Politics

ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে মোদী বিদেশনীতির মৌলিক দর্শন থেকে বিচ্যুত

প্রধানমন্ত্রীর এ কোন ধরনের অপ্রধানমন্ত্রী সুলভ আচরণ? প্রশ্ন তুললেন জয়ন্ত ঘোষালপ্রধানমন্ত্রীর এ কোন ধরনের অপ্রধানমন্ত্রী সুলভ আচরণ? প্রশ্ন তুললেন জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

প্রধানমন্ত্রীর এ কোন ধরনের অপ্রধানমন্ত্রী সুলভ আচরণ! ফাইল চিত্র।

সাসপেন্ডেড কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ারের বাসভবনে পাকিস্তানের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী কাসুরির সৌজন্যে আয়োজিত নৈশভোজে যোগদানকে কেন্দ্র করে খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ ওঠালেন, কংগ্রেসের হাত ধরে পাকিস্তান গুজরাতে সরকার পাল্টাতে চাইছে। এ দেশের কোনও প্রধানমন্ত্রীকে এর আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার অভিযোগ তুলতে শুনিনি।

Advertisement

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে বিজেপির হিন্দুত্ব ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি নতুন নয়। আবার কংগ্রেসের মতো দলেও দেখেছি বিজেপির মোকাবিলা করার জন্য পাক সন্ত্রাসের বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া। মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে পাকিস্তান সফরে মৈত্রীর বার্তা নিয়ে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস তাতে রাজি হয়নি। সে হল পাকিস্তান বিরোধিতার প্রশ্নে ভারতীয় রাজনীতি। বিহারের বিধানসভা ভোটের সময় বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের বিতর্কিত মন্তব্য ছিল: যাঁরা বিজেপির বিরোধিতা করছেন সেই সব সংখ্যালঘু পাকিস্তানে গিয়ে দীপাবলির সময় বাজি ফাটান। পাকিস্তান ম্যাচ জিতলে এ দেশে তাঁদের বাজি ফাটাতে দেব না।

কিন্তু এ বার মাত্রা ভিন্ন। এ বার অভিযোগ উঠছে, কংগ্রেস, যারা দেশের প্রধান বিরোধী দল, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গুজরাতে বিজেপি সরকারকে ফেলতে চাইছে। পাকিস্তান মোদীর এই প্রতিক্রিয়ায় খুশি। পাকিস্তানের জন্য যদি ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে তবে পাকিস্তানের আহ্লাদিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। পাকিস্তান নীতি নিয়ে সেই নেহরুর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত ভারতীয় সর্বদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটা ঐকমত্য ছিল। প্রধানমন্ত্রীর এ কোন ধরনের অপ্রধানমন্ত্রী সুলভ আচরণ, যেখানে তিনি দেশের ভিতর এত দিনের ঐকমত্যকেই নিজের হাতে বিনষ্ট করছেন। তা-ও একটা রাজ্যে পঁচিশ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও যেন তেন প্রকারে দলকে ক্ষমতায় রাখার জন্য?

Advertisement

কোনও আলটপকা মন্তব্য তিনি মেনে নেবেন না। মণিশঙ্করকে সাসপেন্ড করে সে কথাই বুঝিয়ে দিয়েছেন রাহুল।

মণিশঙ্কর আইয়ার যে ভাবে কথা বলেন, সেই স্টাইল আমার কোনও দিনই পছন্দ নয়। রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় মণি তাঁর যুগ্ম সচিব ছিলেন। সেই সময়েও দেখেছি, এ হেন আলটপকা মন্তব্য করা ছিল মণিশঙ্করের স্বভাব। যে কোনও মানুষের কাছ থেকেই আমরা ন্যূনতম বিনয় প্রত্যাশা করি। মণি সেই স্কুলের ছাত্রই নয়। কিন্তু তা বলে পাকিস্তানের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী কাসুরি মণির বাড়িতে এসেছেন এবং সেখানে মনমোহন বা নটবর সিংহ গিয়েছেন বলেই এই যে গেল গেল রব তোলা হচ্ছে তা অত্যন্ত ভুল রাজনীতি।

প্রথমত, পরমাণু যুগে উত্তর ঠান্ডা যুদ্ধ এই আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য একটি রাষ্ট্র শুধুই একতরফা ঝগড়া করে না। সংঘাত ও কূটনীতি সর্বদাই একসঙ্গে চলে। পাকিস্তান নীতিও এমনই হওয়া উচিত। সন্ত্রাস ও পাকিস্তানের ভারত বিরোধী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রস্তুতি চলুক। কাশ্মীরেও পাক ষড়যন্ত্র রুখতে হবে। কিন্তু তা বলে কূটনৈতিক স্তরেও সরকারি ও বেসরকারি বা ‘ট্র্যাক-টু’ নীতি মেনে আলোচনার চ্যানেলটা আমরা বন্ধ করে দেব, সভ্য জগতে এ কি কোনও কাজের কথা? কার্গিল যুদ্ধের পরেও আগরায় শীর্ষ বৈঠক হয়। তখনও অনেকে সে বৈঠক করার বিপক্ষে ছিলেন। এমনকী, আডবাণী ও জর্জ ফার্নান্ডেজ, দু’জনেই খুব পাক-বিরোধী ছিলেন। বাজপেয়ী তখন কিন্তু ব্রজেশ মিশ্র এবং যশোবন্ত সিংহের সমর্থনে আগরা শীর্ষ বৈঠকে সম্মতি দেন। সেই পারভেজ মুশারফের সঙ্গে আলোচনায় বসেন বাজপেয়ী। কার্গিলের ক্ষত বুকে নিয়েও আলোচনায় বসেন। ’৬২ সালে ভারতকে আক্রমণ করে চিন। ’৬৪ সালে নেহরু মারা যান। ’৬৩ সালেও নেহরু সংসদে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, এখনও তিনি, এই আক্রমণের পরেও এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চিনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি আছেন। সে কথা নেহরু এক চিঠিতে বার্ট্রান্ড রাসেলকে জানিয়েও ছিলেন। ভাবুন এক বার নেহরুর উদার মানসিকতা।

শুধু উদারতা নয়, এ তো কৌশলও। প্রথমত, চিন এবং পাকিস্তান— দু’পক্ষের সঙ্গেই এ ভাবে যুগপৎ যুদ্ধ পরিস্থিতি জিইয়ে রাখা, এ কোন ধরনের রাজনীতি? দ্বিতীয়ত, বিদেশনীতি নিয়ে অন্তত এ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এক দীর্ঘ দিনের ঐকমত্যের ঐতিহ্য ছিল, সেটাও নষ্ট করার মতো রাজনৈতিক মূর্খামি আর কী হতে পারে?

আরও পড়ুন: ভোটের এই গুজরাতে আর যাই থাক, ‘গুজরাত মডেল’ নেই

কাসুরি হঠাৎ নয়, মাঝে মাঝেই এ দেশে আসেন। ভারত-পাকিস্তান এক থিঙ্ক ট্যাঙ্কের পাকিস্তান চ্যাপ্টারের প্রধান তিনি। ভারত-পাক সম্পর্ক নিয়ে কাসুরি একটি বিশাল বইও লিখেছেন। এর আগে লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে দেখা করে সে বইটি তিনি উপহার দেন। মণিশঙ্করের বাড়িতে তো কোনও গোপন বৈঠকও হয়নি। সেখানে প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী নটবর সিংহ যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন প্রাক্তন বিদেশ সচিব সলমন হায়দার। প্রাক্তন সেনাপ্রধান দীপক কপূর যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন রাহুল খুশবন্ত সিংহ। এতগুলো মানুষ একত্রিত হয়ে কাসুরি ও মনমোহনের সামনে গুজরাতের নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছিলেন? অসাধারণ!!

আমার মনে হচ্ছে ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী বিদেশনীতির মৌলিক দর্শন থেকে বিচ্যুত।

গুজরাত নির্বাচন নিয়ে সব খবর পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন