ভাবতে হবে গ্রাম শহর মিলিয়ে

এ সব দেখে অনেকে আবার এক সর্বরোগহর বটিকার নিদান দিয়ে থাকেন— আরও অনেক পরিকল্পিত শহর করা উচিত ছিল, যেমন হয়েছিল সেই বিধানবাবুর আমলে।

Advertisement

মহালয়া চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৮ ০০:০৩
Share:

এ দেশে শহর দু’রকম। এক, স্বায়ত্তশাসিত শহর, যেখানে পুর নিগম, পুরসভা, প্রজ্ঞাপিত অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, নিদেনপক্ষে সেনা-ছাউনি আছে। এ সব জায়গায় বিধিবদ্ধ কিছু নিয়ম আছে, নাগরিকদের সে সব মেনে চলতে হয়, আর শাসকদেরও দায়িত্ব আছে নাগরিক সুবিধাগুলির ব্যবস্থা করার। শহরের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা নিয়ে কিছু সমস্যার কথা এই লেখার প্রথম পর্বে (‘শহর গড়ার পরিবেশ’, ৫-৬) বলেছি। দ্বিতীয় ধরনের শহর হল একেবারে নেই-রাজার দেশ, যাদের নাম সেনসাস টাউন। নাম থেকেই মালুম, জনগণনা আধিকারিক প্রতি দশ বছরে জনশুমারির সময়ে তিনটি লক্ষণ দেখে গ্রামকে শহর করে দেন। এদের শাসন বা অন্যান্য দায় কিন্তু থাকে গ্রামীণ ব্যবস্থার মধ্যেই। আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থায় আবার গ্রাম আর শহর হল দুটো আলাদা ঘর, যাদের মধ্যে কোনও সংযোগ নেই। তাই এই সেনসাস টাউন, চরিত্রে শহর আর প্রশাসনে গ্রাম, এক আজব হাঁসজারু। এখানে জলাভূমি বুজিয়ে আকাশচুম্বী বাড়ি তুললেও কোনও অনুমতির দরকার নেই, খালি কৃষিজমি হলে জেলাশাসকের অনুমতি নিতে হয়, ব্যস। সংবিধানের ৭৪তম সংশোধনীতে এই পরিবর্তনশীল অঞ্চলগুলির জন্য নগর পঞ্চায়েত নামে এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন সংস্থার কথা বলা হয়েছিল। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে তার কিছু প্রয়োগ হলেও বাম-শাসিত পশ্চিমবঙ্গ গ্রামে তাদের রাজ্যপাটের কথা ভেবে সে পথে হাঁটেনি। তাই এখানে এই সেনসাস টাউনগুলি সম্পূর্ণ অনাথ।

Advertisement

এ সব দেখে অনেকে আবার এক সর্বরোগহর বটিকার নিদান দিয়ে থাকেন— আরও অনেক পরিকল্পিত শহর করা উচিত ছিল, যেমন হয়েছিল সেই বিধানবাবুর আমলে। এখানে একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। আধুনিক নগরায়ণের ধাঁচটা এসেছিল শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে, যার মূলে ছিল বড় বড় কারখানা। চিমনির ধোঁয়ায় নোংরা হতে থাকা শহর থেকে মানুষকে বাঁচাতে এবেঞ্জার হাওয়ার্ড শুরু করেছিলেন গার্ডেন সিটি মুভমেন্ট, যেখানে জনসংখ্যা হবে পরিকল্পনা মাফিক আর নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থাও করা হবে সেই অনুসারে। সোভিয়েত বিপ্লবের পরে এই পরিকল্পিত শহর অন্য মাত্রা পেল। দেশে বেশ কিছু পরিকল্পিত শহর তৈরি করা হল নতুন শিল্প (কখনও বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) স্থাপনের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ (বিশেষত পোল্যান্ড), কিছু সময়ের জন্য চিন এই পথে চলেছে। জওহরলাল নেহরুর সময়ে ভারতে পরিকল্পিত শহরের বাড়বাড়ন্ত একই দর্শন থেকে। রাজধানী শহর (চণ্ডীগড়, ভুবনেশ্বর), শিল্প শহর (ভিলাই, বোকারো), পাকিস্তানাগত শরণার্থীদের জন্য শহর (যমুনানগর, নীলখেরি), কত রকমের শহর তখন হয়েছে। এ রাজ্যের দুর্গাপুর, কল্যাণী ইত্যাদি সেই পরিকল্পনারই অংশ। কিন্তু তার পরে এটা আর চালানো সম্ভব হল না। এ রকম শহর করতে গেলে চাই প্রচুর জমি আর পুঁজি। ভারতে যখন জমি সুলভ ছিল, তখন সরকারি পুঁজির আকাল ছিল। এখন ছবিটা পাল্টে গিয়েছে। একলপ্তে এতখানি জমি পাওয়া শক্ত, পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও।

আর এই পরিকল্পিত শহরগুলির অভিজ্ঞতাও খুব একটা ভাল নয়। সব জায়গাতেই দেখা গিয়েছে পরিকল্পিত শহরে নানা রকম বিধিনিষেধের জন্য তার আশপাশের অঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়েছে অনিয়ন্ত্রিত গতিতে (যেমন কল্যাণীর স্তিমিত বৃদ্ধির পাশে গয়েশপুরের অতিবৃদ্ধি)। অনেক সময়ে মানুষ নিজের প্রয়োজনে নানা রকম ব্যবস্থা করেছেন, যা ভবিষ্যতের পক্ষে খুব সুখকর নয়। ভূগর্ভস্থ জলের অঢেল ব্যবহার তার অন্যতম। আবার গবেষণায় দেখছি, প্রচুর নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য থাকা সত্ত্বেও এই পরিকল্পিত শহরগুলির আকর্ষণ-ক্ষমতা তার আশপাশের অপরিকল্পিত শহরের চেয়ে কম। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের সব পুরনো শহরকে বাতিল করে দিয়ে তো আর নতুন পরিকল্পিত শহর দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া যায় না!

Advertisement

তা হলে উপায়? ভাবতে হবে জনবসতি পরিকল্পনার কথা, গ্রাম আর শহর একসঙ্গে নিয়ে। স্বীকার করতে হবে, নগরায়ণ একটি অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া, হাজার চেষ্টা করলেও আমরা উল্টো রথের যাত্রা করাতে পারব না। আজ যা গ্রাম, কাল তা শহর হবে। সেখানে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করতে হবে, পরিবেশের অবনয়ন চলবে না, দেড়শো কোটি লোকের খাদ্য সুরক্ষার জন্য কৃষিজমির অত্যধিক সঙ্কোচন চলবে না, প্রাকৃতিক পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র, জলাভূমি, বনভূমি সব কিছু রেখেই মানুষের ভদ্র ভাবে থাকার বন্দোবস্ত করতে হবে। এবং কাজটা শুরু করতে হবে অঞ্চলভিত্তিক জমি পরিকল্পনা থেকে, যেটা প্রথম থেকেই এখানে চূড়ান্ত অবহেলার শিকার। কিন্তু নানা রকম নতুন প্রযুক্তি আর উপগ্রহচিত্রের কল্যাণে কাজটা খুব শক্ত নয়। চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?

(শেষ)

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষিকা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন