ছবি: সংগৃহীত।
দিনভর আমাদের প্রতিবেদক ঘুরে বেড়ালেন গুজরাতের আনাচে-কানাচে, তুলে ধরলেন নির্বাচনের নানা চিত্র। যে ছবি উঠে এল, তাতে সর্বাগ্রে কী চোখে পড়বে বাংলার যে কোনও বাসিন্দার? চোখে পড়বে, নির্বাচনকে ঘিরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রশংসনীয় ছবিটা। অবধারিত ভাবে কোন প্রশ্নটা জাগবে? গুজরাত পারে, বাংলা কেন পারে না?
যে কোনও বাঙালি বা পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও বাসিন্দা নির্বাচনের দিন ঠিক কী দেখতে অভ্যস্ত? দিনভর রিগিং বা বুথ জ্যাম বা মারধর বা ভোটারকে হুমকি দেওয়ার ছবি। বুথে পৌঁছনোর পথেই ভোটারকে ভয় দেখিয়ে ফেরত পাঠানোর ছবি। দু’তিনটে বোমা বা চার-পাঁচটি গুলি বা কয়েকটা রক্তাক্ত দেহের ছবি। পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ভোট লুঠেরাদের সংঘর্ষের ছবি।
গুজরাতে কী দেখা গেল? টানটান উত্তেজনার নির্বাচন সত্ত্বেও দিনভর যুযুধান দুই শিবিরের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। নির্বাচনী আচরণবিধির প্রতি সব রাজনৈতিক দলেরই স্বতঃপ্রণোদিত দায়বদ্ধতা।
যে কোনও পরিণত গণতন্ত্রে তো নির্বাচনের ছবিটা এই রকমই হওয়া উচিত। ভোটগ্রহণ অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ হওয়া তো গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শর্ত। উন্নত বিশ্ব বলতে যে সব দেশকে বুঝি আমরা, সেখানে নির্বাচনে তেমন ছবিই দেখা যায়। ভোটগ্রহণ ঘিরে তুমুল উত্তেজনা এবং নিজের ভোটটা নিজে দিতে পারা নিয়ে বিস্তর সংশয় তো কোনও সুস্থ গণতন্ত্রের ছবি হতে পারে না। বিপরীত শিবিরের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতি দূরে সরিয়ে রেখে যে ভোটের দিনে একসঙ্গে সময় কাটানো যায় এবং তাতেও নিজস্বতা বজায় রাখা যায়, গুজরাত সে ছবিও দেখাল। প্রত্যাশিত ছবিটাই দেখাল আসলে। তা হলে আমরা কেন পারি না এখনও?
আরও পড়ুন
‘আমি ওদের দলে নই’ বলেও হাসি-ঠাট্টা-আড্ডা একসঙ্গে ভোটের দিনে
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত— বড়াই করে বলে থাকি আমরা। মনে রাখা দরকার, শুধু বৃহৎ হলেই চলে না, মহৎও হতে হয়। উন্নত বিশ্বে যে ধরনের নির্বাচন সম্ভব, এই ভারতের নানা প্রান্তেও যে সে ভাবেই নির্বাচন হয়ে থাকে, তা নিয়ে সংশয় নেই। তা হলে দেশের সব প্রান্তে এ ভাবে ভোট হয় না কেন? আবার প্রশ্নটা করতে হয়, গুজরাত পারে, বাংলা পারে না কেন?
অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সব সময়ই সরব থাকি আমরা, বলিষ্ঠ মতামত রাখি। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বা সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতাকে তীব্র ধিক্কার জানাতেই আমরা অভ্যস্ত। তা হলে এমন ঘোর রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতাই বা কেন থাকবে আমাদের মধ্যে? নির্বাচন এলেই প্রতিপক্ষের বা প্রতিদ্বন্দ্বীর ন্যূনতম অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়ার উদগ্র এবং হিংসাত্মক চেষ্টা করব কেন? এই ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতায় আর কত দিন রক্তাক্ত হবে বাংলার প্রতিটি নির্বাচন? জবাব খোঁজার সময় হয়ে গিয়েছে।
জবাব বাংলার প্রত্যেক বাসিন্দাকে খুঁজতে হবে। জবাব খুঁজতে হবে বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন সদর্থক পদক্ষেপ করতে অভ্যস্ত, এই রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে ততটাই সদর্থক ভাবে পা ফেলার সময় এসে গিয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে, প্রগতিশীলতায়, উদারতায় অন্য অনেকের চেয়ে এগিয়ে থাকার কথা সদর্পে বলে থাকেন বাঙালিরা। নির্বাচনী হিংসা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে না পারলে কিন্তু সে দর্প বড় অসার হয়ে পড়ে। অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রশ্নে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছার অভাবটাও প্রকট হয়ে যায়।