জনস্বাস্থ্যকে অবহেলার ফল

জনস্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ যদি দৈনন্দিন বিষয় না হয় তবে এ ধরনের দুর্বলতা অনিবার্য। আজ প্রথম পর্ব। আসলে রোগটিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যত বেশি হবে তত বেশি করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতার দায় শাসকের উপর বর্তাবে।

Advertisement

মানবেশ সরকার

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

নিজেরা আক্রান্ত হয়ে বা প্রচারমাধ্যমের দৌলতে ডেঙ্গি বা ডেঙ্গু নামক ভাইরাসজনিত রোগটির সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গে এখন সকলেই কম-বেশি অবহিত। ‘এডিস ইজিপ্টাই’ নামের এক ধরনের মশার কামড়েই যে এই রোগ ছড়ায় এটাও অনেকেই জানেন। রোগটিতে মৃত্যু ঘটতে পারে। তাই এই রোগের অন্যতম প্রধান উপসর্গ জ্বর হলেই মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। অন্য দিকে এই রোগটিকে নিয়েই বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে চলছে চাপানউতোর। সরকারের বিরুদ্ধে ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ে তথ্য গোপন করার অভিযোগ। আর সংবাদমাধ্যম ও বেসরকারি হাসপাতাল ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির বিরুদ্ধে সরকারের বিভ্রান্তি তৈরি করার অভিযোগ। সরকারি ভাবে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত রাজ্যে ডেঙ্গিতে আক্রান্তের সংখ্যা ২০,১৩২। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত শুধু উত্তর ২৪ পরগনা জেলাতেই ডেঙ্গিতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭৯৩৯ জন আর মৃতের সংখ্যা ছিল ১৭ জন। ওই তথ্য অনুযায়ী, জেলার দ্বিতীয় সর্বাধিক ডেঙ্গি প্রকোপিত অঞ্চল দক্ষিণ দমদম পুর এলাকায় ডেঙ্গিতে আক্রান্তের সংখ্যা ১৮০৩ জন। কিন্তু ওই পুরসভার চেয়ারম্যান এই তথ্য অস্বীকার করে বলেছেন যে তাঁর পুরসভার অন্তর্ভুক্ত এলাকায় ডেঙ্গিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৮০০ জন এবং মৃতের সংখ্যা ৪ জন। আবার, সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, উত্তর দমদম বিধানসভার নির্বাচিত প্রতিনিধি তন্ময় ভট্টাচার্যের বক্তব্য, দক্ষিণ দমদমের শুধু মধুগড়-পূর্ব সিঁথিতেই ৯ জন ডেঙ্গিতে মারা গিয়েছে।

Advertisement

আসলে রোগটিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যত বেশি হবে তত বেশি করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতার দায় শাসকের উপর বর্তাবে। তাই রোগটিকে কেন্দ্র করে ভোটের রাজনীতির তরজা শুরু হয়েছে। শাসকের লক্ষ্য ড্যামেজ কন্ট্রোল, বিরোধীদের লক্ষ্য ড্যামেজ উন্মোচন। রোগটিকে উপযুক্ত ভাবে মোকাবিলা করার ব্যাপারে কার কতটুকু সত্যিই মাথাব্যথা আছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকছেই। নয়তো গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে যে রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে তাকে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কিছু অগ্রগতি অন্তত লক্ষ করা যেত। তবে রোগ প্রতিরোধের পরিবর্তে রোগ নিরাময়ের নীতিই যে সরকার এবং সরকার বিরোধী সকলের প্রথম পছন্দ, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থাটিকেও ঠিক ভাবে গড়ে না তোলায় ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রয়োজনীয় চিকিৎসাটুকুও সকলের ভাগ্যে জোটে না। জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা, সবেতেই বাংলা তথা ভারতের অবস্থা বেশ খারাপ। তাই ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে শাসক খুবই স্পর্শকাতর থাকবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়।

ডেঙ্গির কোনও ওষুধ বা টিকা নেই। তাই টাইফয়েড জ্বরের ক্ষেত্রে ওষুধ খাইয়ে বা পোলিয়োর ক্ষেত্রে টিকা দিয়ে যেমন রোগের বিপদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়, ডেঙ্গির ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। ডেঙ্গির বাহক ‘এডিস ইজিপ্টাই’ মশাকে নিয়ন্ত্রণ করাই ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়। কিন্তু ভারতের শাসকরা যেহেতু রোগ নিরাময়ের নীতিকেই তাঁদের স্বাস্থ্য নীতিতে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছেন, তাই ডেঙ্গির বাহককে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তাঁদের বিশেষ মনোযোগ নেই। না হলে, যে জমা জলের কারণে মশার বংশবৃদ্ধি হয়, সেই জমা জলের সমস্যা দিনের পর দিন বাড়তে পারে? খোলা জায়গায় জল জমতে দেবেন না— এ কথা শুধু নাগরিকদের বললেই তো চলবে না, রাষ্ট্রকেও তো দেখতে হবে, জনজীবনের কোন ক্ষেত্রগুলিতে জমা জলের দায় রাষ্ট্রের নিজেরই। সরকারের যত খোঁড়াখুঁড়ির কাজ, তা শুরু হয় বর্ষাকালে— এটা তো বহুদিন আগে থেকেই চালু একটি কথা। সুষ্ঠু জলনিকাশি ব্যবস্থা না থাকার ফলে শহরগুলিতে জমা জলের সমস্যা যে ক্রমশ বাড়ছে, এ কথাও তো রাষ্ট্রের মাথাদের অজানা নয়। আমার বসবাসের এলাকার উদাহরণ এ ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক হবে। আমি পানিহাটি পুর এলাকায় বসবাস করি। এর এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিকাশি নালাগুলির সঙ্গে খালের কোনও সংযোগ নেই। ফলে ওই অঞ্চলের নিকাশি নালাগুলির জল খাল হয়ে নদীতে পড়তে না পারায় বহু নিকাশি নালাতেই বছরের বেশির ভাগ সময় জল স্থির হয়ে জমে থাকে। নালাগুলিতে প্লাস্টিকজাত বর্জ্য পদার্থ জমে থাকায় সমস্যাটা আরও বেশি হয়। এই অবরুদ্ধ নালাগুলি মশার বংশবৃদ্ধির পক্ষে খুবই উৎকৃষ্ট জায়গা। অথচ এই সমস্যাটি দীর্ঘদিনের হওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চলের নিকাশি ব্যবস্থায় কোনও উন্নতি নেই। বরং জলাভূমি বুজিয়ে নগরায়ণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে এলাকায় জল নিষ্কাশনের প্রাথমিক উপায়গুলিও উধাও। ফলে বর্ষাকালে ওই অঞ্চলগুলি বিশেষ ভাবে জলমগ্ন হয়ে পড়ে এবং কোথাও কোথাও জল দীর্ঘদিন জমে থাকে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই আজকাল আবার রাস্তা উঁচু করার ধুম পড়ায় বহু বাড়িতেই বর্ষার জল আটকে পড়ছে। এর থেকে রেহাই পেতে যাদের সামর্থ্য ও সুযোগ আছে তারা বাড়ির জমিতে মাটি বা রাবিশ ফেলে জমি উঁচু করে নিচ্ছে। যাদের সে উপায় নেই তাদের অনেকের বাড়িতেই জল জমে থাকছে এবং মশার আড্ডার উপযুক্ত স্থান হয়ে উঠছে। সুষ্ঠু নিকাশি ব্যবস্থার অভাবে কী ভাবে একটি অঞ্চল মশার আঁতুড়ঘর হয়ে উঠতে পারে, পানিহাটি পুর এলাকা তার একটি উদাহরণ। এমনকী জমা জলে যাতে মশার বংশবৃদ্ধি না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও দেখা যায় চরম ঔদাসীন্য। মশার লার্ভা মারার তেল বহু জায়গাতেই নিয়ম করে স্প্রে করা হয় না। এই চরম সংকটের সময় আবার ডেঙ্গি আটকাতে কোথাও কোথাও ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো হচ্ছে! কীটনাশক হিসাবে ব্লিচিং পাউডার ভাল, কিন্তু তাতে মশার লার্ভা নিধন করা যায় এমনটা কখনও শোনা যায়নি।

Advertisement

আসলে জনস্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ যদি দৈনন্দিন বিষয় না হয় তবে এ ধরনের দুর্বলতা অনিবার্য। জনস্বাস্থ্যের অন্যতম খুঁটি স্যানিটেশনের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলার জন্যই আজ ডেঙ্গির এই বাড়বাড়ন্ত। উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থার অর্থ তো আর শুধু লোকের মাঠে পায়খানা বন্ধ করা নয়, আরও অনেক কিছু।

(চলবে)

প্রতীচী ইনস্টিটিউট-এ কর্মরত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন