ক্ষমা সুন্দর

ক্ষমা যেথা হীন দুর্বলতা, সেই স্থলে নিষ্ঠুর হইতে পারার প্রার্থনা রহিয়াছে কবির কবিতায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৯ ০০:০৪
Share:

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চে বন্দুকবাজের হামলায় মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ। ছবি: রয়টার্স

তিনি বসিয়া আছেন, সম্ভবত হুইলচেয়ারে। মস্তকে টুপি, শ্বেতশ্মশ্রুশোভিত মুখ। সহানুভূতিশীল কেহ তাঁহার দিকে দুই হাত বাড়াইয়াছিলেন, তিনি নিজ করপুটে সেই দুই হাতকে আশ্রয় দিয়াছেন। চোখের শান্ত হাসি দেখিলে কে বলিবে, প্রিয়জনশোক এই মানুষটিকেই তাড়না করিতেছে! ক্রাইস্টচার্চে আল নুর মসজিদে গুলিচালনার ঘটনায় ফরিদ আহমেদ নিজে প্রাণে বাঁচিয়াছেন, কিন্তু হারাইয়াছেন স্ত্রী হুসনাকে। প্রার্থনারত পঞ্চাশ জন যেখানে গুলিবৃষ্টিতে নিহত, হুইলচেয়ারবন্দি ফরিদের বাঁচিয়া থাকা সেখানে বড় ঘটনা। কিন্তু তাহাকেও ছাপাইয়া গিয়াছে তাঁহার উক্তি। সন্ত্রাসী ব্রেন্টনের উদ্দেশে ফরিদ বলিয়াছেন, যে অন্যায় সে করিয়াছে তিনি তাহা একেবারেই সমর্থন করেন না, কিন্তু মানুষ হিসাবে তিনি ব্রেন্টনকে ভালবাসেন। সুযোগ হইলে তিনি তাহাকে বলিবেন, তোমার ভিতরে মহৎ হইবার, দয়ালু হইবার, মানুষকে রক্ষা করিবার অযুত সম্ভাবনা আছে। বলিবেন, ব্রেন্টনের প্রতি তাঁহার কোনও বিদ্বেষ নাই, তিনি তাহাকে ক্ষমা করিয়াছেন।

Advertisement

ক্ষমা যেথা হীন দুর্বলতা, সেই স্থলে নিষ্ঠুর হইতে পারার প্রার্থনা রহিয়াছে কবির কবিতায়। নিউজ়িল্যান্ডের ফরিদ কিন্তু ক্ষমাশীল হইয়াছেন বাস্তবের ভূমিতে দাঁড়াইয়া, এবং এমন মুহূর্তে, যখন তিনি প্রতিশোধকামী হইলেও সমষ্টির উত্তুঙ্গ সমর্থন পাইতেন। কারণ ক্ষমা এই কালে দৌর্বল্যের অভিজ্ঞান বলিয়া চিহ্নিত ও ধিক্কৃত। তুমি দুর্বল বলিয়া ক্ষমা দিয়া তোমার অসামর্থ্য ঢাকিতেছ, বাস্তবিক সাহসী হইলে তুমি হিংসার জবাব প্রতিহিংসায় চুকাইয়া দিতে, চোখের বদলে চোখ উৎপাটন করিতে— ইহাই অধুনা যুগধর্ম। ব্যক্তিকে অতিক্রম করিয়া রাষ্ট্রের পরিসরেও ঘৃণাই শাসনযন্ত্রের চালিকাশক্তি হইয়া উঠিতেছে, ক্ষমা বড় সুলভ নহে। পৃথিবীর ইতিহাসে ভূরি ভূরি রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের উপর নিষ্ঠুর আক্রমণ করিয়াছে, পরে ক্ষমা চাহিয়াছে কয়টি? যুদ্ধকালীন হিংসা ও অত্যাচারের জন্য পরে আনুষ্ঠানিক দুঃখপ্রকাশ করিয়াছে জাপান। যে নিউজ়িল্যান্ডের ঘটনায় বিশ্ব স্তম্ভিত, সেই দেশের আদি অধিবাসী মাওরিদের জমি ও সম্পত্তি এক কালে কাড়িয়া লইয়াছিল ব্রিটিশ প্রশাসন, বহুকাল পরে রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথ চিঠি লিখিয়া দুঃখপ্রকাশ করিয়াছেন। এই সকল দৃষ্টান্ত বিরল ও দুর্লভ, সুলভ হইল তর্জন ও তর্জনীর বহুল ব্যবহার। তাহার সম্মুখে ফরিদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টির তো মরমে মরিবার কথা।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ক্ষমা সবলের গুণ। তাহার অধিকারী হইতে গেলে জাতি, রাষ্ট্র, ধর্মের গণ্ডিগুলি ছাড়াইয়া বৃহত্তর মানসভূমিতে উঠিতে হয়, যেখানে মানুষ তাহার সকল মানুষী দুর্বলতা ও সম্ভাবনার সহিত দৃশ্যমান। ফরিদ সন্ত্রাসী ব্রেন্টনের দুর্বলতাটুকু ক্ষমা করিয়াছেন, তাহার অন্তরে শুভবোধ জাগরণের সম্ভাবনার প্রতি তাঁহার আস্থা আছে বলিয়াই। চারিপাশে যখন মানুষ হিংসাকে আঁকড়াইয়া ধরিতেছে, ফরিদের ন্যায় মানুষেরা হিংসাকে চরম প্রত্যাখ্যান ছুড়িয়া দিতেছেন। ফরিদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখেও ধ্বনিত হইয়াছে সেই বার্তা: সন্ত্রাস হয়তো আমাদের দেশকে বাছিয়া লইয়াছে, কিন্তু আমরা উহাকে প্রত্যাখ্যান করিতেছি। অনেক রাষ্ট্রপ্রধানই এ হেন বার্তা দিতে অপারগ, ক্ষমা করিতে অক্ষম। তাহা দুঃখের। ক্ষমা এবং ক্ষমতা যে, আক্ষরিক অর্থেই, এক ধাতুতে গড়া, তাহা বুঝিলে পৃথিবীর মঙ্গল হইত।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন