সম্পাদকীয় ১

পাপের ফল

বলিউডের কল্যাণে তাঁহার অহিংসার একটি সরলীকৃত রূপ ‘গাঁধীগিরি’ নামে জনপ্রিয় হইয়াছে। জনপরিসরে উপস্থিত প্রতিটি প্রতীকেই তিনি নিতান্ত অ-রাজনৈতিক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৩৪
Share:

মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী এখন কয়েকটি প্রতীকের সমাহারমাত্র। স্বচ্ছ ভারত তাঁহার চশমা লইয়াছে, গ্রামীণ ভারতের স্বাবলম্বনের ভাগে পড়িয়াছে তাঁহার চরকা। বলিউডের কল্যাণে তাঁহার অহিংসার একটি সরলীকৃত রূপ ‘গাঁধীগিরি’ নামে জনপ্রিয় হইয়াছে। জনপরিসরে উপস্থিত প্রতিটি প্রতীকেই তিনি নিতান্ত অ-রাজনৈতিক। টাকার উপর তাঁহার সহাস্য মুখাবয়বেও। তবে কি ভারতের নবীন প্রজন্ম তাঁহার রাজনৈতিক সত্তাকে ভুলিয়াছে? তাঁহার শেষ অনশনের সাত দশক পূর্তি উপলক্ষে স্কুলছাত্রদের একটি দল বিড়লা হাউসে গিয়াছিল। তাহাদের কয়েক জনের কথা শুনিলে সেই ধারণা ভাঙিবে। সেই ছোট গোষ্ঠীকে একটি প্রামাণ্য নমুনা বিবেচনা করিবার কিছুমাত্র কারণ নাই, কিন্তু তাহাদের কথার যতটুকু গুরুত্ব প্রাপ্য, সেটুকু দিলেই বোঝা যায়, নবীন প্রজন্মের নিকট গাঁধীর রাজনৈতিক তাৎপর্য মূলত নেতিবাচক। কাহারও মতে, ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ ভারতে গাঁধী হিন্দুদেরই তাহাদের প্রাপ্য অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়াছিলেন। কেহ মনে করে, গাঁধীর জন্যই দেশভাগ হইয়াছিল। কাহারও ধারণা, গাঁধী যদি নেহরুর পরিবর্তে পটেলের পিছনে দাঁড়াইতেন, তবে স্বাধীন ভারতের ইতিহাস ভিন্নতর হইতে পারিত। বোঝা সম্ভব, এই ধারণাগুলি সবই সময়ের ফসল। নরেন্দ্র মোদীর ভারতের হাওয়ায় যে কথাগুলি ভাসে, এই শিশু-কিশোররা তাহার ভিত্তিতেই গাঁধীর অবয়ব রচনা করিয়া লইয়াছে। ধারণাগুলির অধিকাংশই মহাত্মা গাঁধীর রাজনৈতিক-দার্শনিক চিন্তা হইতে বহু আলোকবর্ষ দূরে। কিন্তু, তাহা এই ছাত্রদের দোষ নহে। নরেন্দ্র মোদীর যুগে গাঁধীর রাজনীতিকে প্রাসঙ্গিক রাখিতে উদারবাদী ভারত ব্যর্থ হইয়াছে।

Advertisement

কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, স্বাধীন ভারতে কি কখনও গাঁধী প্রাসঙ্গিক ছিলেন? যে ভৌগোলিক পরিধি লইয়া শেষ অবধি ভারত তৈরি হইল, গাঁধী কি সেই ভারত চাহিয়াছিলেন? অথবা, এই জাতি-রাষ্ট্র, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ, বিপুল শিল্পায়ন, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা— কিছুই কি গাঁধীর ভারতের ধারণার সহিত সংগতিপূর্ণ? তাঁহার গ্রামকেন্দ্রিক স্থানীয় স্বশসানের ধারণা, কুটির শিল্পের উপর প্রায়-সম্পূর্ণ নির্ভরতা— স্বাধীন ভারত কিছুই আন্তরিক ভাবে, প্রকৃত অর্থে, গ্রহণ করে নাই। এমনকী, নেহরু-যুগের রাষ্ট্র ধর্ম এবং ধর্মনিরপেক্ষতার, অথবা জাতিভিত্তিক অনগ্রসরতার প্রশ্নগুলিকেও যে ভাবে দেখিয়াছে, তাহার সহিত গাঁধীর অবস্থানের, বিশ্বাসের সাযুজ্য ছিল না। গাঁধীর অবস্থানগুলি অ-বাস্তব ছিল কি না, সে প্রশ্ন ভিন্ন— কিন্তু, সেই অবস্থানগুলি হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া গাঁধীকে দেখা চলে না। ফলে, কেহ যদি বলেন, তাঁহার রাজনৈতিক উত্তরসূরিদের আমলেই গাঁধী ভারতীয় রাজনীতি এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় অপ্রাসঙ্গিক হইয়া গিয়াছিলেন, তবে সেই যুক্তিটিকে এক কথায় নাকচ করিয়া দেওয়া মুশকিল।

তবুও, দায়িত্ব ছিল। গাঁধীর দর্শনের সহিত স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র-দর্শনের গঠনগত এবং অনতিক্রম ফারাক থাকিলেও, রাষ্ট্র তাঁহার মতে এবং পথে চলিতে অস্বীকার করিলেও যে তাঁহার রাজনৈতিক দর্শনকে অস্বীকার করিবার কোনও উপায় নাই, সেই কথাটি বারংবার স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয় ছিল। তাঁহার অবস্থানের সূক্ষ্ম তর্কগুলি স্পষ্ট ভাবে উপস্থাপন করা বিধেয় ছিল। বর্তমানের স্বার্থে না হইলেও, ভবিষ্যতের স্বার্থে। কোনও এক নরেন্দ্র মোদী আসিয়া যাহাতে মোহনদাস গাঁধীকে মুছিয়া না দিতে পারেন, তাহা নিশ্চিত করিবার স্বার্থে। এবং, দায়িত্বটি ছিল উদারবাদীদেরই। হিন্দুত্ববাদীরা যে গাঁধীকে নেতিবাচক ভাবেই পড়িবেন এবং পড়াইবেন, তাহাতে আশ্চর্য হইবার কারণ নাই। কিন্তু, উদারবাদীরাও যে হরেক তত্ত্ব এবং তন্ত্রের সাধনায় গাঁধীকে ভুলিয়াছেন, আজকের স্কুলপড়ুয়াদের মনে গাঁধীর নেতিবাচক ছবিটি মূলত সেই পাপেরই ফল।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন