Fishermen

জাল নেই, কম দূষণ, ফিরতে পারে দেশি মাছ

বহুদিন ধরে নদীর জল তোলপাড় করেনি জ্বালানি চালিত নৌকা বা ভেসেল। মাছ ধরতে যাচ্ছেন না মৎস্যজীবীরা। দূষণ না থাকায় মাছের ছানা বাঁচার সংখ্যাও বাড়বে। মৎস্য দফতর সূত্রে খবর, রোজ দিঘায় গড়ে ৪০০ টন এবং ডায়মন্ড হারবারে ১০০ টন মাছ কেনাবেচা হয়।

Advertisement

আরিফ ইকবাল খান

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২০ ০২:১৩
Share:

মিলতে পারে বেশি ইলিশ। দেশি মাছও। আশা মৎস্যজীবীদের। নিজস্ব চিত্র

নদীতে ফিরে আসবে রুই, কাতলা, মৃগেল। মৎস্য বিজ্ঞানীরা আশার আলো দেখছেন। লকডাউন পঞ্চাশ দিন অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। জলপথে নামেনি কোনও মাছ ধরার নৌকা। যাত্রীবাহী ফেরিও। এতেই আশার আলো দেখছেন মৎস্যবিজ্ঞানীরা।

Advertisement

মৎস্য দফতর সূত্রে খবর, রোজ দিঘায় গড়ে ৪০০ টন এবং ডায়মন্ড হারবারে ১০০ টন মাছ কেনাবেচা হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়া, মহিষাদল, কুঁকড়াহাটি, দিঘা, কাঁথি, শঙ্করপুর, তাজপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ, নামখানা, ডায়মন্ড হারবার-সহ বিভিন্ন এলাকায় অন্তত সাড়ে তিন লক্ষ মৎস্যজীবী রয়েছেন। তবে এর মধ্যে হলদিয়ার নয়াচরে কত মৎস্যজীবী রয়েছেন সেই হিসেব জেলা প্রশাসনের কাছে সঠিক নেই। এই মৎস্যজীবীদের একটি বড় অংশ মাছ নিয়ে হলদিয়ায় আসেন। মূলত ইলিশের মরসুমে কয়েকশো মাছ ধরার নৌকা নয়াচর, পাতিখালি, হলদিয়া, কুঁকড়াহাটি, অমৃতবেড়িয়া থেকে মাছ ধরতে যান। মূলত বঙ্গোপসাগর ও গঙ্গা-হুগলি-হলদি নদীতে মাছ ধরে বিক্রি করাই যাঁদের জীবিকা। কিন্তু ২৪ মার্চ লকডাউন ঘোষণার পর থেকে কোনও মৎস্যজীবী আর সমুদ্রে যেতে পারছেন না। সমুদ্রের মাছ বিক্রি হয় দিঘা ও ডায়মন্ড হারবারের আড়তে। দিঘা ফিশারম্যান অ্যান্ড ফিশ ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে খবর, হলদিয়ার আড়তে রোজ গড়ে তিন থেকে চার টন মাছ কেনা বেচা হয়। পূর্ব মেদিনীপুরে জেলা পরিষদের মৎস্য দফতরের সূত্র অনুযায়ী, ৪০-৪২টি জায়গায় সামুদ্রিক মাছের ব্যবসা হয়। বহু মানুষ এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। এখন লকডাউনের কারণে এসব বন্ধ রয়েছে। মৎস্যজীবীদের দিন গুজরানের সমস্যা হচ্ছে।

কিন্তু বিজ্ঞানীরা এর মধ্যেই আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। তাঁদের অভিমত, লকডাউন পর্বে ফিরে আসবে হারিয়ে যাওয়া বহু মাছ। নদীতেই মিলতে পারে রুই, কাতলা, আড়, বোয়ালের মতো মাছ। এক সময় এই সব মাছ নদীতে পাওয়া যেত। কিন্তু দূষণের কারণেই তাদের দেখা মেলা ভার হয়েছিল। কিন্তু মাছগুলো সবই বাঙালির প্রিয়। ফলে জোগান বজায় রাখতে কৃত্রিম ভাবে প্রজনন করা হয়। তবে এবার প্রকৃতি নিজেই উপহার দিতে পারে মাছগুলো। ‘সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফিসারিজ এডুকেশন’এর মুখ্য মৎস্য বিজ্ঞানী বিজয়কালী মহাপাত্র বলেন, ‘‘হুগলির ত্রিবেণী মগরার কাছে বেশ কিছুদিন আগে একটি জাহাজ ডুবি হয়েছিল। সেই জাহাজ আর নদী থেকে তোলা হয়নি। সেই জাহাজের খোলের মধ্যেই রয়েছে কাতলা, আড়, বোয়াল, চিতল মাছ। মাঝে মাঝে ত্রিবেণী থেকে কালো জল ছাড়লে দূষণের কারণে সেই মাছ বেরিয়ে আসে জাহাজের নিশ্চিত আশ্রয় থেকে। নদীতেই কাতলা, রুই, মৃগেল আছে তা আমরা দীর্ঘদিন গবেষণা করেই দেখেছি। একাধিকবার গঙ্গা থেকেই এই মাছের বাচ্চা সংগ্রহ করেছি আমরা।’’

Advertisement

মৎস্য গবেষক বিজয়কালী জানিয়েছেন, তাঁরা দেশি নদীর মাছের ডিম পোনা সংগ্রহ করেছেন। এই মাছগুলো কয়েক লক্ষ ডিম পাড়ে। কিন্তু দূষণের কারণে ডিম থেকে বাচ্চার সংখ্যা অনেক কমে যেত। লকডাউনে দূষণ অনেকটাই কম। ফলে ডিমপোনার সিকিভাগ বাঁচলেই নদীগুলোতে দেশি মাছের আমদানি বেড়ে যাবে। এটা ভেবেই ভালো লাগছে । শুধু তাই নয় হারিয়ে যাওয়া দেশী অনেক মাছই আবার নতুন করে ফিরে আসতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ।

রাজ্যের বিশিষ্ট মৎস্য গবেষক অরিন্দম চক্রবর্তীও আশাবাদী। অরিন্দম নদী থেকে হারিয়ে যেতে বসা জ্যান্ত মাছ কেনেন জেলেদের কাছ থেকে। জেলেদের বলা আছে, দেশি মাছ জ্যান্ত থাকলে তাঁকে জানাতে। তিনি সেগুলো বেশি দামে কিনে নেন। অরিন্দম জানান, এখনও গঙ্গায় দেশি কাতলা, রুই, গঙ্গার পাঙাস, বেতরঙ্গি, আড়, সরপুঁটি ছাড়াও তিন ধরনের সুস্বাদু বাটা মাছ পাওয়া যায়। ইতিমধ্যেই এই গবেষক আড় মাছ-সহ একাধিক এই ধরনের নদী থেকে পাওয়ায় মাছের প্রজনন করতে পেরেছেন। অরিন্দম জানান, গঙ্গার পাঙাস মাছের স্বাদ দারুণ। তবে এখন প্রায় হারিয়ে গিয়েছে। মাঝেমাঝে জেলেদের জালে পড়ে। তাঁদের থেকে নিয়েই আড়, পাঙাস, সরপুঁটি ও বাটার প্রজনন করতে সক্ষম হয়েছেন। এই গবেষক জানান, নদী থেকে পাওয়া এই মাছগুলো সাধারণত একটু ‘বুনো’ হয়। বেশ কিছুদিন কৃত্রিম জলাশয় বা পুকুরে রাখতে হয়। তার পর বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রজনন করানো হয়। সেই মাছের চারা হলদিয়াতেও সরবরাহ করা হয়েছে। অরিন্দম জানান, এই হারানো মাছকে উদ্ধার করে আবার প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়া দরকার। আড় জাতীয় মাছের সফল প্রজনন করাতে পেরেছেন ব্রুডার মাছের দৌলতে। কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিলেই এই কাজটি করা বেশ কঠিন বলে তার ধারণা। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ দরকার। তিনি জানান, গঙ্গায় তিন ধরনের বাটা মাছ পাওয়া যায়। সেই মাছের স্বাদ আলাদা। অরিন্দম জানাচ্ছেন, মাছগুলো আবার ফিরতে পারে। এই সময় ডিম পাড়বে এই মাছের দল। জলে দূষণ নেই। লক্ষ লক্ষ ডিম থেকে যে বাচ্চা হবে তার বেশিরভাগ এবার প্রাকৃতিক ভাবেই টিকে যাবে বলে তাঁর ধারণা। গঙ্গার বড় আকারের কাতলা, রুই, মৃগেল মাছও তিনি জ্যান্ত জেলেদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর বিশ্বাস, এবার লকডাউনের মধ্যেই এই মাছের বিস্তার হতে বাধ্য।

এবার ইলিশের ‘বান ডাকতে পারে’ বলে মৎস্য বিজ্ঞানীদের ধারণা। কেন্দ্রীয় সরকারের আইন অনুযায়ী, ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন সমুদ্রে মাছ ধরা বারণ। আবার নদীতে ১৫ জুন থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাছ ধরা বারণ রয়েছে। ছোট ফাঁস দিয়ে মাছ ধরার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ রয়েছে। এবার এই সময়ের একটি বড় অংশ লকডাউনের মধ্যেই পড়েছে। ফলে চোরাগোপ্তা ইলিশ ধরার প্রবণতাও থাকবে না। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, লকডাউনের ফলে নদীতে বাধাহীন ভাবে মাছের ঝাঁক চলাফেরা করতে পারবে। দূষণ কম হওয়ার কারণে ইলিশের প্রজনন বেশি হবে। এবং গঙ্গা, হুগলি, রূপনারায়ণ নদীতে এবার বেশি ইলিশ পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। হলদিয়ার মৎস্য সম্প্রসারণ আধিকারিক সুমন সাহু বলেন, ‘‘সরকারি প্রচার ও জেলেদের মধ্যে কিছুটা হলেও সচেতনতা এসেছে। এর ফলে খোকা ইলিশ ধরার প্রবণতা কমেছে। তবে লকডাউনের ফল নদীর দূষণ কমেছে অনেকাংশে। সেই কারণেই দূষণহীন মিষ্টি জলে ইলিশের আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে আবার ফিরে আসতে চলেছে বাতাসি, ট্যাংরা, রাসবোরা চাকুন্দা, সোনা ট্যাংরার মতো মাছও।’’

হলদিয়ার কুঁকড়াহাটি এলাকার রায়নগরের শম্ভু দাস ইলিশ ধরেন। তিনি বললেন, ‘‘তিরিশ বছর ধরে নদীতে ইলিশ মাছ ধরছি। এই ধরনের পরিস্থিতি আগে দেখিনি। এতদিন ধরে নদীতে কোন জাল পড়েনি। কোনও ভুটভুটির আনাগোনা নেই। অভিজ্ঞতা বলছে এবার বেশি ইলিশ মাছ পাওয়া যাবে।’’

ইলিশ বেশি মিলবে বাঙালি খুশ। সেই সঙ্গে যদি মিষ্টি জলের স্বাদু মাছ ফিরে আসে তাহলে মৎস্য প্রিয় বাঙালির রসনা তৃপ্তির চূড়ান্ত হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন