কাঠুয়ার আট বৎসরের নাবালিকা আসিফা ও উন্নাও-এর সতেরো বৎসরের মেয়েটিকে লইয়া দেশ জুড়িয়া যাহা চলিল, নিশ্চিত ভাবে তাহা ভারতকে সভ্যতার মাপকাঠিতে এক ধাক্কায় অনেক দূর নামাইয়া দিতে পারিয়াছে। এমন নহে যে নাবালিকা ধর্ষণ কিংবা নারীনিগ্রহ এ দেশে কিছু নূতন ব্যাপার। গণধর্ষণও আজকাল রীতিমতো প্রাত্যহিক ঘটনা। কিন্তু প্রাত্যহিকতার মধ্যেও তো কিছু ঘটনা নৃশংসতা ও বিকারগ্রস্ততার মাপকাঠিতে বিশিষ্টতা দাবি করিয়া ফেলে। এ বারের দুইটি ঘটনাই সেই বিশিষ্টতার দাবিদার। বুঝিতে ভুল হয় না যে, ভারতীয় সমাজের আগাপাছতলা জুড়িয়া কোন ফাঁক দিয়া যেন একটি বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়া গিয়াছে, নতুবা নেহাত একটি আপনমনে খেলিয়া বেড়ানো বালিকাকে, কিংবা সম্ভাব্য ধর্ষককে ‘ভাইয়া’ বলিয়া ডাকা বিশ্বাসপরায়ণা কিশোরীকে দেখিয়া সঙ্গে সঙ্গে তাহাকে ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন জাত, ভিন্ন গোষ্ঠীর নিশ্চিত প্রতিনিধি ঠাহরিয়া এই পরিমাণ নৃশংসতার সামনে ফেলিয়া দেওয়া যায় না। যথেষ্ট মুক্ত পরিসর পাইলে সামাজিক পরিচিতি বা আইডেন্টিটি বস্তুটি যে কী ভাবে মানবিকতার সাধারণ বোধটিকে লোপাট করিয়া দিতে পারে, এই ঘটনায় তাহার সাক্ষাৎ প্রমাণ। ভারতীয় নাগরিক হিসাবে আজ মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইবার উপায় নাই। এই প্রবল সম্মেলক অপরাধের সামনে যে কোনও প্রতিবাদও অর্থহীন, আলঙ্কারিক। প্রতিবাদীরা জানেন, তাঁহারা যখন প্রতিবাদ শেষ করিয়া বিষয়ান্তরে চলিয়া যাইবেন, সামনে পড়িয়া থাকিবে অনতিক্রম্য অন্যায়-অধ্যুষিত এক সমাজ— যাহার অসুস্থচিত্ততার নিরাময়ের পথ কাহারও জানা নাই।
এবং কোনও প্রতিবাদীরই জানা নাই যে আট বৎসরের বালিকাকে ধর্ষণ ও নিধন যখন দলীয়/সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ হইয়া ওঠে, তখন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটিকে লইয়া ঠিক কী করণীয়। মোদীর ভারত অনেক অন্যায়, অনেক অপরাধ দেখিবার পরও আজ নূতন করিয়া হাড়েমজ্জায় শিহরিয়া উঠিতেছে, রাজনীতির সহিত নারীনিগ্রহের এই স্বাভাবিকীকৃত সমীকরণ দেখিয়া। স্বয়ং বিধায়কের আত্মীয়রা নির্যাতিতার পিতাকে প্রকাশ্যত হত্যা করিতেছেন। শাসক দল বিজেপির মন্ত্রীরা সদলবলে অষ্টম বর্ষীয়ার পরিবারের পক্ষ হইতে অভিযোগ পেশ করিবার পথে সক্রিয় ভাবে বাধা দিতেছেন। ‘হিন্দু একতা মঞ্চ’ বা ‘ভারত বচাও রথযাত্রা’, যাহাদের সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠতা সর্বজনস্বীকৃত, তাহারা এই বিষয়ে তদন্ত আটকাইবার আপ্রাণ চেষ্টায় নামিয়াছে। দুইটি স্থানেই অপরাধীদের পিছনে অটল আশ্বাসছত্র ধরিয়া আছেন দুই রাজ্যের শাসকের আসনে আসীন বিজেপি হর্তাকর্তারা। ইহাই এখন এ দেশের ‘রাজনীতি’। ‘বেটি বচাও’ স্লোগানের আড়ালে যে রাজনীতি আসলে ভয়ঙ্কর নারীবিদ্বেষের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড, পুরুষতন্ত্রের সর্বাপেক্ষা হীন ও আক্রমণাত্মক সংস্কৃতিটির সক্রিয় পুরোধা।
স্পষ্ট করিয়া বলা দরকার, ইহা বিজেপি রাজনীতিরই নিজস্ব ছাপমারা ‘ভারত’টির ছবি। যে কোনও রাজনৈতিক দলের সহিতই গুন্ডাবাজি ও অসামাজিক কাজকর্মের অশুভ বন্ধন থাকে, কিন্তু সাধারণত দলগুলি চেষ্টা করে, অন্তত প্রকাশ্যে দুষ্কৃতীদের হইতে খানিক দূরত্ব রচনা করিয়া চলিবার। বিজেপি সেই নীতিতে চলে না। বর্বর পেশিশক্তির উদ্যাপনেই যে তাহাদের রাজনৈতিক সিদ্ধির আরাধনা, তাহারা ইহাতে গর্বিত। রাজনীতির এই গর্ব ক্রমে সমাজের চালচলনও পাল্টাইয়া দিতে থাকে। তাই সামনাসামনি ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির কানফাটানো চিৎকারে ধর্ষকদের সমর্থন জাহির করা চলিতে পারে। না, এই ভারত আবহমান ভারত ভাবিলে বড় ভুল হইবে। বর্তমান সরকারের নিজস্ব ব্র্যান্ডের রাজনীতিতে প্রযত্নে লালিত পালিত পরিচালিত এই ভারত।