সম্পাদকীয় ১

বিশ্ব ও বহুত্ব

চার বৎসর অতিক্রান্ত। ২০১৭ সাল বুঝাইয়া দিয়াছে, আন্নান সে দিন যে সংশয়ে দীর্ণ হইতেছিলেন, তাহা সময়োচিত ছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৫২
Share:

চার বৎসর আগে কোফি আন্নান কানাডার একটি বহুত্ববাদের উপর গবেষণা সংস্থায় প্রধান অতিথির ভাষণে বলিয়াছিলেন, বিশ্বায়নের মধ্যে বিশ্বকে সংহত করিবার, সব মানুষের কাছাকাছি আসিবার সম্ভাবনা নিহিত আছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত বাস্তবে সেই সংহতি ঘটিবে কি না, তাহা নির্ভর করিতেছে মানুষেরই একটি বিবেচনার উপর। বিবেচনাটি ইহাই যে, বিশ্বদুনিয়ায় মানবসমাজের মধ্যে যত রকম বিভাজন ও সংঘর্ষ, তাহাকে মানুষ কতখানি গুরুত্ব দিবে। যদি মানুষে মানুষে সংঘর্ষই বেশি গুরুত্ব পায়, তাহা হইলে বিশ্বায়ন অতি দ্রুত বিশ্বের বাস্তবটিকে ছারখার করিয়া দিতে পারে। আর, যদি সংঘর্ষকে পিছনে রাখিয়া অন্যান্য ঐক্যমূলক কাজগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তবে বিশ্বায়নের ভিতরে নিহিত এই চ্যালেঞ্জটি কাটাইয়া ওঠা সম্ভব হইতে পারে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ভূতপূর্ব মহাসচিবের কথাটি সে দিন অনেকেরই মর্মে গাঁথিয়া গিয়াছিল। এইটুকু সতর্কীকরণের মধ্য দিয়াই তিনি বুঝাইয়া দিয়াছিলেন— গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বহুত্ববাদের সহায়ক হইলেও ইহারা বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার ‘শর্ত’ হিসাবে যথেষ্ট এবং ‘পথ’ হিসাবে নিশ্চিত হইতে পারে না। কেননা, তেমন পরিস্থিতিতে দেশগুলি পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমেও বহুত্ববাদকে বিনাশ করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিতে পারে। আবার, কোনও দেশের অধিকাংশ মানুষ চাহিলে নিজেদের মধ্যে হাত মিলাইয়া সমাজের বহুত্বকে সহজেই ধুইয়া-মুছিয়া সাফ করিয়া দিতে পারে। অর্থাৎ বহুত্বকে ধরিয়া রাখিতে প্রয়োজন: গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিকতার পাশাপাশি বহুত্বের নীতিটির প্রতি সম্মান।

Advertisement

চার বৎসর অতিক্রান্ত। ২০১৭ সাল বুঝাইয়া দিয়াছে, আন্নান সে দিন যে সংশয়ে দীর্ণ হইতেছিলেন, তাহা সময়োচিত ছিল। গণতন্ত্র, আন্তর্জাতিকতা ইত্যাদি সব দিব্য বহাল তবিয়তে থাকিলেও মাঝখান হইতে আক্রান্ত ও বিনষ্ট হইতে বসিয়াছে— বহুত্ববাদের সম্মান ও স্বীকৃতি। লক্ষণীয়, প্রতিক্রিয়াশীলতার মাত্রা বাড়িয়াছে বহুত্বের সহিত পাল্লা দিয়া। অর্থাৎ যে দেশের সমাজে জনবৈচিত্র বেশি, তাহারাই সংখ্যালঘু ও প্রান্তিকদের বিরুদ্ধে বেশি আক্রমণপরায়ণ হইয়াছে। যে দেশগুলি বহুত্বে নিমজ্জিত, তাহারাই সর্বাধিক অসহিষ্ণু বিদ্বেষ-বিষাক্ত নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটাইয়াছে। স্বভাবতই সর্বাগ্রে মনে পড়িবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম। তাঁহার সরকারের বদান্যতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ একের পর এক অসহিষ্ণু নীতিতে স্বাক্ষর করিতে ব্যস্ত। তাঁহার বিদ্বেষবাদী নেতৃত্ব দেশের বিভিন্ন কোণে ভয়ংকর বর্ণবিরূপতা, ধর্মবিরূপতা জাগাইয়া তুলিতে তৎপর, এমনকী একাকী নাগরিকও আজ বন্দুক কাঁধে ভিনদেশি-মৃগয়ায় বাহির হইতে দ্বিধা করেন না। ইহা একটি নূতন পরিবেশ। কোনও সাময়িক অস্থিরতা বা উদভ্রান্ততা দিয়া এই পরিবেশকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এই পরিবেশের মূলগত কথাটি হইল: ভিন্ন রকম মানুষ সমান অধিকারের উপযুক্ত নয়।

বর্তমান বিশ্ব এই বহুত্ববিনাশী বার্তার কবলে জর্জরিত। জাতীয়তাবাদও এই ভাবনায় আদ্যন্ত অভিষিক্ত। কোথাও সে জাতীয়তাবাদ অভিবাসী-বিরোধী, কোথাও উদ্বাস্তু-বিরোধী, কোথাও সংখ্যালঘু-বিরোধী। আমেরিকা, ব্রেক্সিট-গ্রস্ত ব্রিটেন, উগ্র রক্ষণশীলতায় পুনর্দীক্ষিত অস্ট্রিয়া, দক্ষিণপন্থায় উপদ্রুত জার্মানি হইতে শুরু করিয়া গণতন্ত্রের মন্দির বলিয়া পরিচিত ভারত, সর্বত্র একই করাল ছায়া। বলশেভিক বিপ্লবের শতবর্ষে দাঁড়াইয়া শোনা গেল কী ভাবে বিভিন্ন দেশে দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলকে রাশিয়া গোপন সহায়তার ভেট পাঠাইতেছে, কোনও কালেই সহনশীলতার ধ্বজা উড়াইবার খ্যাতি নাই যে চিনের, তাহারাও এ বৎসরে ক্ষিপ্ত হিংসাত্মক অভিবাসী-বিরোধিতায় লিপ্ত হইয়াছে। সংকীর্ণতা আর আত্মসর্বস্ববাদের বহুমাত্রিক উদ্‌যাপনই ২০১৭ সালটির বিশিষ্ট অভিজ্ঞান।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন