সম্পাদকীয় ২

ভাবনার দায়

সচরাচর কটূক্তি বা অবাঞ্ছিত মন্তব্য প্রচারের উপর নিয়ন্ত্রণের কথা উঠিলেই বাক্‌স্বাধীনতার যুক্তিতে তাহার প্রতিবাদ করা হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৮ ০০:১১
Share:

ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা এস ভি শেখর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আপাতত রেহাই পাইয়াছেন। সোশ্যাল মিডিয়া বা জনমাধ্যমে এক মহিলা সাংবাদিক সম্পর্কে কটূক্তি প্রচারের অভিযোগে তাঁহার বিরুদ্ধে এফআইআর করা হইয়াছিল, অতঃপর তিনি আগাম জামিনের আবেদন করিয়াছিলেন, কিন্তু মাদ্রাজ হাইকোর্ট অভিযুক্ত আচরণের কঠোর নিন্দা করিয়া আবেদন নামঞ্জুর করে। এস ভি শেখর সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। সুপ্রিম কোর্ট বলিয়াছে, ১ জুন মামলা শুনিবে, তাহার আগে অবধি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনও দমনমূলক ব্যবস্থা লওয়া যাইবে না— অর্থাৎ তাঁহাকে গ্রেফতার করা চলিবে না। এ দেশে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতারের পরে জামিন না দিয়া কার্যত বিচারের আগেই দণ্ডদানের যে অবাঞ্ছিত এবং অন্যায় রীতি জারি রহিয়াছে, মাদ্রাজ হাইকোর্ট বিজেপি নেতার আগাম জামিনের আবেদন নাকচ করিবার ফলে এই ক্ষেত্রেও তাহার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা ছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশটি স্বাগত।

Advertisement

কিন্তু জনমাধ্যমে কটূক্তি প্রচার বিষয়ে মাদ্রাজ হাইকোর্ট যে তিরস্কার করিয়াছিল, তাহার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এস ভি শেখর জানাইয়াছিলেন, তিনি অন্যের প্রেরিত বার্তাটি না পড়িয়াই ‘শেয়ার’ করিয়াছিলেন, পরে জানিতে পারিয়া সেটি মুছিয়াও দেন, সুতরাং তিনি নিরপরাধ। হাইকোর্ট এই সওয়াল নাকচ করিয়া বলিয়াছে, (স্বকৃত হোক বা অন্যের প্রেরিত) যে কোনও বার্তা যিনি জনমাধ্যমে প্রচার করিতেছেন, ধরিয়া লইতে হইবে তিনি সেই বার্তার বক্তব্য অনুমোদন করেন, সুতরাং তাহার দায় তিনি এড়াইতে পারেন না। বর্তমান সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত বিচার করিলে এই মন্তব্যের তাৎপর্য অসীম। প্রতি মুহূর্তে অগণিত বাক্য ও দৃশ্য অগণিত মানুষ জনমাধ্যমের সাহায্যে অগণিততর মানুষকে জানাইয়া দিতেছেন— ‘শেয়ার’ কথাটির অর্থই দেখিতে দেখিতে রূপান্তরিত! বহু ক্ষেত্রেই যিনি একটি বার্তা ভাগ করেন তিনি তাহা ভাল করিয়া না পড়িয়াই, তাহার অর্থ না বুঝিয়া বা না ভাবিয়াই সেটি এক বা অনেকের উদ্দেশে নিক্ষেপ করিয়া দেন, পরিণাম বিষয়ে কোনও দায়িত্ব স্বীকার করেন না। মাদ্রাজ হাইকোর্ট বলিতেছে, দায়িত্ব আছে, তাহা স্বীকার করিতে হইবে।

সচরাচর কটূক্তি বা অবাঞ্ছিত মন্তব্য প্রচারের উপর নিয়ন্ত্রণের কথা উঠিলেই বাক্‌স্বাধীনতার যুক্তিতে তাহার প্রতিবাদ করা হয়। সেই প্রতিবাদ অসঙ্গত নহে, কারণ উদার গণতন্ত্রের আদর্শের সহিত বাক্-নিয়ন্ত্রণের মৌলিক বিরোধ। কিন্তু কোনও স্বাধীনতাই নিরঙ্কুশ নহে, তাহার সীমা অনিবার্য ভাবেই পরিস্থিতিনির্ভর। জনমাধ্যমের দাপট যেখানে পৌঁছাইয়াছে, তাহাতে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন লইয়া ভাবা জরুরি। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষা স্বনিয়ন্ত্রণ সতত শ্রেয়। মাদ্রাজ হাইকোর্টের বক্তব্যে স্বনিয়ন্ত্রণেরই অনুজ্ঞা আছে। ব্যক্তি কোথায় কখন কথার রাশ টানিবে, সামাজিক দায়িত্ববোধই তাহার সুষ্ঠু নির্দেশ দিতে পারে। জনমাধ্যমের ব্যবহারকারীদের এই দায়িত্ববোধ জরুরি। যত্রতত্র মোবাইল টেলিফোনে উচ্চস্বরে কথা বলা যেমন তাহার পরিপন্থী, সোশ্যাল মিডিয়ায় আবর্জনা নিক্ষেপও তেমনই। মাদ্রাজ হাইকোর্ট একটি জরুরি সামাজিক বিতর্কের সূত্র ধরাইয়া দিয়াছে। সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে কোন পথের নির্দেশ দেয়, আপাতত তাহার প্রতীক্ষা।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন