স্বাস্থ্য-ব্যবস্থায় ফরাসি বিপ্লব

রোগ যেমন মানুষকে নিস্তেজ করে তেমন তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ করে। সেটিকেই আরও ঘষামাজা করে অন্য রোগীদের উপকারে লাগানো যায় না কি? কাথরিন তুরেৎ ত্যুরজিস-কে প্রশ্নটা ভাবাত।

Advertisement

তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

রোগী বিশ্ববিদ্যালয়’। এই প্রতিষ্ঠানটি প্যারিসের পিয়ের ও মারি কুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিভাগেরই অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত চিকিৎসা বিভাগে হবু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রশিক্ষণ পান। এখানে তার সঙ্গেই যুক্ত রোগী-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা। এখানে প্রধানত ‘অভিজ্ঞ’ রোগীরাই বিভিন্ন পাঠ্যক্রমে ভর্তি হন। রোগ-সম্পর্কিত বিজ্ঞানের বুনিয়াদ পোক্ত করেন, অন্যান্য আর্তের সঙ্গে সংলাপ বিনিময় শেখেন। প্রতিষ্ঠানটির সূচনা ২০০৯-এ। প্রকল্পটি সফল হওয়ায় গ্রনব্ল, মার্সেই, লিয়ঁ, তুলুজ প্রভৃতি শহরেও অনুরূপ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ।

Advertisement

রোগ যেমন মানুষকে নিস্তেজ করে তেমন তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ করে। সেটিকেই আরও ঘষামাজা করে অন্য রোগীদের উপকারে লাগানো যায় না কি? কাথরিন তুরেৎ ত্যুরজিস-কে প্রশ্নটা ভাবাত। তিনি দেখেছিলেন, দুরারোগ্য রোগীরা চিকিৎসা পদ্ধতির জটিলতায় দিশেহারা। উদ্বেগ, হতাশা, দ্বিধায় জর্জরিত। চিকিৎসক কিংবা স্বাস্থ্যকর্মীদের পক্ষে প্রতিনিয়ত তাঁদের আশ্বাসন বা সঙ্গদান সম্ভব নয়। তখনই এগিয়ে আসেন প্রশিক্ষিত রোগীরা। শুধু রোগীকে নয়, চিকিৎসককে পর্যন্ত তথ্য জুগিয়ে, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন। চিকিৎসা দুনিয়ায় এ এক নিঃশব্দ বিপ্লব। রোগীরা আর চিকিৎসা-পরিষেবার নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা নন, তাঁরা সক্রিয় পরিষেবা-দাতাও। কিন্তু কাথরিন ত্যুরেতের মনে ধারণাটা দানা বাঁধারও একটি প্রেক্ষিত আছে।

আশির দশক। কাথরিন ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত। এডস রোগীদের মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব বুঝছেন। তখনই অনুধাবন করলেন, রোগীরও সমাজকে অনেক দেওয়ার থাকে! অন্য রোগীর জীবনে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকায় তখন এডস মহামারি। রোগটির সঙ্গে সমপ্রেমের যোগ থাকায় আক্রান্তরা একঘরে হয়ে পড়ছেন। হাসপাতালে অবহেলা সইছেন। নির্বাসনের মধ্যেই মৃত্যুর দিন গুনছেন। তখনই জেসি পিলের মতো সমপ্রেমীরা নতুন লড়াইয়ের শপথ নিলেন। রোগ সংক্রান্ত তথ্য জোগাড়ে তৎপর হলেন। এই প্রথম তাঁরা যেন সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায়! ১৯৮২-তে নিউ ইয়র্কে ‘গে মেন হেলথ সার্ভিস’ প্রশ্ন তুলল, ‘‘আমরা মৃত্যুপথযাত্রীরা নিজেদের মৃত্যুকে সমাজের উপকারে উৎসর্গ করতে পারি কি?’’

Advertisement

এই প্রশ্নের সূত্রেই রোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্তন। এখানে রোগীদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান-ভাণ্ডারে পরিণত হচ্ছে। রোগের বিষ থেকে তৈরি হচ্ছে জীবনের অমৃত। রোগী মানেই বাতিল নন। বরং তা তাঁর নতুন পরিচিতি, নতুন উজ্জীবন— সেই বোধে শান দিতেই এই উত্থান।

ফ্রান্সের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ইদানীং একটা কথা শোনা যাচ্ছে। ‘স্বাস্থ্য-গণতন্ত্র’ (ডেমোক্রেসি স্যানিটেয়ার) এবং রোগীর অধিকার। চিকিৎসা ব্যবস্থা রাষ্ট্রের ও বৃহৎ পুঁজির শক্তিতে বলীয়ান। তার আধিপত্যের সামনে সাধারণ নাগরিকের অধিকার ধুলায় লুটায়। হাসপাতালকে স্বাস্থ্য পরিষেবার মূর্ত রূপ ধরলে, তার প্রতি সাধারণের দু’টি পরস্পরবিরোধী মনোভাব খেয়াল করা যায়। ১) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদপূর্ণ চরম নির্ভরতার জায়গা, ২) পরিষেবা-জনিত আস্থা-অনাস্থার টানাপড়েন, যার প্রতি বাঁকে মৃত্যুভয়— রোগ-যন্ত্রণার আগার। আকর্ষণ ও বিকর্ষণ, এই দুই তীব্র আবেগেরই উৎস অসহায়তা।

আধুনিক চিকিৎসার জন্মলগ্ন থেকেই ডাক্তার ও রোগীর সংলাপটা একপেশে। শুশ্রূষার আর এক অর্থ ‘শোনবার ইচ্ছা’। সেটাই যেন বিস্মরণে। রোগীর কথা শোনা কী? অসুস্থ মানেই তো সাবালকত্বের ইতি, ভালমন্দ বিচারক্ষমতার বিলোপ। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে এই ধারণাকে প্রথম খণ্ডন করেন ফরাসি দার্শনিক জর্জ কঁগিলেম। বলেন, রোগ দেহে ক্ষয় ধরায়, ব্যক্তিত্ব কিন্তু অটুট থাকে। তাই চিকিৎসায় রোগীর সক্রিয় অংশগ্রহণ আবশ্যিক। এডস রোগীদের আন্দোলনের পর এই দাবি আরও জোরালো হয়। নব্বইয়ের দশকের ফ্রান্সে গড়ে উঠতে থাকে অজস্র রোগী-অধিকার মঞ্চ। আঞ্চলিক ও জাতীয় স্তরে বিষয়টিতে বিতর্ক শুরু হয়। ২০০২-এ রোগীর অধিকার আইনত স্বীকৃতি পায়। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী কুশনারের নামে তা ‘কুশনার আইন’ নামে খ্যাত, যার মূল বিষয় রোগীর আত্মমর্যাদা। সেটি অক্ষুণ্ণ রাখতে চিকিৎসালয়কে সতর্ক থাকতেই হবে।

এই আইনি মর্যাদারই ফলিত প্রয়োগ রোগী বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পে। যাঁরা এত দিন মৃত্যুর অপেক্ষা করছিলেন, কর্মসংস্থানের মাধ্যমে, তাঁদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়েছে প্রকল্পটি। অনেক কষ্টে সমাজকে বোঝানো হয়েছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোগীরা এক জরুরি পরিষেবা দিতে সক্ষম, যা কেবল রোগীরাই পারেন। সুদীর্ঘ রোগভোগের অভিজ্ঞতাই এই বিশেষ সক্ষমতার আকরস্থল। দ্বিতীয়ত, এই সামাজিক স্বীকৃতি, আত্মমর্যাদাবোধ রোগীকে অসুস্থতার সঙ্গে জুঝতেও শক্তি জোগায়। তৃতীয়ত, এই উদ্যোগে রুগ্ণ স্বাস্থ্যবিভাগও আরোগ্যের পথে।

প্যারিসের প্রাচীনতম হাসপাতাল ‘ওতেল দিয়্য’-র কথা ছাড়া এ কাহিনি অসমাপ্ত। বাজেট সঙ্কোচনের কোপে প্যারিসের রুগ্ণ হাসপাতালটি বন্ধ হতে বসেছিল। নাগরিক আন্দোলনে সমস্যা মেটে। এখানেই দার্শনিক সিন্থিয়া ফ্ল্যরির উদ্যোগে তৈরি দর্শনচর্চা কেন্দ্রে চিকিৎসার দর্শনগত ও সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় ‘রোগী বিশ্ববিদ্যালয়’-এর ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞ ছাড়াও বক্তৃতা-সভায় সকলেরই অবারিত দ্বার। এই উদ্যোগ হাসপাতালের রোগক্লিষ্ট চৌহদ্দিতে নতুন জীবনের ছোঁয়া এনেছে। মানুষ ও হাসপাতালের মধ্যের দূরত্ব মিটিয়েছে। স্বাস্থ্য-পরিষেবার যান্ত্রিকতা সরিয়ে, মানবিকতার প্রতিষ্ঠা করেছে। সিন্থিয়া মূলত তাত্ত্বিক আর কাথরিন সংগঠক। তাঁদের এই যুগলবন্দি শুধু স্বাস্থ্যের গণতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যকেও সুরক্ষিত করেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন