীর্ঘ কাহিনি বটে। তবে, মনে হয়, ‘মহাকাব্যিক’ বিশেষণটা বিজ্ঞানের অনেক গবেষণা সম্পর্কেই খাটে। সাফল্য আর ব্যর্থতা, রেষারেষি কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এতখানি লুকিয়ে থাকে গবেষণাগারের চার দেওয়ালের মধ্যে যে, বিজ্ঞানচর্চায় মানবিক উপাদান উপেক্ষা করা যায় না। আর, সে বিচারে, অনেক গবেষণাই যেন এক একটা উপাখ্যান।

এই যেমন এ বার যে প্রচেষ্টা জিতল ফিজিক্সে নোবেল প্রাইজ। পুরস্কার পেলেন তিন বিজ্ঞানী। এমআইটি-র রাইনার ওয়েইস এবং ক্যালটেক-এর ব্যারি বারিশ ও কিপ থর্ন। বয়সে তিন জনই প্রবীণ; ওয়েইস ৮৫, বারিশ ৮১, থর্ন ৭৭। ওঁরা জ্যোতির্বিজ্ঞানকে উপহার দিয়েছেন মহাকাশ চেনার নতুন পন্থা। এমন এক কৌশল, যা আগে কাজে লাগানো যায়নি।

Advertisement

মানুষের আকাশ দেখা এগিয়েছে ধীরে ধীরে। খালি চোখে যা দেখা যায়, তা যে প্রায় কিছুই নয়, তা বুঝতে সময় লাগেনি। তাই দূরবিন। সে-ও সেই চোখে দেখা, তবে দূরের জিনিসকে কাছে এনে একটু বেশি দেখা। মানুষের চোখ দেখতে পায় কেবল কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো। অথচ মহাকাশ জুড়ে কত বস্তু কত ঘটনা! অনেক বস্তু এবং ঘটনা থেকে এমন সব তরঙ্গ ছড়ায়, যা মানুষের চোখ দেখতে পায় না। সে সব চিনতে বা জানতে জ্যোতির্বিজ্ঞানে এসেছিল নতুন নতুন যন্ত্র। অদৃশ্য তরঙ্গ শনাক্ত করে আকাশের খবর সংগ্রহ।

অালবার্ট অাইনস্টাইন

ওয়েইস, বারিশ এবং থর্ন আকাশ চেনায় যে নতুন পথের সন্ধান দিলেন, তা-ও তরঙ্গ শনাক্ত করা, তবে এ একেবারে ভিন্ন তরঙ্গ। আগে যে সব তরঙ্গ ধরা পড়ত, সে সব ছড়াত শূন্যস্থান বা স্পেসের মধ্যে। নতুন পন্থায় এ বার শনাক্ত হচ্ছে খোদ স্পেসের তরঙ্গ বা কাঁপন। মানে? আলবার্ট আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটি অনুযায়ী, বস্তুর ভরের বা অবস্থানের হঠাৎ পরিবর্তনে সে বস্তুর চার পাশের শূন্যস্থানে আলোড়ন শুরু হয়। কোনও তারার আকস্মিক বিস্ফোরণ, প্রচণ্ড ভারী নক্ষত্রের নিজের অক্ষের চার দিকে লাট্টুর মতো আবর্তন, দুই ব্ল্যাকহোলের চরকিবাজি এবং পরিণামে সংঘর্ষে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনায় শূন্যস্থানে যে ঘনঘোর আলোড়ন, তা দশ দিকে ছড়ায় তরঙ্গাকারে। মানে, ঘটনাকে ঘিরে যে স্পেস, তা নিজে ক্রমাগত এক বার ফাঁপে, পরক্ষণে চুপসে যায়। এ ভাবে চলে ঢেউ। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ।

মহাকাশে এমন অনেক ঘটনা ঘটে (যেমন সব ঘটনা আগের অনুচ্ছেদে বলেছি) যাদের থেকে আলো বা অদৃশ্য তরঙ্গ ছড়ায় না। ছড়ায় কেবল মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। তাই ও রকম ঘটনা, যাদের খবর আগে পাওয়া যেত না, সে সব এখন জানা যাবে। ওয়েইস, বারিশ এবং থর্ন যেমন জানতে পেরেছিলেন ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। পৃথিবী থেকে ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে ১৩০ কোটি বছর আগে দুটো ব্ল্যাকহোল এ-ওকে চক্কর দিতে দিতে মিশে গিয়ে একটা ব্ল্যাকহোল বনেছিল। এ ঘটনায় যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ছড়ায় তা পৃথিবীতে পৌঁছয় ওই তারিখে। প্রমাণ? হ্যাঁ, ও দিন দেখা গিয়েছিল পৃথিবীতে শূন্যস্থানের দৈর্ঘ্য এক বার বেড়েছে, এক বার কমেছে। কী পরিমাণে? ঢেউ যেমন উৎস থেকে দূরে গেলে স্তিমিত হয়, এও তেমনি। উৎস থেকে ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে পৃথিবীতে পৌঁছে ওই তরঙ্গ এখানকার শূন্যস্থান ছোট-বড় করেছে তিল পরিমাণে। ৪ কিলোমিটারে ১ মিলিমিটারের ১,০০০,০০০,০০০,০০০ ভাগের এক ভাগেরও কম! যে যন্ত্রে শূন্যস্থানের মোটা-রোগা হওয়ার ওই সূক্ষ্ম মাপ ধরা পড়েছে, তার নাম লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি (লাইগো)। এমন অতি-সংবেদনশীল যন্ত্র বানানো এবং তাতে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করার কৃতিত্বে পুরস্কৃত হলেন ওয়েইস, বারিশ এবং থর্ন।

নোবেল প্রাইজের ইতিহাস নাকি বিজ্ঞানেরও ইতিহাস। তা যদি হয়, তা হলে ওই দ্বিতীয় ইতিহাস যে ব়ড় একপেশে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সন্ধান এক মহাকাব্য, আর সেই উপাখ্যান কেবল ওই ত্রয়ীর সাফল্যে রচিত হতে পারে না। করুণ এক ব্যর্থতাও এ নাটকের অবিচ্ছেদ্য অঙ্ক। সে ব্যর্থতার নাম জোসেফ ওয়েবার।

জন্ম ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে। লিথুয়ানিয়া থেকে আমেরিকায় পালিয়ে-আসা দরিদ্র ইহুদি পরিবারে। বাবা-মার ছেলেকে স্কুলে পাঠানো সামর্থ্য নেই, তাই পড়ার খরচ নিজে রোজগার করতে ওয়েবার কৈশোরেই পথে পথে। কখনও গল্ফ খেলোয়াড়দের ক্যা়ডি তো কখনও রেডিয়ো মেকানিক। এ ভাবে পড়া চালিয়েও মাধ্যমিকে প্রথম। তার পর বৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ওয়েবার মার্কিন নৌবাহিনীতে। যুদ্ধজাহাজে রাডার সামলানোর দায়িত্বে। জাপানি বোমায় ডুবল জাহাজ। ওয়েবার কোনও ক্রমে প্রাণে বাঁচলেন। এ হেন মানুষের জীবনে নোবেল হাতছানি দিয়েছে তিন বার।

যুদ্ধ শেষ। ওয়েবার মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর। তখনও পিএইচ ডি হয়নি। বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো বিখ্যাত হয়েছেন এই বলে যে, ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হয়েছে এক বিস্ফোরণে, এবং সে বিস্ফোরণের রেশ এখনও খুঁজলে পাওয়া যাবে মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গে। ওয়েবার গ্যামো-র কাছে গিয়ে বললেন, মাইক্রোওয়েভ নিয়ে কাজে হাত পাকিয়েছি, আপনার অধীনে পিএইচ ডি করতে চাই। গ্যামো রাজি হলেন না। হতেন যদি, তবে হয়তো সেই রেশ আবিষ্কার করে আর্নো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন নোবেল পেতেন না, তা পেতেন ওয়েবার। গ্যামো কাজের সুযোগ না দেওয়ায় ‘মেজার’ এবং ‘লেজার’ (আলোকে তীক্ষ্ণতর বানানোর দুই কৌশল) রশ্মিচর্চায় খুব উঁচু মানের গবেষণা করলেন তিনি। কিন্তু হায়, ১৯৬৪ সালে যখন দেওয়া হল ও কাজের জন্য নোবেল, তখন তা পেলেন অন্য তিন বিজ্ঞানী। ওয়েবার বাদ।

এর পর ১৯৫০-এর দশকের শেষে তিনি নামলেন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করতে। সামান্য উপকরণ দিয়ে। বানালেন অ্যালুমিনিয়ামের নিরেট সিলিন্ডার। শূন্যে ঝুলিয়ে রাখলেন তা। সিলিন্ডার যেহেতু স্পেস দখল করে আছে, তাই পৃথিবীর উপর দিয়ে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বয়ে গেলে সিলিন্ডারের আয়তন বাড়বে-কমবে। ওয়েবার দাবি করলেন, পরীক্ষায় তিনি দেখছেন সিলিন্ডারের দৈর্ঘ্যের বাড়া-কমা। কত? ১ মিলিমিটারের ১০,০০০,০০০,০০০,০০০ ভাগের এক ভাগ। জার্নালে জার্নালে পেপার ছাপলেন ওয়েবার। রাতারাতি হিরো। মিডিয়ায় ফলাও প্রচার। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করে ওয়েবার নোবেল প্রাইজ পাচ্ছেন। পাঁচ বছরের মাথায় ওয়েবার হিরো থেকে জিরো। সতীর্থ বিজ্ঞানীরা ধরলেন পরীক্ষার ত্রুটি। বললেন, দৈর্ঘ্যের অত সূক্ষ্ম হেরফের মাপার ক্ষমতা ওয়েবারের নেই। ওয়েবার মানলেন না সমালোচনা। মানেননি ২০০০ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত।

বিজ্ঞানে ব্যর্থতাও উপকারী। ওয়েবারকে দেখে গবেষকরা নিলেন শিক্ষা। বুঝলেন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করতে কুটিরশিল্পের পথে এগোলে চলবে না। চাই পেল্লায় যন্ত্র। হ্যাঁ, লাইগো-ই সেই যন্ত্র। ওয়েবারের কাছে তাঁদের ঋণ ভোলেননি ওয়েইস, বারিশ এবং থর্ন। ২০১৬-র ১১ ফেব্রুয়ারি যখন ওয়াশিংটনে ওঁরা ঘোষণা করেন প্রথম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তের খবর, তখন সাংবাদিক সম্মেলনে ডেকে এনেছিলেন ওয়েবারের স্ত্রী জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভার্জিনিয়া ট্রিম্বল-কে।

কারা যেন বলেছিলেন, বিজ্ঞান এগিয়ে চলে এক শবযাত্রা থেকে আর এক শবযাত্রায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন