এই বারের নির্বাচনে তৃণমূলের স্লোগান ছিল, ‘দু’হাজার উনিশ/ বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ।’ তবে তাদের এই বিরোধী-শূন্য রাজনৈতিক মানসিকতা টের পাওয়া গিয়েছিল আগেই। যার প্রত্যক্ষ উদাহরণ পঞ্চায়েত নির্বাচন। পরোক্ষ উদাহরণ অসংখ্য। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কখনও ভয় দেখিয়ে, কখনও লোভ দেখিয়ে নিরন্তর বিরোধী ভাঙানোর এক আজব খেলা খেলেছে তৃণমূল। ‘সিপিএম-কংগ্রেসকে সাইনবোর্ড বানিয়ে দেব’— এই আগ্রাসী মানসিকতা কেবল ভাবনায় নয়, বাস্তবে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে দেখতে পাওয়া গিয়েছে। এ দোষ শাসকের। এ দোষ তাঁদেরও, ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না’ বলতে বলতে সুযোগ-সুবিধা মতো যাঁরা জার্সি বদলে আখের গুছিয়েছেন। এ দোষ এক মানসিকতার, গত কয়েক বছরে সস্তা চিনা পণ্যের মতোই যা বঙ্গীয় রাজনীতির বাজার দখল করেছে।
ফল কী হল? রাজনৈতিক ভাবে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া বিরোধীদের সেই শূন্যস্থান দ্রুত পূর্ণ করল এমন একটি দল, বঙ্গ রাজনীতিতে এত দিন যারা কার্যত হালে পানি পায়নি। বাজপেয়ীর ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’য়ের সময়ও নয়, ২০১৪ সালে ‘ব্র্যান্ড মোদী’ ঝড়ের সময়েও নয়। পাঁচ বছর আগেও হিন্দুত্ববাদী দলটি রাজ্যে ভোট পেয়েছিল টেনেটুনে ১৭ শতাংশ। আর ’১৬-র নির্বাচনে তা নেমে গিয়েছিল ১৩ শতাংশের আশপাশে।
কিন্তু তৃণমূলের ‘বিরোধী-শূন্য’ মানসিকতা সম্ভবত এতে সন্তুষ্ট হল না। দেখা গেল, শাসকের কান ফিসফিস খেলায় ক্রমশ রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠল বিজেপি। তৈরি হল মেরুকরণ। পাটিগণিতের অঙ্কে এতে লাভ দেখেছিল তৃণমূল। প্রথমত, রাজ্য রাজনীতিতে ঢাল-তরোয়ালহীন কার্যত অপ্রাসঙ্গিক একটা দলকে তোল্লাই দিলে তারা মূলস্রোতে থাকবে কিন্তু ভোট-যুদ্ধে সমানে সমানে লড়াই করতে পারবে না। আর দুই, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ‘জুজু’ রাজ্যের ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট একটি ছাতার তলায় নিয়ে আসবে।
নির্বাচনের ফলাফলে এ ছবিই উঠে এসেছে। যে মুসলিম ভোট স্বাভাবিক নিয়মেই এত দিন ভাগ হয়েছে কংগ্রেস-সিপিএম-তৃণমূল সকলের মধ্যেই, ‘বাঁচার তাগিদে’ তা এ বার তৃণমূলের ছাতার তলায় এসেছে। যদিও রাজনৈতিক ভাবে তাদের অনেকেই তৃণমূলবিরোধী। ফলে আসন সংখ্যায় ধসের ইঙ্গিত থাকলেও ভোট শতাংশে অঙ্কে তৃণমূলের ক্ষয় সে ভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজনীতি পাটিগণিত নয়। মেরুকরণের অঙ্ক কষার সময় তৃণমূল সম্ভবত ভুলে গিয়েছিল, ৩০ শতাংশের উল্টো দিকের সংখ্যাটা ৭০। মেরুকরণ এক পক্ষে হয় না। এক দিক জোট বাঁধলে, অন্য দিকেও তার প্রভাব পড়ে। ঠিক সেই অস্ত্রটিই নিপুণ ভাবে ব্যবহার করেছে বিজেপি। প্রচারে তারা এক গুচ্ছ ‘মিথ্যে’ বলেছে মেরুকরণ আরও বাড়াতে। হ্যাঁ, ‘মিথ্যে’ই। বাংলায় দুর্গা পুজো হয় না, সরস্বতী পুজো হয় না এ সব অসত্য প্রমাণ করতে যুক্তিরও প্রয়োজন হয় না, চোখ-কান খোলা রাখলেই যথেষ্ট।
আর মুসলিম তোষণ? সাচার, প্রতীচীর রিপোর্ট দেখারও প্রয়োজন নেই, রাজ্যের মুসলিম মহল্লাগুলিতে ঘুরে বেড়ালেই বোঝা যায়, বাম আমলে তারা যে তিমিরে ছিল, এখনও সেখানেই। কিছু ভাতা, রাজনৈতিক ইফতার দিয়ে সেই দৈন্যের পূরণ হয় না। মুখ্যমন্ত্রী যতই ‘গরু’র দুধ এবং ‘লাথি’র কথা বলুন।
একদা ২৩৫-এর আস্ফালন দেখিয়ে ছিল সিপিএম। ‘আমরা’র সংখ্যা আর ‘ওরা’র শূন্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে বাংলায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল। সংখ্যার দম্ভ প্রতিষ্ঠা করতে মেরুকরণের মাধ্যমে রাজ্যের বর্তমান শাসক দল যে শূন্যস্থান তৈরি করতে চাইছিল, এ বারের ভোটে বিজেপি তার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল। মানছি, বিষয়টিকে কেবলমাত্র মেরুকরণের অঙ্কে ভাবলে অতি সরলীকরণ হবে। কিন্তু মেরুকরণ শব্দটি যে বাংলার রাজনীতিতে ভিত তৈরি করে ফেলল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বোঝাই যাচ্ছে, রাজ্যের ভবিষ্যৎ অদূর ভবিষ্যৎ নাটকীয়। নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের সূচনা-পর্বে শুধু একটা কথা স্মরণে রাখা ভাল। উত্তর ভারতে মেরুকরণ এবং জাতপাতের যে চেনা রাজনীতি, তার সঙ্গে বঙ্গীয় মেরুকরণের মূলগত তফাত আছে। পঞ্জাব বাদ দিলে বাকি ভারতে দেশভাগের স্মৃতি নেই। বাংলায় তা এখনও দগদগে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়লে রাজনীতি আর কেবল রাজনীতিতে আটকে থাকে না। আবেগের সঙ্কীর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাংলার দুই প্রধান রাজনৈতিক দল সেই আগুনে হাত সেঁকতে শুরু করেছে। এই আগুন ছড়িয়ে পড়লে কী হতে পারে, ১৯৪৬ সালের বাংলা তা এক বার দেখেছিল। রাজনীতির অঙ্কে সে আগুনের মোকাবিলা করা যায় না।
আর নগর পুড়লে, দেবালয়ও রক্ষা পায় না।