উৎসব তো শুধু আনন্দ নয়, কারও কাছে মাপা মুক্তির ছাড়পত্রও বটে

দোতলার বারান্দার পর্দার আড়ালই ছিল আনন্দ লুটে নেওয়ার জায়গা। এর বেশি চাইতেনও না সেকালে তাঁরা। লিখছেন মনিমা মজুমদারসময় ধীরে ধীরে এগিয়েছে। মেয়েরাও অন্দরমহল থেকে একটু একটু করে বাইরে পা রেখেছেন। সত্তরের দশকেও মেয়েরা একা একা উৎসবে শামিল হতেন না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৯ ০২:৩৪
Share:

ছবি: সংগৃহীত

উৎসব আসে, উৎসব যায়। আদল বদলায় ঠিকই, কিন্তু কোথাও যেন থেকে যায় একটা মুক্তির স্বাদ। এই স্বাদই একদিন ছুঁয়ে যেত বাঙালির যৌথ পরিবারের অন্দরমহলকেও।

Advertisement

এই অন্দরমহলের বাসিন্দা ছিলেন শুধু মেয়েরাই। পুরুষদের জন্য অবারিত দ্বার ছিল বাহিরমহলের। ব্যাপারটা যেন এমনই যে, মেয়েরা আবদ্ধ থাকবেন বাড়িতেই। বাইরের পৃথিবীর একচ্ছত্র অাধিপত্য শুধু পুরুষের। সারা বছর এই একই নিয়ম তখন বহাল থাকত। তবে উৎসবের ক’টা দিনে একটু বদলাত সেই নিয়ম।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কথাই ধরা যাক। সেই যুগে মেয়েদের লেখাপড়া বা অন্য বিষয় ছিল পারিবারিক ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা লেখাপড়া, সঙ্গীত, অভিনয়-চর্চায় ছিলেন স্বাধীন। সে যুগের প্রেক্ষিতে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সামনে ছিল অনেকটাই উন্মুক্ত সুযোগ। মেয়েদের সাংগঠনিক প্রয়াস, এমনকি পত্রিকা সম্পাদনাতেও উৎসাহ দেওয়া হত। কিন্তু উৎসবের আনন্দটুকু তাঁরা উপভোগ করতেন চিকের আড়াল থেকেই। খুব ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয়স্বজন ছাড়া উৎসবের দিনগুলিতেও তাঁরা পর্দার আড়ালে থাকতেন। পাল্কির ঘেরাটোপে গঙ্গাস্নানের গল্প কে না জানে! তবুও যেন রোজকার রান্নাঘর ও সংসারের ঝক্কি সামলে কিছুটা অন্যরকম জীবনের স্বাদ এই উৎসবের দিনগুলোই এনে দিত।

Advertisement

উৎসব উপলক্ষে বাজারে গিয়ে পছন্দমতো কেনাকাটা ছিল ভাবনার অতীত। যৌথ পরিবারে খুব ছোটদের জন্য বাড়িতেই চলে আসতেন দর্জি। তিনি মাপ নিয়ে সবার জন্য তৈরি করতেন একই ছিটকাপড়ের জামা। তাঁতি তাঁর পুঁটুলিতে নিয়ে আসতেন নানা কাপড়ের সম্ভার। তাঁর ঝুলিতে থাকত নানারকম ছোট ছোট ধুতি— ফুলপাড় আর কল্কাপাড়। বাড়ির মেয়েদের জন্য ছিল নীলাম্বরী, চাঁদের আলো শাড়ি। সবার শেষে ঝোলা থেকে বার হত বাড়ির গিন্নিদের জন্য দশহাতি কালাপানি, গঙ্গাযমুনা পাড়, তাবিজ পাড়। তাঁতি উঠোনে মেলে ধরতেন শাড়ির সম্ভার। একঘেয়েমি লেগে থাকা অন্দরমহলের জীবনে সেটাই ছিল টাটকা বাতাস।

বাহিরবাড়ি গিয়ে প্রতিমা দেখার অনুমতি সেকালে মেয়েদের ছিল না। শুধুমাত্র ভাসানের দিন সেই অনুমতিটুকু পাওয়া যেত। কিছু বাড়িতে বছরের ওই একটা দিনই ছাদে যাওয়ার অনুমতি মিলত। অথচ, পুজোর সমস্ত জোগাড়, প্রদীপ সাজানো থেকে শুরু করে ভোগ রান্না— সবই করতেন মেয়েরাই।

কলকাতায় ঘটা করে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল শোভাবাজারের রাজবাড়িতে। রাজবাড়ির দুর্গোৎসবের কথা বহুল প্রচারিত। কিন্তু বাড়ির বউরা সেই সময় সকলের সামনে পূজামণ্ডপে পুজো দিতে যেতে পারতেন না। বাইরের লোকজনদের সরিয়ে মণ্ডপে যাওয়ার বিশেষ পথকে পর্দা দিয়ে ঘিরে দেওয়া হত। এই পর্দার আড়াল থেকেই দিতে হত অঞ্জলি। রাজবাড়িতে শুধু যে মহিলারা চিকের আড়ালে থাকতেন, তাই নয়। দেবী দশভুজাও যেহেতু নারী, তাঁর সামনেও দেওয়া থাকত অভ্রের ঝরোকা। যদিও কেউ কেউ বলে থাকেন যে, মর্ত্য ও স্বর্গের মধ্যে ব্যবধান বোঝাতেই ঝরোকার ব্যবহার করা হত। রাজবাড়ির পরে কিছু বনেদি পরিবারেও ঝরোকার ব্যবহার দেখা গিয়েছে সেই সময়ে।

সে সময়ে এর বেশি স্বাধীনতার কথা মেয়েরা ভাবতেনও না। পুজো বা যে কোনও উৎসবের কয়েকটা দিন নতুন শাড়ি, গা ভর্তি গয়না নিয়ে একে অপরের সঙ্গে মশকরা করা, এটাই তখন ছিল তাঁদের মুক্তির খোলা হাওয়া। দোতলার বারান্দায় পর্দার আড়াল থেকেই তাঁরা লুটে নিতেন জীবনের আনন্দ।

সময় ধীরে ধীরে এগিয়েছে। মেয়েরাও অন্দরমহল থেকে একটু একটু করে বাইরে পা রেখেছেন। সত্তরের দশকেও মেয়েরা একা একা উৎসবে শামিল হতেন না। বাড়ির পুরুষদের সঙ্গেই বাইরে বার হওয়ার অনুমতি মিলত। একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব আর সময়— এটাই ছিল শর্ত।

তারপর যৌথ পরিবারে ভাঙন ধরল। জন্ম নিল অণু পরিবার। মেয়েরাও তখন অন্দরমহলের অন্ধকার ছেড়ে শিক্ষার হাত ধরে আলোর পথে হাঁটতে শিখেছেন। নারী-পুরুষ সমানাধিকার কথাটাকে সত্যি করে চাকরিক্ষেত্রেও তাঁরা ছাপ রাখতে শুরু করলেন। আর্থসামাজিক অবস্থা আর অবস্থান বদলের পটভূমি মেয়েদের বেশ কিছুটা মুক্তির স্বাদও এনে দিল। এখন রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকেন সকলেই। মণ্ডপে মণ্ডপে হইহই করে ঠাকুর দেখে বেড়ান। যে কোনও উৎসবের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত থাকেন, তা সে বারোয়ারি পুজো হোক বা পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

একদিন উৎসব শেষ হয়। কিন্তু তারপর? এত বদলের পরও কি মেনে আর মানিয়ে নেওয়ার ছবিটা বিশেষ বদলায়? বদলায় কি প্রতিদিনের ‘তুমি মেয়ে’, ‘এ সব শুধু ছেলেদেরই মানায়’ জাতীয় অদৃশ্য বেড়াজালের বাঁধুনিগুলো? বদলায় না! তবুও তো উৎসব, তবুও তো আনন্দ। সারা বছর ধরে ওই দিনগুলির জন্য অপেক্ষা করে থাকা। হলই-বা তা ক্ষণস্থায়ী! মুক্ত পরিধির পরিসর তো বাড়ে। তাকে পুঁজি করেই আবারও একটা বছরের প্রতীক্ষা করা!

(লেখক বাণেশ্বর জিএসএফ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন