সম্পাদকীয় ২

অবশেষে উন্নয়ন

উন্নয়ন কাহাকে বলে, এই প্রশ্নের উত্তরে ‘গুজরাত মডেল’-এর কথা শোনা যাইত। তাহার কেন্দ্রে আছে ট্রিক্‌ল ডাউন বা চুয়াইয়া পড়া উন্নয়নের ধারণা— বিনিয়োগ আসিলেই সমাজের সর্ব স্তরে উন্নয়ন পৌঁছাইয়া যাইবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৫৭
Share:

১৮ তারিখ সন্ধ্যায় অমিত শাহ যদি সাংবাদিক সম্মেলন ডাকিয়া গুজরাত নির্বাচন জয়ের যাবতীয় কৃতিত্ব লালকৃষ্ণ আডবাণীকে দিতেন, নরেন্দ্র মোদীর ঠিক কেমন লাগিত? দলীয় রাজনীতিতে যে বৃদ্ধের আর কোনও গুরুত্বই নাই, নির্বাচনের প্রচারপর্বে যাঁহার কথা কাহারও মনেও পড়ে নাই, তাঁহাকে জয়ের কৃতিত্ব দেওয়া এমন এক জনকে ফেলিয়া, যিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বকে সম্পূর্ণ অবহেলা করিয়া কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করিতে করিতে গোটা রাজ্য চষিয়া ফেলিয়াছিলেন? বুলেট ট্রেনে প্রচারের বোধন করিয়া বিদায়বেলায় সি প্লেনের ধামাকা দেখাইয়াছিলেন? নরেন্দ্র মোদী হয়তো প্রশ্ন করিতেন— আমি এমন কী করিয়াছি যাহাতে আমার প্রতি এহেন আচরণ করা চলে? না, অশোক রোডের রাজদরবারে লালকৃষ্ণ আডবাণীর নামটিও উচ্চারিত হয় নাই। সেখানে নরেন্দ্র মোদীরই জয়ধ্বনি। কিন্তু, সেই ঢক্কানিনাদে তিনি শুনিতে পান নাই, তাঁহার বিরুদ্ধেও সেই একই অভিযোগ উঠিতেছে। সাম্প্রদায়িক উসকানি, পাকিস্তানের জুজু, গুজরাতি অস্মিতা, মোঘল সাম্রাজ্যের ‘ইতিহাস’, প্রত্যেকে প্রশ্ন করিতেছে— নির্বাচন জিতাইলাম আমরা, আর জয়ের কৃতিত্ব ‘উন্নয়ন’ লইয়া যাইতেছে? কেন আপনি বলিতেছেন না, এই জয় হিন্দুত্ববাদী আবেগ উসকাইয়া দেওয়ার কৌশলের, রাহুল গাঁধীর ধর্মীয় পরিচয় লইয়া সংশয় প্রকাশ করিবার নীচতার, মনমোহন সিংহকে পাকিস্তানের সহিত কাল্পনিক ষড়যন্ত্রের চক্রী হিসাবে দেখাইবার? সেই সত্য স্বীকার করিবার সাহস নাই বলিয়াই কি?

Advertisement

উন্নয়ন কাহাকে বলে, এই প্রশ্নের উত্তরে ‘গুজরাত মডেল’-এর কথা শোনা যাইত। তাহার কেন্দ্রে আছে ট্রিক্‌ল ডাউন বা চুয়াইয়া পড়া উন্নয়নের ধারণা— বিনিয়োগ আসিলেই সমাজের সর্ব স্তরে উন্নয়ন পৌঁছাইয়া যাইবে। ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ ঝলক হারাইতেছে, সে রাজ্যের শিল্পায়নের লুকানো কঙ্কাল প্রকাশ পাইতেছে, তাহা ভিন্ন কথা। সেই পচন ধরা না পড়িলেও কি ‘গুজরাত মডেল’-এর ঢাক পিটাইয়া নির্বাচনে জিতিতে পারিত বিজেপি? সন্দেহ হয়। কারণ, শুধুমাত্র ট্রিক্‌ল ডাউনের ভরসায় থাকিলে যাহা হয়, গুজরাতে তাহাই হইয়াছে— শিল্পায়নের প্রদীপের নীচে জমাট অন্ধকার। মানবোন্নয়নের হরেক সূচকে গুজরাতের অবস্থা লজ্জাজনক, বিশেষত তাহার উচ্চ মাথাপিছু হারের তুলনায়। অসম উন্নতিই এখন সেই রাজ্যের অভিজ্ঞান।

আর্থিক সমৃদ্ধিকে সর্বজনীন করিবার পথগুলি সম্বন্ধে নরেন্দ্র মোদীদের ঘোষিত অবজ্ঞা এবং ফলিত ঔদাসীন্য প্রমাণ করিয়া দেয়, সেই উন্নয়নে তাঁহাদের মন নাই। গুজরাতে ধাক্কা খাইবার পর তাঁহারা কৃষিক্ষেত্রে বদান্যতার বান বহাইয়া দিবেন বলিয়া অনুমান। একশত দিনের কাজের পরিমাণও বাড়িবে, গণবণ্টন ব্যবস্থার দিকেও নজর পড়িবে। ইউপিএ আমলে সমবণ্টনের প্রতি অগ্রাধিকারের প্রথাকে তাঁহারা ঠাট্টাতামাশার বিষয় বানাইয়াছিলেন। এখনও তাঁহারা সম্ভবত উপলব্ধি করেন নাই, গুজরাতে হার্দিক পটেল বা জিগ্নেশ মেবাণীর ন্যায় নেতাদের উত্থানের মূল কারণ এই উন্নয়নের অসাম্য— বিজেপি-বিরোধিতার রাজনীতি নহে। নরেন্দ্র মোদীরা বুঝিতেছেন না, কারণ উন্নয়নে তাঁহাদের মন নাই। নির্বাচন জিতিবার পর ‘বিকাশ’-এর মানে জয়ধ্বনি দেওয়া গেলেই যথেষ্ট।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন