সম্পাদকীয় ১

সহিষ্ণুতার নয়া পাঠ

আলাদা নীতি, আলাদা সহিষ্ণুতা, তাই কোবিন্দের মুখে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নাম আসিল, জওহরলাল নেহরুর নাম আসিল না। কে কাহার নাম লইবেন, তাহা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিষয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share:

ফাইল চিত্র।

বিদায়ী রাষ্ট্রপতি শেষ কয়েকটি বক্তৃতায় বার বার সহিষ্ণুতার সংস্কৃতির কথা বলিয়া গিয়াছেন। নূতন রাষ্ট্রপতিও প্রথম বক্তৃতাটি সেই সহিষ্ণু ভারতের কথা দিয়াই শুরু করিয়াছেন। কিন্তু আশ্চর্য, যাঁহারা শুনিতেছেন, তাঁহাদের কাহারও ভুল করিয়াও এই বিভ্রম হয় নাই যে, দুই জনে এক কথা বলিতেছেন, এক পথ দেখাইতেছেন। বাস্তবিক, একই শব্দ বা শব্দবন্ধ দিয়া যে কতখানি আলাদা বক্তব্য বোঝানো যায়, এক শব্দকে ক্ষেত্রভেদে প্রয়োগভেদে কত ভিন্ন ইঙ্গিতে অন্বিত করা যায়, ভবিষ্যতে তাহা লইয়া দস্তুরমতো গবেষণা হইতে পারে— ভারতের ত্রয়োদশতম হইতে চতুর্দশতম রাষ্ট্রপতির পরিবর্তনের এই মুহূর্তটিকে কেন্দ্র করিয়া। নূতন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বলিলেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বহুত্বই না কি এ দেশের সাফল্যের কারণ। কোন সাফল্যের কথা তিনি বলিতেছেন, ঠিক ধরা যায় না। কী ভাবে ‘বহুত্ব’ সেই সাফল্যে দেশকে পৌঁছাইয়া দিল, তাহাও ধোঁয়াটে হইয়া থাকে। বিপরীতে বরং প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বহুত্ব তত্ত্বটি বুঝিতে সহজ। কোনও সাফল্যের কথা সেখানে ছিল না, বরং বহুত্বকে একটি সত্য হিসাবে, একটি নীতি হিসাবে, একটি পন্থা হিসাবে মানিবার শপথ ছিল, ফলাফল-নিরপেক্ষ ভাবে। পরবর্তী বক্তৃতার আগে নূতন রাষ্ট্রপতি বহুত্বের বাক্যালংকারটি আর একটু ঘষিয়া মাজিয়া লইলে ভাল করিবেন। নতুবা, সংঘ পরিবারের প্রথম রাষ্ট্রপতির মুখে সবটাই বড় জোলো শুনাইতেছে।

Advertisement

আলাদা নীতি, আলাদা সহিষ্ণুতা, তাই কোবিন্দের মুখে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নাম আসিল, জওহরলাল নেহরুর নাম আসিল না। কে কাহার নাম লইবেন, তাহা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিষয়। তবে কিনা, রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে আবার ‘ব্যক্তিগত’ কী, রাষ্ট্রগত-ই তো সব। প্রশ্ন উঠিতে পারে, ভারতের রাষ্ট্রপতি যদি বহুত্বের উদ্বোধন দিয়া বক্তৃতা শুরু করেন, তবে সেই সূত্রে নেহরুর নাম কী ভাবে চিত্তাকাশে উদিত হয় না? রাষ্ট্রগত ভাবেই মনে রাখিতে হয়, জওহরলাল নেহরু যেমনই মানুষ হউন, যে দলের সদস্যই হউন, সদ্য-স্বাধীন দেশে অতি কঠিন সময়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের বিন্দুমাত্র অবকাশ না রাখিয়া বহুত্ব ও সহিষ্ণুতার নীতিটিকে তিনি তুলিয়া ধরিয়াছিলেন। নেহরুর তুলনায় অনেকের ভূমিকাই এ বিষয়ে অনেক ক্ষীণ, যাঁহাদের কয়েকটি নাম কোবিন্দের মুখে শোনা গেল। বাস্তবিক, দীনদয়াল উপাধ্যায় যে দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সেই জনসংঘ নিজেরাও কোনও কালে সহিষ্ণুতা লইয়া বিশেষ মাথা ঘামাইয়াছে বলিয়া শোনা যায় নাই। ভারতের ইতিহাস বিভিন্ন নেতাকে নিজ নিজ মূল্যের ভিত্তিতে গ্রহণ ও ধারণ করিয়াছে। ইঁহাদের কাহাকে কাহাকে তুলিয়া ধরিয়া যে ভাবে নিজের বক্তব্যের সপক্ষে দাঁড় করানো হইতেছে তাহা বুঝাইয়া দেয়, কে কী বলিতে চাহেন।

কেন্দ্রীয় শাসক দলের প্রতিনিধিরা, এবং প্রধানমন্ত্রী, অবশ্যই খুশির চতুর্দশ সর্গে। চতুর্দশ রাষ্ট্রপতি অবধি অপেক্ষা করিয়া অবশেষে তাঁহারা একটি আগমার্কা আরএসএস মুখকে রাষ্ট্রশীর্ষে তুলিয়া ধরিয়াছেন। হিন্দু রাষ্ট্রের মুখ অবশেষে ভারতের মুখ বলিয়া প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। দেশের ক্ষমতাবলয় জুড়িয়া এখন হিন্দুত্ববাদের জয়পতাকা, যে হিন্দুত্ববাদ দেশের সমস্ত সংখ্যালঘুকে নাগরিক হিসাবে লঘু স্থানে বসাইতে স্থিরপ্রতিজ্ঞ। নূতন রাষ্ট্রপতি দলিত সম্প্রদায় হইতে উঠিয়া আসিয়াছেন বলিয়া বিজেপি ইতিপূর্বে আত্মপ্রসাদের ঢল বহাইয়াছিল। কোবিন্দ কিন্তু সন্তর্পণে নিজের সেই প্রান্তিক পরিচিতিটিকে বক্তৃতার বাহিরে রাখিলেন। সম্ভবত প্রান্তিকতার উল্লেখ তাঁহার কেন্দ্রমুখী রাজনীতি-দর্শনের সহিত খাপ খাইত না বলিয়াই। সংখ্যালঘুই হউক, আর দলিতই হউক, প্রান্তিকেরা প্রান্তে থাকিলেই কেন্দ্রের সুবিধা। মোদী-কোবিন্দের ভারতের নয়া সহিষ্ণুতা কি এই কথাটিই বলিতে চাহে?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন