বাজেটে চাষির জন্য কেবল কার্পণ্য নেই, প্রতারণাও আছে

হাতে রইল নকুলদানা

মোদী বলছেন, চাষির রোজগার দ্বিগুণ করবই করব। মমতা বলছেন, তিনগুণ করেই দিয়েছি। রাজ্যের বাজেট বলছে অন্য কথা। এই কি রোজগেরে চাষির বাজেট? এ তো ভিখিরি-চাষির জন্য বাজেট।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:১০
Share:

নেতারা কী বলছেন, জানতে চাইলে টিভি দেখলেই হয়।

Advertisement

নেতারা কী করছেন, জানতে চাইলে দেখতে হয় বাজেট।

মোদী বলছেন, চাষির রোজগার দ্বিগুণ করবই করব। মমতা বলছেন, তিনগুণ করেই দিয়েছি। রাজ্যের বাজেট বলছে অন্য কথা। এই কি রোজগেরে চাষির বাজেট? এ তো ভিখিরি-চাষির জন্য বাজেট।

Advertisement

মোটা হিসেবই সে কথা বলে দেয়। চাষির সহায়তায় যত রকম বরাদ্দ (চাষের জন্য আগাম অনুদান, পেনশন, চাষির মৃত্যুতে অনুদান, ফসলবিমার প্রিমিয়াম) তা ২০১৯-২০ সালের কৃষি বাজেটের তেষট্টি শতাংশ। তার উপর কৃষি দফতরের প্রশাসনিক খরচ ধরলে দাঁড়ায় বাজেটের তিন ভাগের দুই ভাগ। এক ভাগ থাকে রোজগার বাড়াতে।

আপত্তি উঠবে, কেন? ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পে পাঁচ হাজার টাকা অনুদান চাষের জন্য খরচ কমাবে। তাতে রোজগারও বাড়বে? ঠিক, তবে শর্ত একটাই। চাষি যদি ফসলের দাম পায়। খেতে ফসল পচে যদি, তা হলে অনুদানে বড় জোর ক্ষতি একটু কমবে। রোজগার বাড়াতে চাইলে বাজার ধরাতে হবেই।

কী করলে চাষি বাজার ধরতে পারে, তার ফর্দ বহু আলোচিত। গ্রাম থেকে বাজারের রাস্তা চাই, নতুন নতুন বাজার চাই, সব্জির হিমঘর চাই। আলু থেকে চিপস, সরষে থেকে তেল তৈরি অর্থাৎ প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা চাই। ভিনরাজ্যে, ভিনদেশে আরও বেশি রফতানি চাই। সে সব কাজের জন্য কী দেওয়া হল বাজেটে?

চাষিকে বাজার ধরাতে কাজ করে কৃষি বিপনন দফতর। তার বরাদ্দ এমনিতেই যৎসামান্য, বেড়েছেও নামমাত্র। ফসল বিপণন ও মান উন্নয়নের খাতে যা প্রশাসনিক খরচ (সাড়ে তেরো কোটি টাকা) তার চাইতে পরিকাঠামো তৈরির বরাদ্দ কম (বারো কোটি টাকা)। অথচ আলু অন্য রাজ্যে যাতে যায়, সে জন্য ট্রেন-ট্রাকের খরচে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে সাড়ে চোদ্দো কোটি টাকা। ফসল মজুতেও (স্টোরেজ) যেটুকু বরাদ্দ বেড়েছে, তা প্রশাসনিক খাতে। গোলা-গুদামের অনুদান কমেছে।

ভাল চাষ করতে লাগে ভাল বীজ। বীজ কেনা চাষির কাছে ফাটকা খেলার মতো, ব্যবসায়ীর মুখের কথায় নির্ভর করতে হয় তাকে। বিশেষত পাট ও আলুতে ঠগবাজির ‘সফট টার্গেট’ এ রাজ্যের চাষি। পঞ্জাব বা কর্নাটকে বীজ তৈরিতে সরকার অনেক তৎপর। অথচ এ রাজ্যের কৃষি বাজেটে বীজ তৈরি, বণ্টন, প্রশিক্ষণ, এমনকি প্রশাসনিক খরচেও বরাদ্দ কমেছে। নতুন করে ত্রিশ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে বীজের মান পরীক্ষার তিনটি নতুন ল্যাবরেটরি নির্মাণে। তা হলে মোট ল্যাব হবে আটটি। তাতে রাজ্যের কত চাষির কাছে পরীক্ষিত, শোধিত বীজ পৌঁছনো যাবে? বাড়তি অনুদান পেয়েও যদি ভাল বীজের নাগাল না পায় চাষি, রোজগার বাড়বে কি?

চাষ করতে লাগে মাটি। মাটির স্বাস্থ্যপরীক্ষা, স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য চলতি বছরে যা খরচ হয়েছে, আগামী বছরে ধার্য হয়েছে তার চাইতে কম। কেন? মাটির স্বাস্থ্য কার্ড যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরাও কি মাটির চরিত্র বুঝে চাষ করছেন? কে-ই বা তার পদ্ধতি জানাবে তাঁদের। কৃষি প্রযুক্তি সহায়কের প্রায় চল্লিশ শতাংশ পদ শূন্য।

সব রাজ্য যে খয়রাতি করতে গিয়ে পরিকাঠামোয় কুড়ুল মারছে, এমন কিন্তু নয়। তেলঙ্গানা ‘রায়তুবন্ধু’ চালু করে চাষিদের আগাম অনুদান দিচ্ছে, কিন্তু পরিকাঠামোর জন্য বরাদ্দও বাড়িয়েছে। এ রাজ্য সেই পথ নেয়নি। বরং কৃষি বাজেটের বাইরেও চাষির সহায়তার নানা প্রকল্পে বরাদ্দ বেড়েছে। কেবল গত মাস তিনেকে সরকার পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে চাষির থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান কিনতে। খরা-বন্যার ক্ষতিপূরণ বাবদ খরচ হচ্ছে গড়ে বছরে তিনশো কোটি টাকা।

কেন এই ঝোঁক? একটা কারণ অবশ্যই নির্বাচনী রাজনীতি। প্রচুর ভোটে জিতে আসার পর পর প্রত্যয়ী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার কৃষি বিপণনের পরিকাঠামো উন্নত করতে বেশ কিছু খরচ করেছিল। ব্লকে ব্লকে কিসান মান্ডি, রাজ্যজুড়ে প্রচুর গুদাম তৈরি, বেশি চাহিদার ফসল (বর্ষাকালীন পেঁয়াজ, সরষে, ডাল) ফলানোর ট্রেনিং দিয়ে চাষিকে বাজার ধরানো, এমন উদ্যোগ নিয়েছিল। ক্রমে অবস্থান সরেছে। চাষির হাতে টাকা পৌঁছনোর তাগিদ বেড়েছে। কৃষিতে বিনিয়োগের ঝোঁক কমেছে।

কেবল কার্পণ্য নয়। প্রতারণাও আছে। চাষির জন্য যে টাকা রাখা হয়েছে, তার অনেকটাই ঠাকুরঘরের রেকাবিতে নকুলদানা রাখার মতো। খরচ হবে না, জেনেই রাখা। এই প্রতারণায় হাত ধরাধরি করে চলছে কেন্দ্র ও রাজ্য। গরিব চাষির রোজগার বাড়াতে উন্নত মাটি, খামার, ক্ষুদ্র সেচ ইত্যাদি পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য মোদী সরকার ঘোষণা করেছিল ‘রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা’। এর পর ফসল বিমার প্রিমিয়াম, সহায়ক মূল্যে ফসল কেনা প্রভৃতি সহায়তার টাকা যত বেড়েছে, তত কাটা গিয়েছে কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা।

রাজ্য তাতে চেঁচামেচি জুড়েছে, এমন কিন্তু না। কারণ, কেন্দ্র যদি ষাট শতাংশ দেয়, রাজ্যকে দিতে হয় চল্লিশ। কেন্দ্র কম দিলে রাজ্যকেও ‘ম্যাচিং গ্রান্ট’ দিতে হয় না অতটা। কিন্তু নতুন বাজেট তৈরির সময়ে সেই না-দেওয়া টাকা ধরে নিচ্ছে রাজ্য। যেমন, এ বছর বীজ খামারের উন্নতির জন্য রাজ্যের পাওয়ার কথা ছিল ১৩০ কোটি টাকা, পেয়েছে মাত্র কুড়ি কোটি। তা সত্ত্বেও আগামী বছরের বাজেটে দেড়শো কোটি টাকা কেন্দ্রীয় অনুদান ধরেছে রাজ্য। নিজের তরফে ম্যাচিং গ্রান্ট দেখাচ্ছে সাড়ে চারশো কোটি টাকা (যা এ বছরের প্রকৃত খরচের তিনগুণ)। এটা অবৈধ হয়তো নয়, কিন্তু অনৈতিক। ছ’শো কোটি টাকা খরচ কার্যত অসম্ভব, জেনেও ভুল বোঝানো হচ্ছে। কৃষি বাজেটের অনেকটাই এমন ফোঁপরা বরাদ্দ। টিভিতে নরেন্দ্র মোদী আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথার লড়াইতে কান পাতা দায়। কিন্তু বাজেট খুললে বোঝা যায়, তাঁরা নীরবে হাত মিলিয়েছেন।

এই না-বলা বঞ্চনার অনেকটাই হচ্ছে গরিবের সঙ্গে। কৃষি বিপণনের খাতে তফসিলি জাতি ও জনজাতির চাষিদের জন্য কেন্দ্রের দেওয়ার কথা ছিল ত্রিশ কোটি টাকা। দিয়েছে কত? লিখতেও লজ্জায় কুঁকড়ে যায় আঙুল, সাড়ে তিন কোটি টাকা।

মোট বিয়াল্লিশ কোটি টাকা পাওনা ছিল যাদের, রাজ্য-কেন্দ্র মিলে তাদের দিচ্ছে পনেরো কোটি টাকা। নতুন বাজেটে রাজ্য কিন্তু (একত্রিশ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় অনুদান ধরে) ফের চুয়াল্লিশ কোটি টাকা বরাদ্দ দেখিয়েছে।

আক্ষেপ, রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে সংরক্ষণের রাজনীতি। নইলে দলিত নেতারা প্রশ্ন করতে পারতেন, কেন কৃষি বাজেটে দলিত-আদিবাসীদের বরাদ্দ ছাপ্পান্ন কোটি টাকা কমল নির্বাচনের বছরেও? রুক্ষ, বৃষ্টি-নির্ভর এলাকায় চাষকে লাভজনক করার প্রকল্প থেকে কেন বাদ গেল চল্লিশ কোটি টাকা? উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি-বাড়ির জন্য রাজ্য সাধারণ খাত থেকে যা দিচ্ছে, তফসিলি জাতি-জনজাতির বরাদ্দ থেকে দিচ্ছে তার প্রায় দ্বিগুণ। এর মানে কী? দলিত-আদিবাসীকে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার উদ্দেশ্য কি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি-বাড়ি বানানো ছিল?

এ রাজ্যের কৃষি বাজেট পড়লে দুটো কথা মনে আসে। এক, বাজেটকে এত দিন সরকারি নথি বলে মনে করা হত। যা খরচ হওয়ার কথা ছিল, যা খরচ হয়েছে, আগামী বছর যা হবে, তার হিসেবই ছিল বাজেট। কিন্তু এখন বাজেট হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাজনীতির ‘ন্যারেটিভ’। যেখানে সংখ্যা লিখে ঘোষণা করা হচ্ছে, নাগরিকের অপ্রাপ্য কিছু নেই, নেতারও অসাধ্য কিছু নেই। চলতি বছর আর আগামী বছরের বরাদ্দের আস্ফালনের মধ্যে কাঁচুমাচু দাঁড়িয়ে ‘সংশোধিত বাজেট’ কলামের কিছু শীর্ণ সংখ্যা। কী বাজেট বক্তৃতায়, কী রাজনৈতিক বিরোধিতায়, সেগুলো এলেবেলে হয়ে গিয়েছে।

দুই, সরকারের টাকায় অগ্রাধিকার কার, সে প্রশ্নটা খারিজ হয়ে যাচ্ছে। এত দিন মনে করা হত, যে যত দরিদ্র, তার তত বেশি দাবি। কিন্তু আজ অতি-গরিব, অল্প-গরিব, অ-গরিব, সবাইকে ‘সমান’ দেওয়ার পক্ষ নিচ্ছেন দেশের নেতারা। সবার ফসল সরকারি দরে কেনা হবে। সবাই চাষের অনুদান পাবে। ফসল মার খেলে সমান হারে ক্ষতিপূরণ পাবে সকলে। শাসক তা-ই চায়, বিরোধীও।

আশঙ্কা জাগে, তা হলে গরিবের কী হবে? এ রাজ্যের কৃষি বাজেট দেখাচ্ছে, সে পড়ছে পিছনে। দলিত-আদিবাসী চাষি, শুষ্ক-রুক্ষ এলাকার চাষি, গরুর গাড়ি-সর্বস্ব চাষি, মহিলা চাষি, সবার অনুদান কাটা গিয়েছে সেই বছরে, যে বছর রাজ্য সরকার প্রায় কল্পতরু হয়েছে। চাষির স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও পরিবারকে দিচ্ছে দু’লক্ষ টাকা।

অসাম্য কমানোর এই কি পথ?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন