পরিযায়ী শ্রমিক, সামাজিক সুরক্ষা ও নগর অর্থনীতি

যে শ্রমিকদের নিরলস চেষ্টায় নগর ও মহানগরের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে এবং টিকে আছে, সেই সব শ্রমিককে বাদ দিয়ে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা প্রণয়ন করলে, সেই যোজনার উদ্দেশ্য কি আদৌ সার্বিক পূর্ণতা পাবে? লিখছেন গোপা সামন্ত ও সুমিতা রায় স্থানীয় লোকদের দিয়ে কাজ করাতে গেলে যে বেতন দিতে হয় বাইরের রাজ্য থেকে শ্রমিক আনলে তাঁদের অনেক কম বেতনে কাজ করানো যায়। আর তা ছাড়া তাঁরা থাকেন নিজ নিজ রাজ্যের সরকারি সুরক্ষার জালের বাইরে। ফলে তাঁদের কাজ করিয়ে লাভ সবটাই। কিন্তু তাঁরাই হন নানারকম অসাম্যের শিকার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৯ ০৩:১৭
Share:

স্থানীয় লোকদের দিয়ে কাজ করাতে গেলে যে বেতন দিতে হয় বাইরের রাজ্য থেকে শ্রমিক আনলে তাঁদের অনেক কম বেতনে কাজ করানো যায়।

আজকের ভারতে অনেক সমস্যার মধ্যে একটি হল পরিযায়ী শ্রমিক। এদের ঘর এক রাজ্যে, আর পেটের টানে কাজের জন্য কাটাতে হয় আর এক রাজ্যে। এরা ছাড়া আমাদের নাগরিক সমাজ অচল। অথচ আমাদের শহরে এদের অবস্থান কেমন যেন ‘অবাঞ্ছিত’। সব রাজ্যই চায় এদের তাড়াতে, কিন্তু পারে না। কারণ, তাঁরাই সস্তার কাজের লোক। স্থানীয় লোকদের দিয়ে কাজ করাতে গেলে যে বেতন দিতে হয় বাইরের রাজ্য থেকে শ্রমিক আনলে তাঁদের অনেক কম বেতনে কাজ করানো যায়। আর তা ছাড়া তাঁরা থাকেন নিজ নিজ রাজ্যের সরকারি সুরক্ষার জালের বাইরে। ফলে তাঁদের কাজ করিয়ে লাভ সবটাই। কিন্তু তাঁরাই হন নানারকম অসাম্যের শিকার।

Advertisement

কলকাতা শহরের উত্থান সম্বন্ধে যাঁরা নূন্যতম ওয়াকিবহাল, তাঁরা সকলেই জানেন যে মধ্য অর্থাৎ পুরনো কলকাতার অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক সম্প্রদায় মূলত অবাঙালি। এঁদের অধিকাংশই অবিভক্ত বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের স্থায়ী বাসিন্দা এবং এই শহরে জীবিকা নির্বাহের জন্য এসেছেন অনেক কাল আগে। এখনও ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে’। এঁদের মূল সমস্যা হল, এঁরা জীবনের ৩০-৪০ বছর অসংগঠিত শ্রমিক হিসেবে এই শহরে কাজ করলেও কোনরকম সামাজিক সুরক্ষা পান না। আমাদের প্রচলিত ধারণা, রাজ্যের নাগরিকদের সামাজিক এবং অন্য সুযোগসুবিধা দিতে সরকার যতটা দায়বদ্ধ, অন্য রাজ্য থেকে আসা শ্রমিকদের সুরক্ষা বা সুযোগসুবিধা দিতে সরকার ততটা দায়বদ্ধ নয়। কিন্তু এই সব শ্রমিকেরা ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে কয়েকশো বছর ধরে এই রাজ্যের বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছেন।

এখনও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কলকারখানা ও খনির শ্রমিকদের সিংহভাগ অবাঙালি শ্রমিক। ২০০১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী, কলকাতার কুটির শিল্প ছাড়া অন্য শিল্প এবং খুচরো ও পাইকারি বাণিজ্য সম্পর্কিত কাজে প্রায় এক লক্ষ ১২ হাজার ভিন্‌ রাজ্য থেকে আসা ব্যক্তি জড়িয়ে আছেন। সেই তুলনায়, এই দু’টি কর্মক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলা থেকে আসা কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র ৫৫ হাজার। বিশেষত, কলকাতার বিভিন্ন ক্ষুদ্রশিল্প এবং বৃহৎ বাজার, যথা— বড়বাজার, পোস্তাবাজার, কোলে মার্কেট, এন্টালি মার্কেট প্রভৃতি বাজার এবং ধাপা, তপসিয়া, পার্কসার্কাস প্রভৃতি ক্ষুদ্র শিল্পাঞ্চল মূলত ভিন্‌ রাজ্য থেকে আসা শ্রমিক দ্বারা পরিচালিত। তা হলে, এই শহর তথা রাজ্য এটা স্বীকার করতে বাধ্য যে উপরোক্ত দু’টি ক্ষেত্র অবাঙালি শ্রমিক ছাড়া প্রায় অচল এবং ঠিক এই কারণেই এই সব শ্রমিকদের কিছু সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা প্রয়োজন যাতে পরেও ভিন্ রাজ্য থেকে এই রাজ্যে শ্রমিকদের যোগান অব্যাহত থাকে।

Advertisement

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গ সরকার বহু পূর্বেই অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা নীতি প্রণয়ন করেছে। ২০১৭ সালের আগে অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য পাঁচটি বিভিন্ন ধরনের যোজনা প্রচলিত ছিল। এগুলি হল— ‘SASPFUW’, ‘WBUSWHSS’, ‘BOCWA’, ‘WBTWSSS’, এবং ‘WBBSSS’। পরে এই সব যোজনাগুলিকে একত্রিত করে ২০১৭ সালে নতুন একটি যোজনা প্রণয়ন করা হয়— ‘সামাজিক সুরক্ষা যোজনা’। এই যোজনার একটি বড় সুবিধা হল প্রভিডেণ্ট ফান্ড-এর সুবিধা। এ ক্ষেত্রে কোন শ্রমিক প্রতি মাসে ২৫ টাকা জমা করলে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রতি মাসে ওই অ্যাকাউন্টে ৩০ টাকা জমা করবে এবং শ্রমিকের ৬০ বছর হওয়ার পরে সুদ-সহ শ্রমিক তা ফেরত পাবেন অথবা ৬০ বছরের আগে শ্রমিকের মৃত্যু হলে তাঁর পরিবারের মনোনীত সদস্য ওই অর্থ পাবেন। এই যোজনায় আরও অনেক সুযোগসুবিধা রয়েছে। যেমন, প্রতি বছর, প্রতি শ্রমিক চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ ২০,০০০ টাকা পেতে পারেন। শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যুতে তাঁদের পরিবারকে ৫০,০০০ টাকা এবং দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এ ছাড়াও কোনও কারণে শ্রমিক কাজ করতে অসমর্থ্য হলে সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা সহযোগিতা হিসেবে পেতে পারেন। তা ছাড়া, শ্রমিকের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্যও প্রতি বছর সর্বোচ্চ ৪ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পেতে পারে। পারত পক্ষে মনে হতেই পারে যে, এত সুযোগসুবিধা থাকলে অসংগঠিত শ্রমিকদের দুর্দশা অনেকটা ঘুচবে। কিন্তু সেখানেও আছে মস্ত ফাঁক।

এই যোজনায় নাম নথিভুক্ত করতে গেলে মূলত তিনটি শর্ত পালন করতে হয়। প্রথমত, শ্রমিকের বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, মাসিক আয় হতে হবে প্রতি মাসে ৬,৫০০ টাকা বা তার কম এবং তৃতীয়ত, শ্রমিককে অবশ্যই হতে হবে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী। এখন সমস্যা হল, অসংগঠিত শ্রমিকদের এক বড় অংশ অন্য রাজ্য থেকে আসায় তাঁদের রেশনকার্ড, ভোটারকার্ড বা আধার কার্ড— সবই তাঁদের আদি গ্রামের ঠিকানা অনুযায়ী রয়েছে। অসংগঠিত অবাঙালি শ্রমিকদের উপরে একটি সমীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছে, ৬০০ জনের মধ্যে ৫৮০ জন শ্রমিক পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী না হওয়ার কারণে এই সামাজিক সুরক্ষা যোজনায় নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন না। বাকি ২০ জন যে নাম নথিভুক্ত করেছেন তা কিন্তু নয়। কারণ, কেউ বলেছেন যে যোজনা সম্পর্কে তাঁরা কিছু জানেন না। আবার কেউ বলেছেন যে তাঁরা জানলেও কী ভাবে এবং কোথায় নাম নথিভুক্ত করতে হয় তা তাঁরা জানেন না। অর্থাৎ, যোজনার বাস্তবায়নেও ঘাটতি রয়েছে।

ভারতের অন্য রাজ্যের অন্য সব শহরের অবস্থাও আলাদা কিছু নয়। সেই রাজ্যের তাঁরা স্থায়ী বাসিন্দা নন বলে তাঁরা ‘নেই রাজ্যের লোক’, তাঁরা সব রকম সামাজিক সুযোগসুবিধার বাইরে। তা হলে প্রশ্নটা হল, যে শ্রমিকদের নিরলস চেষ্টায় নগর ও মহানগরের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে এবং টিকে আছে, সেই সব শ্রমিককে বাদ দিয়ে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা প্রণয়ন করলে, সেই যোজনার উদ্দেশ্য কি আদৌ সার্বিক পূর্ণতা পাবে? কারণ, সংখ্যায় পরিযায়ী শ্রমিকেরাই এখন প্রায় সব শহরেই স্থানীয় শ্রমিকদের থেকে অনুপাতে বেশি। তা ছাড়া এ কথাটা তো মানতেই হবে যে তাঁরা সবাই একই দেশের নাগরিক, দেশটার নাম ভারতবর্ষ।

(গোপা সামন্ত বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের শিক্ষিকা, সুমিতা রায় ওই বিভাগের গবেষক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন