লক্ষ্মীহীন

লিঙ্গসাম্যের সূচকে বাংলাদেশের পশ্চাতে ভারত। এবং, ২০০৬ হইতে ভারতের স্থান ওই সূচকে নিম্নগামী। লক্ষণীয়, এই বারো বৎসরে ভারতে মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার হার ক্রমশ বাড়িয়াছে, কিন্তু কর্মে যোগদান কমিয়াছে। ভারতে যে কর্মরত মেয়েদের অনুপাত কমিয়াছে, তাহাতে বিশ্ব বিস্মিত— অধিক শিক্ষা কেন মেয়েদের জন্য অধিক সম্পদ আনিল না!

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

লক্ষ্মী যেন অচলা হইয়া ঘরে থাকেন, ইহাই গৃহস্থের প্রার্থনা। কিন্তু গৃহলক্ষ্মীর লক্ষ্মীলাভ হইবে কী রূপে? গৃহকাজে বধূকে আবদ্ধ করিবার ফলে নারী-পুরুষ আর্থিক বৈষম্য বাড়িয়াই চলিয়াছে। আন্তর্জাতিক অসরকারি সংস্থা ‘অক্সফ্যাম’ তাহার সাম্প্রতিক রিপোর্টে এই তিক্ত বাস্তব ফের তুলিয়া ধরিল। ভারতে প্রতি দিন পাঁচ ঘণ্টারও অধিক সময় মেয়েরা ব্যয় করেন বেতনহীন কাজে। শিশুপরিচর্যা, বৃদ্ধের দেখাশোনা, রন্ধন ও গৃহস্থালির কাজ সারিতে মেয়েদের দিন কাটিয়া যায়। ভারতে ইহাকে ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া মনে করা হয়, কিন্তু অন্যান্য দেশের সহিত তুলনা করিলে আদৌ তাহা নহে। গৃহস্থালির কাজে পুরুষ আধঘণ্টা ব্যয় করেন, মেয়েরা একটি গোটা কর্মদিবস ব্যয় করেন। এমন বৈষম্য কম দেশেই আছে। মাথাপিছু রোজগারের নিরিখে ভারতের সমকক্ষ দেশগুলিতে এত বেশি মহিলা এত বেশি সময় গৃহস্থালির কাজে ব্যয় করেন না। নিরন্তর গৃহকাজের ফল: মহিলারা বাহিরের কাজে যোগ দিয়া রোজগার করিতে পারেন না। তাহাতে পরিবারের ক্ষতি, ক্ষতি গোটা দেশের। আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার হিসাব— ভারতের কর্মজগতে পুরুষ-মহিলা বৈষম্য দূর হইলে দেশ আরও সাতাশ শতাংশ বাড়তি সম্পদ উৎপন্ন করিত। হাতে সম্পদ আসিলে মহিলারা তাঁহাদের সন্তানের শিক্ষায় অধিক বিনিয়োগ করিতেন, তাঁহাদের জীবনযাত্রার উন্নতি সংসার ও সমাজেও উন্নয়ন আনিত। ইহা অর্থনীতির অলস জল্পনা নহে। মহিলাদের উন্নয়ন যে দেশের উন্নয়ন আনিতে পারে, তাহা বুঝিতে প্রতিবেশী বাংলাদেশের দিকে তাকাইলেই চলে।

Advertisement

লিঙ্গসাম্যের সূচকে বাংলাদেশের পশ্চাতে ভারত। এবং, ২০০৬ হইতে ভারতের স্থান ওই সূচকে নিম্নগামী। লক্ষণীয়, এই বারো বৎসরে ভারতে মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার হার ক্রমশ বাড়িয়াছে, কিন্তু কর্মে যোগদান কমিয়াছে। ভারতে যে কর্মরত মেয়েদের অনুপাত কমিয়াছে, তাহাতে বিশ্ব বিস্মিত— অধিক শিক্ষা কেন মেয়েদের জন্য অধিক সম্পদ আনিল না! সম্ভবত, ভারতে পরিবার ও সমাজের সংরক্ষণশীলতা ইহার এক প্রধান কারণ। মেয়েদের গৃহবন্দি করিবার, তাঁহাদের শ্রমকে পারিবারিক সম্পদ হিসাবে ব্যবহারের যে অভ্যাস চলিয়া আসিয়াছে, মেয়েদের অধিক শিক্ষা তাহাতে পরিবর্তন আনিতে পারে নাই। তবে কি কন্যাকে শিক্ষিত করিবার উদ্দেশ্য তাহাকে কাজের বাজারের যোগ্য করা নহে, বিবাহের বাজারের যোগ্য করা?

বিবাহ অনুষ্ঠানে আড়ম্বর বাড়িতেছে, একই সঙ্গে বাড়িয়াছে বধূ নির্যাতন। বধূ হত্যা হইতে বৃদ্ধা মাতাকে পরিত্যাগ, কোনওটাই কমে নাই। কিন্তু মেয়েদের উপর এই নির্যাতন অকারণ নহে, পরিকল্পিত। ইহা বস্তুত মেয়েদের শ্রমসম্পদ নিয়ন্ত্রণের উপায়। ‘অক্সফ্যাম’ সংস্থাটি ভারতের চারটি রাজ্যে এক সমীক্ষা করিয়াছে। তাহাতে প্রকাশ, গৃহপরিচর্যার বিবিধ কাজ সুচারু রূপে সম্পন্ন না করিলে গৃহবধূকে প্রহার করা চলে, এই মত প্রায় অর্ধেকের। অন্যেরা মনে করেন, না মারিলেও কঠোর তিরস্কার করা চলে। অর্থাৎ মেয়েদের স্বতন্ত্র মানুষ মনে করে না পরিবার। তাহাদের দেহ ও শ্রমের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পুরুষপ্রধান পরিবারের হাতে। এই বৈষম্য কেবল দেশের বিপন্নতা বাড়াইবে। মেয়েরা বিত্তবতী না হইলে দেশ সম্পন্ন হইবে না।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন