ভাণ্ডারে তব বিবিধ ‘খাদ্যরতন’

বাঁকুড়ার খাদ্যসম্পদ বলতে কি এই মুড়ি নিয়ে তরজা বা শুধুই মুড়ি-তেলেভাজা আর মাসকলাই? মোটেই না। বাঁকুড়ার খাদ্যভাণ্ডারে রয়েছে খাদ্যের বিবিধ ‘রতন’। তার মধ্যে কাঁকড়া পিঠে ও বিষ্ণুপুরের মতিচুর উল্লেখযোগ্য। লিখছেন সুদীপ্ত চক্রবর্তী বাঁকুড়ার খাদ্যসম্পদ বলতে কি এই মুড়ি নিয়ে তরজা বা শুধুই মুড়ি-তেলেভাজা আর মাসকলাই? মোটেই না। বাঁকুড়ার খাদ্যভাণ্ডারে রয়েছে খাদ্যের বিবিধ ‘রতন’। তার মধ্যে কাঁকড়া পিঠে ও বিষ্ণুপুরের মতিচুর উল্লেখযোগ্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৯ ০২:১৪
Share:

বিষ্ণুপুরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত ‘মতিচুর’। ছবি: শুভ্র মিত্র

নারায়ণ চলেছেন আকাশপথে। সঙ্গী নারদ। হঠাৎই শোঁ-শোঁ করে আওয়াজ। সচকিত নারায়ণ সেই শব্দ শুনে নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘পবনদেব কি কোনও কারণে আমাদের বা কারও উপরে রুষ্ট হয়েছেন?’’ নারদের সহাস্য প্রত্যুত্তর ছিল, ‘‘না। আমরা এখন মর্ত্যের বাঁকুড়া জেলার উপরের আকাশপথে অবস্থান করছি। এখানকার মানুষ শালপাতার ডোংলায় (বাঁকুড়ার প্রচলিত কথায় ‘খালা’) মুড়ি নিয়ে তাতে জল ছিটে দিয়ে নরম করছে। শুকনো মুড়ির জল শোষণের সম্মিলিত শব্দই আপনার কানে প্রবেশ করছে। এর পরে এই নরম মুড়িতে কয়েকটা তেলেভাজা ভেঙে, মেখে তারিয়ে তারিয়ে খাবেন বাঁকুড়াবাসী। সে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি প্রভু।’’

Advertisement

যদিও এটি একটি প্রচলিত মজার কাহিনি, তবুও বাঁকুড়ার মানুষের মুড়িপ্রীতি সর্বজনবিদিত। বাঁকুড়াবাসীর মুড়ি খাওয়া নিয়ে আরও একটি ছড়া কথিত রয়েছে। ছড়ার পিছনের কাহিনিটি এ রকম—

কোনও এক বর্ধমানবাসীর বাড়িতে বাঁকুড়াবাসী নতুন জামাই এসেছেন। তাঁকে দেখে বাড়ির ছেলেরা সুর করে ছড়া কাটছে—

Advertisement

‘বাঁকুড়াবাসী, মুড়ি খায় রাশি রাশি’,—এই ছড়া শুনে জামাই বেচারা লজ্জায় চুপ। কিন্তু জামাইয়ের সঙ্গী চাকর কুঞ্জ হার মানতে নারাজ। সে তখন সুর করে বলছে—

‘শিব লিখেছেন তন্ত্রসারে

মাংসতুল্য গুণ মাসকলাই ধরে।।

এমন ডালে যে দোষারোপ করে,

ধরে বেঁধে তাকে পাঠাই দ্বীপান্তরে।।’

বাঁকুড়ার খাদ্যসম্পদ বলতে কি এই মুড়ি নিয়ে তরজা বা শুধুই মুড়ি-তেলেভাজা আর মাসকলাই? মোটেই না। বাঁকুড়ার খাদ্যভাণ্ডারে রয়েছে খাদ্যের বিবিধ ‘রতন’। সেই বিবিধ রতন নিয়ে বলতে গেলে পিছিয়ে যেতে হয় মল্লযুগে।

মল্লরাজাদের রাজধানী ছিল বিষ্ণুপুর। যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে আসে তখনও বাঁকুড়া নামে আলাদা কোনও অঞ্চল অথবা জেলার অস্তিত্ব ছিল না। ছিল ‘জঙ্গলমহল’ জেলা, যা ১৮০৫ সালে ২৩টি পরগনা নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এই পরগনার মধ্যে ছিল বীরভূম, বর্ধমান ও মেদিনীপুরের কিছু অংশ। জঙ্গলমহল জেলার সদর ছিল বাঁকুড়া শহরে।

১৮৮১ সালে বাঁকুড়া জেলা গঠিত হয়। এর আগে পর্যন্ত জেলার বেশির ভাগ অঞ্চলই ছিল বনভূমি, মল্লরাজাদের বিষ্ণুপুরকেন্দ্রিক মল্লভূমকে নিয়েই ছিল মূল জনবসতি। এই মল্লরাজাদের অন্যতম রাজা বীর হাম্বির বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করে বিষ্ণুপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অপূর্ব সব মন্দির গড়ে তোলেন। সে সব মন্দিরে পুজোর নৈবেদ্যে বৈচিত্র আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন মিষ্টির আমদানি হয় বিষ্ণুপুরে।

শোনা যায়, মল্লরাজ বীর হাম্বির কৃষ্ণনগর ও মুর্শিদাবাদ থেকে মিষ্টি তৈরি করার জন্য হালুইকর নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের বসবাসের জন্য জমিও দান করেছিলেন। অনেকেই জানি, বিষ্ণুপুরের সঙ্গে ‘মতিচুর’ মিষ্টি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। মতিচুর ছাড়া, তখনকার সময়ে ‘আবার খাব’, ‘মনোহরা’, ‘অমৃতখণ্ড’ ইত্যাদি মিষ্টিও যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল।

মুড়ি-তেলেভাজা, মাসকলাই ও মতিচুরের পরেই বাঁকুড়ার আর একটি খাদ্য নিয়ে মজার জনশ্রুতি আছে। এই খাদ্যবস্তুটি হল—তাল। তাল থেকে তৈরি পিঠে বাঁকুড়ার ঐতিহ্য। তাল বাঁকুড়ার কিছু অংশের মানুষের কাছে এত জনপ্রিয় ছিল যে বলা হয়, তালের জন্য নাকি এক বার মামলা হওয়ার উপক্রমও হয়। অবশ্য বাঁকুড়ার ইন্দাস, খাতড়া, সারেঙ্গার কিছু অংশেই তাল বেশি জনপ্রিয়। এ ছাড়া, চাল দিয়ে তৈরি ‘কাঁকড়া পিঠে’ও খুব সুস্বাদু।

বাঁকুড়ার মানুষের পছন্দের তালিকায় দীর্ঘদিন ধরে জায়গা করে নিয়েছে পোস্ত। অনেকে অবশ্য একে ‘পোস্তু’ বলে থাকেন। মল্লরাজাদের আমলেই আফগানিস্তান থেকে আফগানদের বাঁকুড়ায় আসা। বাঁকুড়ার জলবায়ুর সঙ্গে জেলাবাসীর খাদ্য তালিকায় পোস্ত থাকার একটা সম্পর্ক রয়েছে। উষ্ণভাবাপন্ন অঞ্চল বাঁকুড়ার মানুষের কাছে পোস্ত শীতল খাবার ও রান্নাতেও সুবিধা।

বাঙালির অন্যতম প্রিয় চা পানের বিষয়টি বাঁকুড়ায় চালু থাকলেও আগে তেমন প্রচলিত ছিল না। ব্রিটিশরা ছোট-বড় বিভিন্ন গঞ্জে কলের গান চালিয়ে চায়ের মোড়ক বিক্রি করত। বিনা পয়সায় বিলি করা হত বলেও শোনা যায়। যদিও বাঁকুড়ার গরিব মানুষ চা-কে তেমন কদর দেয়নি। কিছু সম্পন্ন পরিবার ও ইংরেজ রাজকর্মচারীই এই গরম পানীয় পান করতেন। শোনা যায় যে, সুভাষচন্দ্র বসু যখন বাঁকুড়ার কোতুলপুরে কংগ্রেসের সভা করতে এসেছিলেন তখন তাঁকে গুড়-তেজপাতা সহযোগে তৈরি চা পরিবেশন করা হয়েছিল।

বাঁকুড়ার বিভিন্ন খাবারের গল্প যেমন শোনা যায়, তেমনই ‘খেতে না পাওয়া’ সময়েরও সাক্ষী এই বাঁকুড়া। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধচলাকালীন ১৯৪৩-৪৪ সালের মন্বন্তরকে ‘এক সের আকাল’ নামে ডাকা হয় এখানে। তবে বর্তমানে সেচ ব্যবস্থার উন্নতি রুক্ষ জমিকে অনেকটাই সরস করেছে। আশা করি, খোঁজ নিলে খাদ্যরসিক বাঁকুড়াবাসীর রসনা তৃপ্তির আরও উপকরণের খোঁজ পাওয়া যাবে।

লেখক হুগলির সাহিত্যকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন